November 2, 2024
নারীবাদ আলোচনাসাহিত্যফিচার ৩

সতী’র জীবনে পিতৃতন্ত্রের আগুন আর রামমোহন-বিদ্যাসাগরের লড়াই

নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব- ০৮

শারমিন শামস্।। পশ্চিমের নারীবাদ আন্দোলনের ধারায় বিবাহিত নারীদের দুর্দশার কথা যখন উঠে আসছে, তখন সেই একই সময়ে উপমহাদেশের বিবাহিত মেয়েদের চরম বিভৎস জীবনের গল্পগুলো না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ফেমিনিজমের ঢেউ তখন পশ্চিমকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু সেই আঠারো শতকে ভারতবর্ষের নারী তার বিন্দুবিসর্গও জানত না।

সেই সময় বিবাহ নামের সামাজিক প্রথা দিয়ে পশ্চিমের নারীকে বাধা হচ্ছিল দাসত্বে। আর ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের মেয়েদের দাসত্বের পাশাপাশি প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছিল আগুনে পুড়িয়ে। অর্থাৎ তার মৃত্যুও নির্ধারণ করছিল চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তাকে দেয়া হচ্ছিল না কোন ধরণের স্বাধীনতা, সম্পত্তির উপর কোন অধিকার ছিল না তাদের। সে সময় ভারতের নারীর জীবনেও স্বামীই সব। বিয়েই মোক্ষ। স্বামী মারা গেলে তাই তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হত। রাখা হত উপবাসে। তাদের স্বাভাবিক যৌনতার চাহিদাকে বলা হত পাপ। তাই সেই যৌনতার ইচ্ছেকে আটকাতে খাওয়ানো হত নিরামিষ। মাথা মুড়িয়ে, সাদা কাপড় পরিয়ে, সব অলংকার খুলে ফেলে তাকে কুৎসিত বানানোর চেষ্টা চালানো হত, যেন কোন পুরুষ আর তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়। বিধবাদের আবার বিয়ে হবে, এটি ছিল অকল্পনীয়। বিধবারা শুদ্ধমনে সংসারের সমস্ত কাজ করবে, সমাজ এটি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বহু বিধবাকে রেখে আসা হত কাশী বা বৃন্দাবনে, মৃত্যু পর্যন্ত কেউ তার কোন খবর রাখত না।

স্বামী মারা গেলে হিন্দু বিবাহিত নারীর জীবনের সমাপ্তি ঘটত সব অর্থে। হয় তাকে জীবন্মৃত করে রাখা হত, অথবা সহমরণে পাঠিয়ে জৈবিক মৃত্যুটি নিশ্চিত করে ফেলা হত। ভারতবর্ষের নারীর মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হত একটি শব্দ। সতী। সেই কাল থেকে আজ অব্দি এই উপমহাদেশের মেয়েরা সতী শব্দের ফাঁদের ভেতরে হাবুডুবু খাচ্ছে।

সতীদাহকে ধর্মীয় রীতি হিসেবে সমাজে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু সতীদাহের সরাসরি কোনো আদেশ, যা মানতেই হবে, এরকম কিছু বেদে আছে কি না সেটি নিয়ে মতভেদ আছে। শ্রীকুমুদনাথ মল্লিক তার ‘সতীদাহ’ বইটিতে লিখেছেন-

