স্বাস্থ্যখাতে দুরবস্থা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু: হতে পারে করোনার চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি
মো. হাবিবুর রহমান।। করোনার এই সংকট মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে কে আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে আসে নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের কথা। এদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা প্রতিবন্ধি তাদের জন্য হুমকি আরো প্রকট। করোনার স্বাস্থ্যগত হুমকি ঠিক যতো প্রকট ঠিক তেমনি এর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিকসহ বহুমাত্রিক হুমকিগুলোও প্রকট। অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও ভেঙ্গে পড়েছে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা। করোনাকালীন কঠিন বাস্তবতায়- নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো করোনা ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট এই বৈশ্বিক মহামারিকে আরো তীব্র করে তুলেছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং সামনের দিনের সম্ভাব্য কঠিন বাস্তবতা মোকাবেলায় আমাদের কতগুলো বিষয় বুঝতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর করোনার প্রভাব বুঝতে প্রথমে আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়টি বুঝা দরকার। কেবল অসুখ না হওয়াকে স্বাস্থ্য বলা যায় না। স্বাস্থ্য মানে হলো শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সুস্থ থাকা। আবার স্বাস্থ্য হচ্ছে নতুন নতুন বাঁধা এবং দুর্বলতার সাথে খাপ খাইয়ে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা। আর জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবারকল্যাণ, রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থা, পুষ্টি, পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানীয় জল, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে সকল দূর্যোগের মতো বর্তমান করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে আছে নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা। বৃদ্ধদের জন্য বিষয়টি আরো জটিল এবং অন্য আলোচনার বিষয়।
বিষয়গুলো একটু ভেঙ্গে ভেঙ্গে চিন্তা করা যাক। যেমন, নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়টি চিন্তা করি। নিরাপদ মাতৃত্ব হলো মাতৃস্বাস্থ্যের ভিত্তি। যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো – গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসবপরবর্তী সেবা, প্রসবের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সেবা, প্রয়োজনে প্রাথমিক, মৌলিক এবং সমন্বিত/সার্বিক জরুরী প্রসূতি সেবা, পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি, মানষিক স্বাস্থ্য, জেন্ডার সংবেদনশীল ও কিশোর-কিশোরীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি নারীর মৌলিক মানবিক অধিকার। অন্যদিকে শিশু স্বাস্থ্যে দুটি অংশ। নবজাতক ও ৫ বছরের নিচে শিশু স্বাস্থ্য এবং ১৮ বছরের নিচে শিশু স্বাস্থ্য। অর্থাৎ কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য। এছাড়া শিশুর বিকাশের চারটি দিক রয়েছে। শারীরিক (পুষ্টি, শরীরচর্চা, সহিংসতা থেকে সুরক্ষা, চিকিৎসা, যত্ন), জ্ঞানগত (খেলাধুলা, শিক্ষা, উৎসাহ ও উদ্দীপনা), আবেগীয় (নিঃশর্ত ভালবাসা, পারিবারিক সহায়ক পরিবেশ, অবহেলা থেকে রক্ষা) এবং সামাজিক/নৈতিক (নিয়মানুবর্তিতা, ভাল ব্যবহার ইত্যাদি)। কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শারীরিক (যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সংক্রামক রোগ থেকে মুক্তি) ও মানসিক স্বাস্থ্য (মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি, মানসিক অবসাদ ও নির্যাতন থেকে মুক্তি ইত্যাদি)। আবার শারীরিক-মানসিক, অবহেলা/আবেগীয়, যৌন নির্যাতন অর্থাৎ যে কোনো ধরণের নির্যাতন নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
উপরোক্ত নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যের বিষয়গুলোর উপর বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাক। করোনা থেকে বাঁচার জন্য লকডাউন বা সাধারণ ছুটিতে বর্তমানে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই ঘরে অবস্থান করছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সংকট তৈরি হয়েছে দুই ভাবে। ঘরের ভিতরে এবং ঘরের বাইরে অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র/হাসপাতাল থেকে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে।
