November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

গুড প্যারেন্টিং, ব্যাড প্যারেন্টিং

চৈতি চন্দ্রিকা।। আমাদের এই উপমহাদেশে হাজারটা ট্যাবুর মধ্যে অন্যতম হল বাবা-মায়ের দিকে অভিযোগের  আঙুল তোলা। আমরা বাবা মাকে দেবতার আসনে দেখতে অভ্যস্ত। বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের মতবিরোধ হলে আমরা চোখ বন্ধ করে সন্তানটিকে দোষারোপ করি কিংবা বাবা মা যা বলছে তা মেনে নিতে বলি। এই বাবা-মা, মানুষ দুটো অন্য অনেকের কাছে অপরাধী হতে পারবে, কিন্তু সন্তানের কাছে কদাপি নয়। এই উপমহাদেশের লৌকিকতায় দেবতা শব্দটা প্রায়ই আপেক্ষিক। স্ত্রীর কাছে চোর, ডাকাত, মাতাল, লম্পট স্বামীটিই দেবতা। সারা গাঁয়ের লোকের হাতে পিটুনি খেয়ে বাড়ি এসে সে ক্ষমতা রাখে বউকে অন্যায়ভাবে পেটানোর। বউ এর অধিকার নেই তার দিকে একবার আঙুল তোলার। ঠিক তেমনি সন্তানের কাছে বাবা-মা হলেন দেব-দেবী, সকল বিচার-বিবেচনার উর্ধ্বে। চোখ বুজে থাকতে হবে এখানে। এই যে অধীনস্ত করে রাখার প্রবৃত্তি তা সমাজের সবথেকে মৌলিক প্রতিষ্ঠানটি থেকেই চর্চা হয়। আবার বলা যায়, সমাজে এবং রাষ্ট্রে সামন্তপ্রথা চর্চার ফলস্বরূপ পরিবারগুলোও সামন্তরীতিতে পরিচালিত হয়। ব্যাপারটা ‘ডিম আগে, নাকি মুরগী আগে’ এর মত গোলমেলে।

সম্প্রতি গুড প্যারেন্টিং, ব্যাড প্যারেন্টিং নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা দেখলাম। এই যে প্যারেন্টিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এটা আমার কাছে সামাজিক বিপ্লবের আভাস মনে হয়। একটি সিস্টেম একদিনে একজন বদলাতে পারে না। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ সিস্টেমের ভেতরে অভিযোজিত হয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করে। যে এই লড়াইটা শেষ অব্দি চালিয়ে যেতে পারে, সে দিনশেষে সফল হয়। এবং তারপর যদি সে চায় তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সে অল্প কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। যে এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারে না, সিস্টেমের বিপক্ষে লড়তে লড়তে একদিন সে হতাশ হয়। তার এই চেষ্টা গোটা সিস্টেমে মৃদু আঘাত করে ঠিকই, কোনদিন সিস্টেম ভাঙ্গলে সেটাতে তার ক্ষুদ্র অবদান থাকে ঠিকই, কিন্তু নিজে ব্যক্তিগত জীবনে সফলতার মুখ দেখতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে সে একজন ব্যর্থ মানুষ। তার এবং তার আশেপাশের মানুষগুলোর উপর এই ব্যর্থতার প্রভাব পড়ে। তাই অধিকাংশ মানুষ সিস্টেমে গা ভাসাতে চাইবে, টিকে থাকতে চাইবে, নিজের মূল্যবান জীবনটাকে অর্থপূর্ণ করতে চাইবে। আমাদের বাবা-মায়েরা তাই এই সিস্টেমের ভেতরে থেকে নিজেদেরকে এবং সন্তানকে আপাতদৃষ্টিতে সমাজ সভ্যতার মাপকাঠিতে সফল দেখতে চান।

আমি এখানে কথা বলতে চাই গড়পড়তা যে কোন পরিবারে একজন সন্তান এবং বাবা-মায়ের মাঝের মূল দ্বন্দ্বের জায়গা নিয়ে।