সহমরণ প্রথা ভারতে প্রাচীনকাল হইতে প্রচলিত দেখা যায়। পৃথিবীর আদিম জ্ঞানভাণ্ডার বেদেও ইহার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তের সপ্তম ও অষ্টম দুইটি ঋক্ সহমরণ বলিয়া প্রসিদ্ধ। উহার তাৎপর্য এই এই- ‘‘এই সকল নারী বৈধব্যক্লেশ ভোগাপেক্ষা ঘৃত ও অঞ্জন অনুলিপ্ত পতিকে  প্রাপ্ত হইয়া উত্তম রত্ন ধারণপূর্বক অগ্নি মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করুক। হে নারি! সংসারের দিকে ফিরিয়া চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যাহার নিকট শয়ন করিতে যাইতেছ তিনি গতাসু হইয়াছেন, চলিয়া আইস, যিনি তোমার পাণিগ্রহণ করিয়া গর্ভদান করিয়াছিলেন সেই পতির পত্নী হইয়া যাহা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলই তোমার করা হইয়াছে। …এই ঋক্ দুইটির অর্থ ও পাঠান্তর লইয়া মতভেদ দৃষ্ট হয়। যাঁহারা ইহার অন্য প্রকার পাঠ ও অর্থ করেন তাঁহাদের মতে ৭ম ঋকটার ‘যোনীমগ্নে’ স্থলে ‘যোনীমগ্রে’ পাঠ হইবে ও ইহার তাৎপর্য হইবে এইরূপ: ‘এই সকল নারী বৈধব্য ক্লেশ অনুভব না করিয়া, মনোমত পতিলাভ করত অঞ্জন ও ঘৃতানুলিপ্ত হইয়া গৃহে প্রবেশ করুন।’ ৮মঋকের অর্থ পূর্বানুরূপ। এই ঋক দুইটার পাঠ নিরূপন সম্বন্ধে বহুকাল ধরিয়া বহু বাক্ বিতণ্ডা চলিয়াছে। কিন্তু আজও অবিসংবাদিত কোনো মত স্থাপিত হয় নাই। তাহা না হইলেও  পুরাতত্ত্বানুসন্ধিৎসুর তন্নিমিত্ত বিশেষ অসুবিধা ভোগ করিতে হইবে না, কেননা শাস্ত্রের আদেশ বা অর্থ লইয়া বিতণ্ডা তাঁহার  কার্যান্তর্গত নহে। উক্ত প্রথা সময় বিশেষে প্রচলিত ছিল কি-না ইহার তত্ত্বানুসন্ধানই তাঁহার কার্য। সুতরাং বিসংবাদিত ৭ম ঋক্ পরিত্যাগ করিয়াও অবিসংবাদিত ৮ম ঋক্ লইয়া বিচার করিলেও আমরা বুঝিতে পারি যে, তখন পতির মৃত্যু হইলে পত্নী , ইহসংসারের সমস্ত মায়া ত্যাগ করিয়া মৃত পতির পার্শ্বে স্থান গ্রহণ করিতেন; আর তখন, তাঁহাকে নানামতে প্রবোধ দিয়া সংসারে প্রত্যাবর্তন করিবার নিমত্ত অনুরোধ করা হইত। আবার এমনও হইতে পারে যে, ঐ ঋকটা সহগামিনী রমণীর সহমরণেচ্ছার পরীক্ষামূলক। উহা দ্বারা রমণীর পত্যানুরাগ পরীক্ষিত হইত, এবং তাঁহাকে এতদ্বারা সংসারে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ ও অবসর প্রদান করা হইত। তখন কেহ বা এই সুযোগ গ্রহন করিতেন, কেহ বা হাসিতে হাসিতে পতির সহিত সহমৃতা হইতেন। 

অর্থাৎ বেদ নারীর সতীত্ব ও স্বামীর প্রতি ভালবাসার পরীক্ষা নিতে সহমরণের কথা বলেছে, যেটি আসলে অবশ্যপালনীয় নয়, বলা যায় অপশনাল। মৃত স্বামীর সাথে নারী যখন আগুনে পুড়ে মরতে রাজি, তখন তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনতে বলা হচ্ছে। ততক্ষণে সে সতীত্বের পরীক্ষায় পাশ।

রামায়ণ ও মহাভারতে সহমরণের বহু কাহিনী আছে। এ নিয়ে শ্রীকুমুদনাথ মল্লিক লিখেছেন-

রামায়ণ ও মহাভারত, এতদুভয়ের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করিলে দেখা যায়, রামায়ণের বহুস্থলে সতীদাহের উদ্যোগ হইয়াছে বটে কিন্তু কোনো না কোনো কারণে উহা সম্পন্ন হয় নাই। পক্ষান্তরে মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণাদিতে যেখানেই উহার আয়োজন দেখিতে পাই সেইখানেই উহা উদযাপিত হইয়াছে দেখা যায়।  

মনু’র মানবধর্মশাস্ত্রে সহমরণের কোন উল্লেখ নাই। বরং বিধবা যেন ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করেন, সে কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু মনু ছাড়া সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রেই এ বিষয়ের উল্লেখ আছে। পুরাণে বহু চরিত্র আছেন যারা স্বামীর মৃত্যুর পরও বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন। মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পান্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহেতু পান্ডুকে যৌনসহবাসে মৃত্যুদণ্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। যদিও মহাভারতের কোন কোন অনুবাদকের মতে মাদ্রী স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরেই দুঃখে প্রানত্যাগ করেন এবং দুজনকে একসাথে দাহ করা হয়। অর্থাৎ মাদ্রীকে দাহ করার আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন।

আসলে সতীদাহের বিষয়টি একেবারে এক ধরণের ষড়যন্ত্রমূলক পারিবারিক রাজনীতি থেকে উদ্ভাবিত। আবার এর সাথে যুদ্ধ ও দখল রাজনীতিরও সংশ্লিষ্টতা আছে। যেমন রাজপুতানায় “জহর ব্রত” প্রচলিত ছিল, যাতে কোন শহর দখল হবার আগেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বা জহর বা বিষ খেয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ। আবার অনেকে বলেন, সুন্দরী বিধবাদের প্রতি মুসলিম জায়গীর ও নবাবের কুদৃষ্টি (নজরে বেওয়ার) হাত থেকে বাঁচার জন্য হিন্দু সমাজপতিরা সতীদাহ প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন।