স্বামী সন্তান ঘরে থাকার কারনে নারীর প্রতি কাজের চাপ বহুগুণে বেড়ে গেছে। যারা কর্মজীবী নারী তাদের জন্য চাপ আরো ভয়াবহ। তাকে ঘর এবং কর্মক্ষেত্র দুই দিক সামলাতে হচ্ছে। আবার করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণের অভাব তো আছে। কর্মহীন বা চাকরি হারানো বা অভাবের কারণে এবং হতাশা থেকে অথবা একসাথে দীর্ঘ দিন থাকার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন/ঘরোয়া সহিংসতা (সব ধরণের) আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। শিশু বা নারী ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শিশু বিয়ে হচ্ছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি। কাজ দেয়া কিংবা খাবার দেয়ার নাম করে নারী, শিশু এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। খাবারের অভাবে সবার পুষ্টিহীনতা বাড়ছে বহুগুণে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বাইরে খেলার পরিবেশ নেই এবং বিভিন্ন রকম পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়া শিশুর বিকাশের সমস্ত দিক হুমকির মধ্যে পড়েছে। জেন্ডার বৈষম্যের কারণে কিশোরীরা স্বাভাবিক পরিবেশে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে এই করোনা পরিস্থিতিতে বিষয়টি আরো ভয়াবহ হচ্ছে। শিশুদের বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্য পড়াশুনায় ব্যাঘাত, ঘরে কাজের চাপ, করোনা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতার ভয় – সবকিছু মিলে করোনাকালীন দিনগুলো তাদের জন্য হয়ে উঠেছে চ্যালেঞ্জিং।
এই সংকটকালে বেকারত্বের সাথে সাথে নারীরা পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অর্থ, যানবাহন এমনকি সেববাকেন্দ্রে সেবা প্রাপ্তির অভাবে মানুষ এখন সাধারণ যে কোনো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি, গরীব ও অসহায় পরিবারগুলোতে এই অবস্থা ভয়াবহ। সঠিক চিকিৎসার অভাব, নিয়মিত চেকআপের অভাব, যানবাহন এর অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং গর্ভপরবর্তী সেবা থেকে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গর্ভকালীন সময়ে সহিংসতা, পুষ্টির অভাব, পারিবারিক সহায়ক পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারনে মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার আশংকা দিন দিন বাড়ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সাথে অনিরাপদ গর্ভপাতের হার ভয়াবহ আকারে বাড়তে পারে এবং ইতোমধ্যে বাড়ছে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে করোনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণে দেশের নব্বই শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসূতিসেবা সহ অন্যান্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থেকে মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক সময় সেবাকেন্দ্রে ভর্তি হতে না পেরে রাস্তায় সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটছে। সবমিলে বাংলাদেশে জরুরি মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা ভেঙ্গে পড়েছে।
সম্প্রতি ইউনিসেফ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জরুরি পদক্ষেপ না নিলে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে আরোগ্যলাভ করা সম্ভব এমন সব রোগেই প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী অতিরিক্ত ৬ হাজার শিশু মারা যেতে পারে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় ২০১৯ সালের মার্চের তুলনায় ২০২০ সালের মার্চে সেবাগ্রহণ ২৫% কমেছে। মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিও ব্যাপকহারে প্রায় ১৯% মতো কমেছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সন্তান প্রসব ২০১৯ সালের অক্টেবর-ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ এর জানুয়ারি-মার্চে ২১.২% কমেছে। আবার বর্তমানে বাংলাদেশে হাম ও রুবেলার টিকাদান ক্যাম্পেইন স্থগিত রয়েছে। করোনা মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন কারণে শিশুস্বাস্থ্য ব্যাপক হুমকির মধ্যে পড়েছে। সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ ৪৫% কমে গেলে প্রতি মাসে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যু ৪৪.৭% এবং মাতৃমৃত্যু ৩৮.৬% বড়তে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমান যে অবস্থা বিরাজ করছে, এভাবে চলতে থাকলে, করোনার চেয়েও শিশু ও মাতৃমৃত্যুর বৃদ্ধির হার ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। আমাদের সামনে আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রমনের উদাহরণ আছে। পরিসংখ্যান বলছে, ইবোলার কারণে সেখানে যত মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি নারী ও শিশু মৃত্যুবরণ করেছে প্রসবকালীন মৌলিক সেবা এবং জরুরি নবজাতক সেবা না পাওয়ায়। পাশাপাশি নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন বিপীড়নের ঘটনাও বেড়ে গিয়েছিল ভয়াবহভাবে।
