সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার: এ বৈষম্য আর কতদিন?
তনুশ্রী দেবনাথ।। ঘটনা-১: শর্মি উর্বি দুই বোন। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে হুট করে বড় মেয়ের বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন শর্মির বাবা। সেই থেকে সংসারে চিরস্থায়ী অশান্তি। শর্মির মা বাবার বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার ভাইয়েরা জায়গা দিতে নারাজ। লেখাপড়াও বেশি করেন নি যে চাকরি করবেন। এদিকে যেমন শর্মি উর্বি তার বাবার সম্পত্তি পাবে না, তেমনি তাদের মা স্বামী বা ভাইয়ের সম্পত্তির ভাগ পাবে না। বাধ্য হয়ে অসহায় জীবনযাপন।
ঘটনা ২: শ্যামা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। বিয়ের চার বছরের মাথায় রোড এক্সিডেন্টে স্বামী হারান, মেয়ের তখন দুই বছর বয়স। স্বামীর মৃত্যুর দোষ শ্যামার উপর চাপিয়ে অপয়া হিসেবে জুটছিল নানা গঞ্জনা। সব সহ্য করে শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন শ্যামা, যখন দেবরের কুপ্রস্তাব আসল তখন আর স্থির থাকতে পারলেন না। চলে আসলেন বাবার বাড়ি। কিছুদিন যেতেই ভাই, বৌদি বুঝাতে লাগলেন ফিরে যাবার জন্য। ফিরে যাননি শ্যামা, ভাড়া বাসায় থাকেন মেয়েকে নিয়ে। শ্যামা বা তার মেয়ে কেউই কোনো সম্পত্তির অংশীদার নয়, এটাই সত্যি।
ঘটনা-৩: রমলা দেবী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবার মৃত্যুর পর কোটি টাকার সম্পত্তি ভোগদখল করে আসছিলেন। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় মামলা করে। রমলা দেবী মামলায় হেরে যান। নিজের বাবার কষ্টার্জিত সম্পদ এখন তিনি ভোগ করতে পারছেন না। অন্যরা ভোগ করছে।
এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে আমাদের চারপাশে, চোখ খুললেই দেখা যায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারী পুরুষের চেয়ে কম সুবিধা ও অধিকার ভোগ করে। শ্রেণি বিভাজনে সামাজিক মর্যাদার কারণে নানাভাবে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতা কিছুটা হলেও এ নারীর অবস্থার উন্নতি করতে পারে। কিন্তু হিন্দু নারীদের অবস্থা সঙ্গীন। কারণ হিন্দু নারীরা উত্তরাধিকারী হিসেবে কোনো সম্পত্তির ভাগ পায়না। একদিকে যেমন পিতার সম্পত্তির অংশীদার হিন্দু নারী হয় না, তেমনি স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকেও হিন্দু নারী বঞ্চিত।
বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে যারা মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে শাস্ত্রমতে পিণ্ডদান করতে পারে, তারাই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার। হিন্দু সম্পত্তি বণ্টনের দুই ধরনের বিধান চালু আছে।
১. মিতক্ষরা পদ্ধতি
২. দায়ভাগ পদ্ধতি
বাংলাদেশ দায়ভাগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। দায়ভাগ মতবাদে মূলত ৪৮ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারীর উত্তরাধিকারের কথা বলা হয়েছে। পাঁচজন নারী শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরাধিকার লাভ করলেও তাদের ক্রমপর্যায় এত দূরে যে এই ক্রম পেরিয়ে আদৌ কেউ সম্পত্তির অংশ পেয়েছে কিনা তার নমুনা বিরল। কেননা দায়ভাগ পদ্ধতি অনুসারে পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্রের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে পাঁচজন নারীর মধ্যে কেউ সম্পত্তির কোন অংশ পাবেনা। আর যদি কোনো নারী সম্পত্তির অধিকার পায়ও সেটা হয় জীবনসত্ত্বের ভিত্তিতে ভোগ করার অধিকার। নারী সেই সম্পত্তি কাউকে দান করার, বিক্রি করার অধিকার রাখেন না। শুধু আমৃত্যু ভোগ করতে পারেন।
বাংলাদেশের মুসলিম নারীরা পিতার সম্পত্তি ও স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পান। খ্রিস্টান নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপাল তাদের পুরনো হিন্দু আইন সংশোধন করে যথাযথ নারীবান্ধব উত্তরাধিকার আইন করেছে। ১৯৫৬ সালে ভারত এ আইন সংশোধন করে যা Hindu Succession Act 1956 নামে পরিচিত। এরপর ২০০৫ সালে ভারতে আবারও এই আইন সংশোধন করে। যেখানে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ, বাংলাদেশে সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে নেই কোনো সামাজিক আন্দোলন, নেই সরকারের উদ্যোগ। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু আইনের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের উদ্যোগে সতীদাহপ্রথা রোধ ও বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৪৭ সালে হিন্দু Law Bill চারটি খণ্ডে পার্লামেন্টে পাশ হয়। দেশভাগের কারণে ওই সব আইন বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। মোটকথা ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে এদেশে হিন্দু আইনের ক্রমবিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে।
বাংলাদেশ আইন কমিশনের গবেষণামতে, এদেশের ৮৬% জনগন মনে করে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে অধিকার থাকা উচিত। ২০১২ সালের ৭ আগস্ট আইন কমিশন হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার দেয়ার জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু এরপরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান বলে উল্লেখ আছে। সেই সাথে নারী বলে কোনো ধরনের বৈষম্য করা যাবেনা এ কথাও স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সে অনুসারে এই হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংবিধান পরিপন্থী। আর সংবিধান পরিপন্থী যে কোনো আইন বাতিল হবার কথা। হিন্দু আইনের সংস্কার সাধন ও পরিবর্তন এনে যুগোপযোগী আইন পার্লামেন্টে পাস করা এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। হিন্দু নারীদের অধিকার আদায়ে হিন্দু নারীকেই আন্দোলনের প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকার আদায় করে নিতে হবে। তবেই প্রান্তিক অবস্থানে থাকা হিন্দু নারীদের অবস্থার উন্নতি হবে।
তনুশ্রী দেবনাথ: শিক্ষক
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]