সেভাবেই হোক, এক সময় এইসব বীভৎস ঘটনাগুলোই একটি ভয়ঙ্কর প্রথায় রূপ নেয়।

সেকালে ভারতবর্ষের নারীর জীবন মোক্ষ লাভ করত বিবাহে। বিবাহ করে স্ত্রীরূপী দাসী কিনে আনা ছিল পুরুষের প্রয়োজন ও শখ। শখ বেশি হলে উপপত্নী, রক্ষিতা ইত্যাদি রাখার চলও ছিল। তো স্বামীটি যখন মারা যেতেন একই সাথে তার স্ত্রী ও উপপত্নীরা বিধবা হয়ে যেতেন। বিধবা মানে একটি আশ্রয়হীন নারী, যার দায়িত্ব নেবার প্রয়োজন আছে। যার পেছনে খরচ করবার আছে। সেটি কে করবে? হয় তাকে সংসারে কম খাওয়া, কম পরা দিয়ে দাসী বানিয়ে খাটিয়ে নেয়া যায়। অথবা একেবারে মেরে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়। তো দ্বিতীয়টির পক্ষে বেশ জনপ্রিয়তা তৈরি হল।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিষ্টাব্দ ৪০০) আগে থেকেই সতীদাহের ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিস্টোবুলুস। তিনি টাক্সিলা (তক্ষশীলা) শহরে সতীদাহের ঘটনা দেখে সেটি লিখেছিলেন। গ্রিক জেনারেল ইউমেনেসের এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বেচ্ছায় সহমরণে যায়। এ ঘটনা ঘটে খৃষ্টপূর্বাব্দ ৩১৬ সালে। যদিও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত নয়।

সেকালে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে মাদ্রাজ ও উড়িষ্যায় সতীদাহের প্রচলন কম ছিল। কিন্তু গঞ্জাম, রাজমাহেন্দ্রী ও ভিজেগাপত্তনে সহমরণের ঘটনা বেশি ঘটত। তবে সবচেয়ে বেশি সতীদাহ হত বঙ্গদেশে।

সত্য হল, হিন্দু নারীকে সহমরণে যেতে বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর পর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে জলন্ত চিতায় তুলে দিত। ঢাকঢোলের শব্দ করে তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিত। স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারত জীবন্ত নারীটিকে।  অথবা খাইয়ে দেয়া হত আফিম জাতীয় কিছু, নেশার ঘোরে মৃত স্বামীর সাথে চিতায় উঠে বসত মেয়েটা।

ইতিহাস বলছে, মধ্যযুগে সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর এই প্রথা বন্ধের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। সুফি ও ভক্তিবাদী সাধকরাও এই প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) সতীদাহ আটকানোর জন্য সরকারীভাবে আদেশ জারি করেন। আদেশ ছিল, কোন নারী, প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার সুনির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া সতীদাহ প্রথা পালন করতে পারবেন না। কিন্তু সম্রাটের হুকুম থাকলেও পুলিশকে ঘুষ দিয়ে দিব্যি অনুমতি আদায় করে নিতে পারত পরিবারগুলো।

ইংল্যান্ড থেকে আসা ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি উইলিয়াম কেরি ১৭৯৯ সালে একটা সতীদাহের ঘটনা দেখলেন নিজের চোখে। বীভৎস এই ঘটনার সাক্ষী হবার পর তিনি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন এটা বন্ধ না করা পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন না। তিনি ও তার দুই সহকর্মী জোশু মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তারা সতীদাহের সমস্ত বিবরণ লিখে পাঠালেন।

১৮১২ সালে রামমোহন রায় সতীদাহবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে তিনি মৃতের বাড়ির লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার এই কাজে আরো অনেক অনুসারী ছিলেন। রামমোহন লিখে প্রমাণ করেন, হিন্দুশাস্ত্র সতীদাহের কথা বলে না। ১৮১৫-১৮ সালে সতীদাহ প্রথা বিকট আকার ধারণ করলে রামমোহন রায় ১৮২১ সালে একটি পুস্তিকা আর উইলিয়াম কেরি ১৮২৩ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। কোম্পানি অবশ্য গোঁড়া হিন্দুদের চটাতে চাইতো না। ফলে শক্ত কোন অবস্থানে যেতে চায়নি। কলকাতাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হলেও আশেপাশের বহু এলাকাতে সতীদাহ চলতে থাকে।