আমরা চলমান অবস্থা বোঝার জন্য আর একটু তথ্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবার সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান এবং এসডিজি অর্জনে পিছিয়ে পড়ার মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। নিপোর্ট এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৬ জন প্রতি এক লক্ষ জীবিত জন্মে যেখানে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা ৭০ এর নিচে মাতৃমৃত্যু নামিয়ে আনা। বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ৫০% যা ২০১৪ এ ছিল ৩৭%। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে ১৩% হারে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বেড়েছে। যা কিছুটা হলেও আশার কথা। তবে গর্ভকালীন সেবার অবস্থা ততোটা উন্নত হয়নি এবং মাত্র ১৮% নিচে গর্ভবতী মায়েরা গর্ভকালীন সময়ে মানসম্পন্ন সেবা পায়। পাশাপাশি, অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অনিরাপদ গর্ভপাতের ঘটনা আমাদের দেশে অনেক বেশি।
শিশু স্বাস্থ্যের অবস্থা যদি দেখি, বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ অনুযায়ী ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার ৪৫ জন প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে, যা ২০১৪ সালে ছিল ৪৬ জন। অর্থাৎ গত প্রায় এক দশকে প্রতি হাজারে মাত্র ১ জন মৃত্যু কমানো সম্ভব হয়েছে। অথচ এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা হলো ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে ২৫ এর নিচে নামিয়ে আনা। ১ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ এবং ২০১৪ অনুযায়ী অপরিবর্তিত রয়েছে অর্থাৎ প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে ৩৮ জন মৃত। আবার নবজাতক মৃত্যু হার বেড়ে গেছে, বিডিএইচএস ২০১৪ অনুযায়ী নবজাতক মৃত্যু ছিল ২৮ জন প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে। কিন্তু বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ অনুযায়ী তা বেড়ে দারিয়েছে ৩০ এ- যা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। অথচ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা হলো নবজাতক মৃত্যুহার প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে ১২ এর নিচে নামিয়ে আনা। এখনও আমাদের দেশে অনেক শিশু বিভিন্ন রোগের টিকা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ থেকে ২৩ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে পরিপূর্ণ টিকাগ্রহণের হার ৮৯% মাত্র (বিডিএইচএস ২০১৭-১৮)।
আমরা যদি বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ এর আলোকে পরিবার পরিকল্পনা এর তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করি, সেখানেও হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের পরে তা বাদ দেয়ার হার আশংকানকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে এই হার ছিল ৩০% যা ২০১৭ এ এসে দাঁড়িয়েছে ৩৭%। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার ১০১৪ এর পর অপরিবর্তিত রয়েছে অর্থাৎ, ৬২%। একই অবস্থা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির অপূরণীয় চাহিদার ক্ষেত্রেও, ২০১৪ সালের পর থেকে অপরিবর্তিত অর্থাৎ ১২%। অধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বেড়ে ছিল মাত্র ৪%। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০১৪ সালের পর অধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪% থেকে ৫২%। হতাশাজনক তথ্য হলো, এখনও মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৬.৩ বছর, যা ২০০৭ সালে ছিল ১৫.৩ বছর এবং প্রথম সন্তান গ্রহণ করেন ১৮ বছর বয়সের মধ্যে। গত দেড় যুগ ধরে মুখে মুখে উন্নতি হলেও তথ্য বলছে ভিন্ন চিত্র। শিশুর ও নারীর পুষ্টি সূচকগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজমান। যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব আর একটি চিন্তার কারণ সবসময়।
উপরোক্ত আলোচনা এবং তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, স্বাস্থ্যখাতে এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের অর্জন অত্যন্ত প্রসংশনীয় হলেও আমরা কোনো এক অজানা বাধায় আর আগাতে পারছি না। আমাদের সব অর্জন যেন থেমে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা উল্টো পথে হাটছি। স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে এই অবস্থা, করোনার মহাসংকটে তাহলে কী হতে চলছে তা সহজে অনুমেয়। করোনার কারণে যত না মানুষ মারা যাচ্ছে কিংবা যাবে, তার চেয়েও অনেক বেশি মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু আমাদেরকে ইতোমধ্যে দেখতে হচ্ছে এবং আরো ভয়াবহ অবস্থা হাতছানি দিচ্ছে। শুধু মৃত্যু নয় মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ যন্ত্রণার বিষয় হলো আমাদের নারী ও কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত অনেকগুলো দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে, হচ্ছে এবং হবেন। যার ফলে, স্বাস্থ্য, পারিবারিক জীবন ও সম্পর্ক এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের বর্তমান শিশুদের তাদের বিকাশের প্রত্যেকটি দিক থেকে পিছিয়ে পরার আশংকা তৈরি হয়েছে। যার ফলে আমাদের একটি প্রজন্ম এবং আগামীর জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো একটি শক্তি আজ হুমকির মুখে। সুতরাং করোনার কারণে নিরাপদ মাতৃত্ব, নারী ও শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যের উপর যে প্রভাব ইতোমধ্যে পরেছে এবং সামনে পরবে তা কোনোভাবে উপেক্ষা করার মতো বিষয় নয়।