সন্তান বংশের গতি রক্ষা করে। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সব ধর্মেই পুত্রসন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেয়া হয়েছে। যেহেতু পুরুষের নিজ সন্তান চিহ্নিতকরণের ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবে নেই, তাই পুরুষ তার সম্পত্তি নিজ বংশের হস্তগত রাখতে নারীকে একগামী জীবনে বেঁধেছে এবং অর্থনীতিতে নারীর অধিকারকে অস্বীকার করেছে। নারীর স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে তার স্বামী অর্থাৎ একজন নির্দিষ্ট যৌনসঙ্গীর পরিবারে। ফলস্বরূপ পরিবারে নারীর জন্ম অনাকাঙ্ক্ষিত। মাছের মাথাটা, মাংসের বড় টুকরোটা গেছে পুত্রসন্তানের পাতে। পুত্র এখানে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মোক্ষলাভের অস্ত্র। পুত্র সন্তান উপার্জন করে, সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সের দায়িত্ব নেয় এবং আবারো পুত্র সন্তান জন্মের মাধ্যমে বংশের অস্তিত্ব ও সম্পদ টিকিয়ে রাখে। বিশ্বাস করা হয় পিতা মাতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তানের হাতের মাটি, কিংবা মুখাগ্নি করলে পিতামাতা স্বর্গলাভ করেন। সময়ের সাথে সমাজ সভ্যতায় নারীর কিছু আইনি অধিকার যেমন- ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, উপার্জনের অধিকার অর্জিত হলেও দিনশেষে নারী থেকে গেছে স্বামী শ্বশুরবাড়ির স্থায়ী সদস্য হয়ে। এখনো নারী তার শেকড় বাকড় উপড়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে নিজের সংসার পাতে। কন্যা সন্তানের অর্জিত অর্থ এবং সন্তান তার স্বামী-শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই কন্যাসন্তান আগের মত নগ্ন বৈষম্যের শিকার না হলেও পুত্রসন্তানের সমান অবস্থানে আজো যেতে পারেনি। ‘ধান ভানতে শিবের গীতের মত শোনাচ্ছে’ নিশ্চয়ই।

উপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপট কী বলছে? সন্তানের প্রতি বাবা-মা যে কর্তব্যগুলো পালন করে, তা বিনিয়োগ। শুধুমাত্র বাৎসল্য থেকে কেউ সন্তান জন্ম দেয় না। সন্তানের অর্জিত নাম, যশ এবং সফলতায় পিতামাতা অংশীদার। সন্তানের অপকর্মে পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়। সন্তানের মাঝে পিতামাতা নিজেকে জীবিত দেখতে চায় শতাব্দীর পর শতাব্দী।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিদ্যমান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো রাষ্ট্রকে কোন নাগরিকের একটি মানসম্মত জীবন তো দূর, মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণেও বাধ্য করেনা। তাই পরিবার একজন নাগরিকের প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। পিতামাতা সন্তানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা আশা করে থাকেন, কেউ সর্বোচ্চ বিনিয়োগে, আবার কেউ যৎসামান্য বিনিয়োগেই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে নিজেদেরকে আগের চেয়ে ভাল অবস্থানে দেখতে চান সন্তানের হাত ধরে। সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্ক হয়ে যায় দেনাপাওনার। সন্তান একজন স্বাধীন সত্ত্বা, একথা ভুলে যায় পরিবারগুলো। এই লাভ- ক্ষতির প্যাচালে পড়ে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয় সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য। বাবা-মায়ের দোষগুলো ধরিয়ে দেয়ার অধিকার তাদের থাকে না। সন্তানের চোখে বিদ্রোহ দেখলে বাবা-মায়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং সর্বদা ভিকটিম কার্ড খেলতে থাকে। তারা সন্তানকে খাইয়েছে, পড়িয়েছে, সুখ- সুবিধা দিয়েছে, তাই সন্তানের উচিত আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা এবং পরিবারের জন্য নিজের বাকি জীবনের সমস্ত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে গলা টিপে মেরে ফেলা। এই সন্তানেরা যখন বাবা-মা হয়, তারাও এই পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলে। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির অবদমন নীতিতে তারা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, যখন তাদের  সময় আসে বাবা- মা হওয়ার, তারা এই অবদমন উপভোগ করে। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সন্তান এবং বাবা-মায়ের মাঝে সামন্তনীতিতে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক চলে আসছে।

মানবতাবাদ যখন আমাদেরকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে গণ্য করতে শেখাচ্ছে, তখন সন্তানেরা বাবা-মায়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তুললে, এই পরিবার প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করলে, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা না করে তাদের সাথে সামনাসামনি বসা প্রয়োজন। নিজেদের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসে নিজের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা প্রয়োজন। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবারকে প্রভাবিত করেছে, নাকি পরিবার রাষ্ট্রকে- সে নিয়ে তর্কের চেয়ে বেশি জরুরি পরিবারব্যবস্থার ভুলগুলোকে শুধরে নিয়ে বাবা-মা এবং সন্তানের মাঝে বোঝাপড়ার জায়গা তৈরি করা। সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকে শুরু হোক সহমর্মিতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা। পরিবারে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত হোক। ভাগাভাগি করে নেয়া হোক দায়িত্বগুলো নারী পুরুষ নির্বিশেষে। নিজের স্বপ্ন পূরণে অন্যের স্বপ্নকে বলি না দেয়া হোক। বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ে উভয়ের সমান অধিকার থাকুক, আবার বাবা-মায়ের দায়িত্বও ছেলে-মেয়ে উভয়ের হোক। বাবা মায়ের পরিবার নারীর স্থায়ী  ঠিকানা হোক, নারীও হয়ে উঠুক বংশের প্রদীপ।

চৈতি চন্দ্রিকা: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]