১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর হয়ে আসেন। বেন্টিঙ্ককে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। সতীদাহ বন্ধ করলে বিদ্রোহীরা বিপ্লবের সুযোগ খুঁজতে পারে। কিন্তু বেন্টিঙ্কের কাছে বিপ্লবের ভয়ের চেয়ে বিধবাদের জীবন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিঙ্ক আইন জারি করে সতীদাহ নিষিদ্ধ ও সতীদাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ফৌজদারি আদালতে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। এর অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় উইলিয়াম কেরিকে। ধার্মিক কেরি সেদিন তার চার্চ বাদ দিয়েছিলেন অনুবাদ করার জন্য। ১৮৩০ সালের মাঝে বোম্বে ও মাদ্রাজেও আইনের হাত প্রসারিত হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কয়েক হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী পিটিশন করেন এই আইনের বিরুদ্ধে। তাদের মতে, ইংরেজ সরকার তাদের ধর্মীয় বিষয়ে নাক গলাবার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ালে রামমোহন রায় উল্টো আইনের পক্ষে পিটিশন করেন। প্রিভি কাউন্সিল আইনের পক্ষে মত দেয়।

ভারতে পুরোপুরি সতীদাহ আইন করে বন্ধ করতে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। মেবার অনেক দিন পর্যন্ত এই প্রথা টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু জনগণের মাঝে সতীদাহবিরোধী সচেতনতা বাড়তে থাকে। মহারাণা স্বরূপ সিং মারা গেলে তার কোনো স্ত্রীই সহমরণে যেতে রাজি হননি।

রাজা রামমোহন পশ্চিমে জেগে ওঠা নারীবাদ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন না। হয়তো এ বিষয়ে সচেতনও ছিলেন না। কিন্তু নিজ ভুখন্ডে প্রায় একা হাতে যে আন্দোলন তিনি গড়ে তুলে সফল করলেন, তা নারীবাদের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে অর্থে এই উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদি অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে রাজা রামমোহনের নাম অবশ্যই লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সেই কালে এদেশে নারী আন্দোলনের আরেক অগ্রদূত। মৃতপ্রায় নারীর জীবনে প্রাণ দিয়েছিলেন এই মানুষটি।

উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ দীর্ঘদিন ধরে বিধবাদের আবার বিয়ের  অনুমোদন দেয়নি। এমনকি যারা শৈশবে কৈশোরে বিধবা হয়েছিলেন তারাও বৈরাগ্য ও কঠোর ত্যাগস্বীকার করে জীবনযাপন করবেন এমনই ছিল নিয়ম। নিজের শিশুকন্যার বালবৈধব্য ঘোচাতে রাজা রাজবল্লভ অনেক কাল আগে বিধবাবিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজের বিরোধিতায় তা বানচাল হয়ে যায়।

বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি আইন করে বিধবা বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন। সতীদাহ বিলুপ্ত করার পর এটিই প্রথম বড় সমাজ সংস্কার আইন। ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্য হিন্দু উইডো’স রিম্যারেজ অ্যাক্ট করে ভারতবর্ষের সব হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ বৈধ করেছিল। রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর উপস্থিতিতে প্রথম বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠানও সম্পন্ন হয়। বিদ্যাসাগর এমনকি বিধবাদের জন্য মাসে আট টাকা ভাতার ব্যবস্থা করার চেষ্টাও করেছিলেন।

ভারতবর্ষের বিবাহিত ও বিধবা মেয়েদের অধিকার রক্ষায় রাজা রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলন যখন চলছিল, একই সাথে পশ্চিমেও বিবাহিত মেয়েরা লড়ছিল নিজেদের অধিকার আদায়ে। এখানে পার্থক্য হল দুটি। পশ্চিমের মেয়েরা নিজের লড়াই নিজেরা করছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষের মেয়েদের সেই সক্ষমতা তখনো তৈরি হয়নি। ফলে তাদের হয়ে লড়েছিলেন দুজন পুরুষ। আর দ্বিতীয় পার্থক্যটি হল, পশ্চিমের নারীবাদ কখনো থেমে যায়নি, বা স্লথ গতি পায়নি। একই গতিতে আন্দোলন চলেছে এবং মেয়েরা একের পর এক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। কিন্তু এই উপমহাদেশে সতীদাহ রদ ও বিধবা বিবাহের পর বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার জন্য একাই লড়েছেন, কিন্তু নারী আন্দোলনের ধারা কখনো সে অর্থে গতি পায়নি, যুগের সাথে তাল মেলাতে পারেনি এবং সবসময়ই পশ্চিম থেকে পিছিয়ে থেকেছে।

 

[নোট: শ্রীকুমুদনাথ মল্লিকের সতীদাহ বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯১৩ সালে। বইটির সেকালের ভাষা ও বানানরীতি অক্ষুন্ন রেখে উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে।]

(চলবে)