এখন প্রশ্ন হলো কেন এই অবস্থা? উত্তরণের উপায় কী? অনেকে বলতে পারেন, করোনা সংকটের কারনে এই অবস্থা। তাহলে, বিগত এক দশকে কেন এই দুর্দশা। আসলে করোনা আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে, আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা আগে থেকে বিরাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা দৃশ্যমান হয়েছে। যার বড় প্রভাব সাধারণ চিকিৎসা সাথে সাথে সব চেয়ে বেশি পরেছে নারী ও শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যের উপর। কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক, দক্ষ চিকিৎসক এর পাশাপাশি আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সামাজিক ও আচরণ পরিবর্তনের জন্য যোগাযোগের (এসবিসিসি) নিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠেনি। হাতে গোনা কিছু মানুষের উপর দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটি চলছে। আর যারা স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তাদের প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু দক্ষতা এবং যোগাযোগের সন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে কিন্তু করোনার এই যুগে এসে আমরা বুঝতে পারছি আমাদের এসবিসিসি-র ঘটতি কোথায়। একই বিষয়ে এত বেশি ভিন্ন ভিন্ন তথ্য এবং সমন্বয়হীনতা আর কখনো আমাদের সামনে এতোটা স্পষ্ট হয়নি।
স্বাস্থ্যসেবার স্বাভাবিক সময়ে করুণ অবস্থা এবং এই করোনা মহামারীকালে মহা করুণ অবস্থার পিছনের কারণগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। মূল কারণগুলো বুঝতে না পারলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিন স্তরে ভাবতে হবে। প্রথমত, স্বাস্থ্য সেবার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মধ্যে প্রথমিক বা মৌলিক দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। সুতরাং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। দূর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে শক্তভাবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ এবং সেবার মান ও সেবাদানকারীর মন মানসিকতা হতে হবে জেন্ডার রেসপন্সিভ এবং কিশোর-কিশোরীবান্ধব, সর্বোপরি হতে হবে মানববান্ধব। রাষ্ট্রের সকল নীতি ও তার বাস্তবায়ন হতে হবে জেন্ডার সমতার ও সাম্যের বিষয়গুলো মাথায় রেখে। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত এসবিসিসি-র দূর্বলতাগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তা কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজ ও পরিবারকে হতে হবে নৈতিক দায়িত্বপালনকারী। জেন্ডার অসমতাসমূহ দূর করে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে নারী, শিশু অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সকলে সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের বাঁধাসমূহ থাকবে না। কারণ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত এবং নীতিমালাগত বাঁধার চেয়ে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য বড় বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক ও পারিবারিক বাঁধাসমূহ। সর্বোপরি, ব্যক্তিকে হতে হবে সচেতন। নিজের স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে এবং অধিকার আদায়ের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক শক্তি তৈরি করতে হবে। তাহলেই কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবর্তন স্থায়ী করা সম্ভব।
শেষ কথা হলো, নারী ও শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবাসহ সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রকে হতে হবে সর্বাধিক দায়িত্বশীল। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে- নিরাপদ মাতৃত্ব, নারী ও শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলোকে। ব্যাক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। আচরণ বিজ্ঞানে বলা হয় মানুষের আচার আচরণ ইত্যাদি বদলানো সবচেয়ে কঠিন। আমরা নিঃসন্দেহে কঠিন সময় পার করছি। করোনাকালীন সময়ে সব কিছু হঠাৎ ঠিক হয়ে যাবে তা আশা করা বোকামি। তবে এ পরিস্থিতিতে নতুন করে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর অবস্থানে থেকে কাজ করতে হবে রাষ্ট্রকে। পাশাপাশি নিরাপদ মাতৃত্ব, নারী ও শিশু এবং কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার এবং করোনা মহামারীর সাথে যুদ্ধে জেতার জন্য পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার তৈরির মাধ্যমে নারী-পুরুষ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা একটি সুরক্ষিত জাতি প্রত্যাশা করতে পারি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]