পর্ব-১০: নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর দশম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
ন্যান্সি স্পেরো (Nancy Spero)
(১৯২৯-২০০৯)
ন্যান্সি স্পেরো-র আটতিরিশ মিটার লম্বা, টেক্সট আর ফিগারের কোলাজ Torture of Women এক মহাকাব্যিক মাত্রার কাজ। টেক্সটগুলো বিভিন্ন ধরনের উৎস থেকে নেয়া। তার মধ্যে আছে নির্যাতন-নিপীড়নের ওপর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ১৯৭৫ সালের একটা প্রতিবেদন, বিগত ৭০০ বছরের নির্যাতনের সংজ্ঞা, এবং খবরের কাগজের আর্টিকেল। টাইপ করা অথবা কালো লাল এবং হলুদের ওপর ব্লক প্রিন্ট করা টেক্সটগুলোর বেশিরভাগই অসম্পূর্ণ, খণ্ডাংশ মাত্র। তার একটিতে লেখা, “নির্যাতন আজ প্রায়শই মুখ্যত একটি রাষ্টীয় কর্মকাণ্ড; সেটা টাইপ-করা একটি কাগজের নীচের অংশ, যেন টাইপরাইটার থেকে ছিঁড়ে এনে কাগজটির কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। অন্য শব্দগুলো ছুরি-কাটা হয়ে গড়িয়ে পড়ে, অথবা এক হরফ থেকে আরেক হরফে অস্বস্তির সঙ্গে স’রে যায়, আর কালিটা যেন হয়ে দাঁড়ায় রক্তলাল স্বীকারোক্তি।
টেক্সটগুলোর নীচে, উপরে এবং পাশে রয়েছে ড্রইং। সেগুলো স্পেরোর আঁকা হলেও সেসবের মধ্যে অন্তর্নিহিতভাবেই একটা প্রাচীনত্বের ছোঁয়া বিদ্যমান। সেখানে মেসোপেটমীয় ডানাঅলা ফিগার যেমন আছে, তেমনি আছে মিশরীয় চিত্রলিপি, বহু মাথা বিশিষ্ট হাইড্রা আর মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা দেহকাণ্ড বা ধড়। আর এসব এই ইঙ্গিতবাহী যে নির্যাতন কেবল বর্তমানের নয়, বরং সর্বকালের।
স্পেরোর কাজ কখনো কখনো রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবিচারকে তুলে ধরে, এবং Torture of Women দর্শন এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। একটি টেক্সট এমন: “আমি যখন অর্ধনগ্ন হয়ে ঝুলে ছিলাম তখন অনেক মানুষ আমাকে ডাণ্ডাপেটা করছিল।” তার উল্টো দিকেরটিতে লেখা: “তাদের বলা হয়েছিল আমি আত্মহত্যা করেছি।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Torture of Women ১৯৭৬
কাগজের ওপরে করা কোলাজ
৩৮.১ মিটার দীর্ঘ
রোজ ফিন-কেলসি (Rose Finn-Kelcey)
(১৯৪৫ – ২০১৪)
রোজ ফিন-কেলসি ১৯৭৬ সালে লন্ডনের একমি গ্যালারিতে One for Sorrow Two for Joy শিরোনামের একটি দু’দিনব্যাপী পার্ফর্মেন্সে অংশ নেন। গ্যালারির মেঝেতে গাছের ডালপালা বিছানো ছিল, এবং দুটো ম্যাগপাই পাখি সেখানে নেচে বেড়াচ্ছিল। শিল্পী প্লেট-গ্লাসের তৈরি জানালায় ব’সে সেই ম্যাগপাই দুটোকে পাখির গানের একটি প্রতিলিপি বা রেকর্ডকৃত রূপ শোনাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “নারী শিল্পী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতাগুলো প্রকাশ করার জন্যে একটি যথাযথ কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার বাসনা আছে আমার। সাংকেতিক টেক্সটের মাধ্যমে কাজ করাকে সেই বাসনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ব’লে মনে করি, তা সেই টেক্সটে কোনো কথা না থাকলেও।”
উইমিন আর্টিস্টস কালেক্টিভ-এর সঙ্গে জড়িত এবং উইমিন আর্টিস্টস স্লাইড লাইব্রেরি-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফিন-কেলসি পিতৃতান্ত্রিক জগতে নারী হওয়ার জটিলতার কথা প্রকাশের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। এই কাজটি জনপরিসর আর ব্যক্তিগত পরিসরের মাঝের দেয়ালটিকে খতিয়ে দেখতে চেয়েছে; তিনি গ্যালারির ভেতরে পারফর্ম করেছেন, কিন্তু তাঁকে রাস্তা থেকেও দেখা যাচ্ছিল যেখানে এই ইন্সটলেশনের নানান শব্দ ব্রডকাস্ট করা হচ্ছিল। একই সঙ্গে অন্য যে জনপরিসর আর ব্যক্তিগত পরিসরের সম্পর্ক ফিন-কেলসি পরীক্ষা ক’রে দেখতে চাইছিলেন তা ব্যক্তিগতও বটে। ম্যাগপাইগুলোকে তিনি তাঁর অভিন্নহৃদয় ভগ্নী (অল্টার ইগো সিস্টার) হিসেবেও অভিহিত করেছেন। আর যখন তিনি সেগুলোকে দানাপানি দিচ্ছিলেন তখন যেন ‘‘আমি আমার অহমকেই পুষ্টি যোগাচ্ছিলাম।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
One for Sorrow Two for Joy ১৯৭৬
৩৮টি আলোকচিত্র; ৩০টি জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট এবং কাগজের ওপর ৮টি সি-প্রিন্ট,
প্রদর্শনীর ক্যাটালগ, ছাপা কাগজ, এবং কাগজের ওপর কালি।
বিভিন্ন মাত্রা বিশিষ্ট
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর