December 23, 2024
নারী'র খবরদেশফিচার ৩

কর্মজীবী মা-বাবা’র নিশ্চিন্তি আর শিশুর সুন্দর শৈশব সিসিডি’তে

শিশুর জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার ধারণাটি নতুন কিছু নয়। তবু আমাদের দেশে কোন এক অজ্ঞাত কারণে ডে-কেয়ার সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বাবা মা এবং সন্তানদেরও ডে-কেয়ার সিস্টেমের সাথে অভ্যস্ত করানো যায়নি সেভাবে। অথচ একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নারী পুরুষ দু’পক্ষই বাইরে কাজ করছে সমানতালে, সেখানে শিশু দিবাযত্নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। হতে পারে সুস্থ সুন্দর শিশুবান্ধব পরিবেশ, নিরাপত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এই জায়গাটি বিকাশ লাভ করেনি। অথচ ভালো মানের ডে-কেয়ার সন্তানের বাবা মা হবার পরও নারী ও পুরুষের কর্মজীবনকে সচল ও গতিশীল রাখতে সহায়তা করে। পাশাপাশি শিশুর নিশ্চিত বেড়ে ওঠাও সম্ভব হয়। এর জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ, আধুনিক চিন্তা ও তার প্রয়োগ, পরিশ্রম এবং সততা। কেয়ার ফর চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট-সিসিডি, এ রকমই এক স্থান, যেখানে কর্মজীবী বাবা মায়ের সন্তানেরা সুস্থ সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। কীভাবে গড়ে উঠলো সিসিডি? কীভাবে কাজই বা করছে এই কেন্দ্রটি? শিশুরা কেমন থাকছে? বাবা মায়ের প্রতিক্রিয়াই বা কী? সিসিডি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দা আশরাফুন নাহার জানাচ্ছেন তার উদ্যোগের গল্প। সিসিডি’র গল্প। চলুন সিসিডি’কে চিনে নিই। 

২০০৫ সাল থেকে সাংবাদিকতার শুরু। এর আগে ভোরের কাগজের পাঠক ফোরামে লিখে লেখালেখিতে হাতেখড়ি। পরবর্তী পাঁচ বছর চারটি টিভি স্টেশনে কাজ করি। সাংবাদিকতার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আর সমাজের নানা সংকীর্ণতাকে দুমড়ে মুচড়ে ক্যারিয়ারটা যখন একটা পর্যায়ে দাঁড়ালো, তখন আমরা বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ২০১৫ সালে আমাদের ছোট্ট সংসারটাকে পরিপূর্ণ করে ঘরে আসে একমাত্র মেয়ে মেঘমালা। তাকে পেটে নিয়েই চারমাস অফিস করেছিলাম। কিন্তু রাস্তার ঝাঁকিতে মেমব্রেন লিকেজ হওয়ায় অগ্রীম ছুটিতে চলে যাই। জন্মের সময় মেঘ প্রিম্যাচিউর ও ওজনে কম ছিল। আমার নিবিড় পরিচর্যা ওর খুব দরকার ছিল। কিন্তু অফিস ছুটি বাড়াতে রাজি হয়নি। তাই দ্বিতীয়বার না ভেবে ইস্তফা দেই। ইতি টানি দশ বছরের প্রিয় সাংবাদিকতার।

ক্যালেন্ডারের পাতার সঙ্গে বদলায় সময়। মেঘ বড় হয়ে হতে থাকে মেঘমালা। তার সাথে হাসি খেলার ফাঁকে ফাঁকে আমি আমার দুর্দান্ত কর্মজীবন মিস করতে থাকি। কিন্তু মেয়ের জন্য সাংবাদিকতার মতো ঘড়ি ছাড়া জীবনে আর পা রাখিনি। ওর বয়স যখন তিন, তখন সিসিমপুরের একটা প্রজেক্টে কাজ শুরু করি। ফিল্ড ওয়ার্ক খুব বেশি ছিল। অফিস আর বাচ্চা সামলাতে গিয়ে প্রথম কয়েকদিনেই হাঁসফাস হয়ে ওঠে জীবন। তখন স্বামী-স্ত্রী দিন রাত ভাগ করে বাচ্চা পালতে থাকি। এমনকি কাজের চাপ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় মেয়েকে ১৫ দিনের জন্য ফরিদপুরে আমার মায়ের কাছে রেখে আসি। কিন্তু এতে ওর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ভেবে দেখি, এভাবে আগালে হবে না।

এরপর, বাসার কাছাকাছি ডে কেয়ার খোঁজা শুরু করি। কিন্তু ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ভেতরের পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা- সর্বোপরি মানসিকতার দিক দিয়ে কোনটাই মনমতো হচ্ছে না। এ রকম ডে কেয়ারে মেয়েকে দিলে আমি ভেতরে ভেতরে মরে যাবো। আবার না দিয়েও উপায় নেই। তখন আমার মতো শত শত কর্মজীবী মায়ের একই আসহায়ত্ব কিছুটা অনুভব করি। সিদ্ধান্ত নেই এই সেক্টরের উন্নয়ন দিয়েই কাজ শুরু করবো।

আমি আমার সাবেক অফিসের কয়েকজন সহকর্মীর সাথে কথা বলি। সেখান থেকে দু’জন এগিয়ে আসেন, যাদের শিশুবিকাশ নিয়ে কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি তখন আটঘাট বেঁধে নেমে পড়ি। লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সাথে কথা বলি। নিজের এলাকা ছাড়াও অন্যান্য এলাকার ডে-কেয়ারগুলো রেকি করি। ইন্টারনেটে পড়াশোনা করি। সিসিমপুর প্রজেক্টে প্রায় ৫ হাজার শিশুর সাথে আমার সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা এবং সিসিমপুরের দেয়া ট্রেনিং খুব কাজে আসে। আশীর্বাদ হয়ে পাশে দাঁড়ায় নিজের মাতৃত্ববোধ।

শিশু বিকাশের নানা ধাপ নিয়ে কাজের একটা ছক এঁকে ফেলি। গত বছরের ২৮ জুন পার্টনার ও কো-ফাউন্ডারদের নিয়ে, মিরপুরের পূরবীতে চালু করি ‘কেয়ার ফর চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট-সিসিডি’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান। শুরুটা করি ডে-কেয়ার, প্রি স্কুল, আফটার স্কুল ও উইকেন্ড প্রোগ্রাম দিয়ে।

সিসিডির অন্দরসজ্জায় বাহুল্য রাখিনি। বরং চেষ্টা করেছি দেয়ালের রং, আসবাবপত্র ও সাজসজ্জায় প্রশান্ত এবং আনন্দময় একটা আবহ তৈরির। চারপাশ খোলামেলা এবং প্রচুর আলো বাতাসের কথা চিন্তা করেই বাসাটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। নিজেরাই রিসাইকেলড জিনিস দিয়ে ভেতরটা সাজিয়েছি। সব কাজ করেছি মেয়েকে সাথে নিয়েই।

ডে-কেয়ার সুবিধাটাকে আমরা চারভাগে সাজিয়েছি। ফুল টাইম (১২ ঘন্টা), হাফ ডে ( ৬ ঘন্টা), ডেইলি বেসিস (সপ্তাহে কয়েকদিন) এবং ওয়াক ইন সার্ভিস ( ঘন্টা হিসেবে যে কোন দিন)।

প্রথম মাসে শুরুটা হয় দুটো বাচ্চা দিয়ে। পরের মাসেও তাই। আমার পার্টনাররা একটু ঘাবড়ে গেলেও আমি মনোবল হারাইনি। বাচ্চা তেমন না থাকলেও শক্তহাতে সার্ভিসের কোয়ালিটি ধরে রাখি। স্টাফদের চাঙ্গা রাখতে প্রতিদিন নানা আইডিয়া বের করি। সিসিডির প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লষণ চলতে থাকে। আর প্রচুর প্রচারণা চালাই ইন্টারনেটে।

মাসের শেষ দিকে একে একে উঁকি দেয়া শুরু করে নতুন নতুন কচি মুখ। যাদের জন্য আমি ঘর সাজিয়েছি। এরা আমার ওপর আস্থা রেখে নিজেদের শৈশবের মূল্যবান একটা সময় তুলে দিয়েছে আমার হাতে। পরিচর্যার জন্য। ভাবতেই মন বিনম্র হয়ে যায়। দেখতে দেখতে আমাদের সেন্টার ২৪ জন শিশুর কলকাকলিতে ভরে ওঠে।

এখানে আসার পর থেকে অধিকাংশ শিশু একটা নিয়মের মাঝে চলে আসে। সকালের নাশতার পর শুরু হয় প্লে টাইম। এরপর প্রি-স্কুলের পড়াশোনা। মন্টেসরি মেথডে নানা বিষয় হাতেকলমে শেখানো হয়। মাঝে হালকা খাবারের বিরতি। স্কুল শেষে কিছু সময় আবার খেলা। এরপর গোসল ও দুপুরের খাবার। তারপর ঘুমিয়ে পড়া।

বিকেলে কোনদিন তারা ক্লাসে গানের মিসকে জড়িয়ে ধরে আবার কোনদিন কবিতা শিখতে গিয়ে উদাস মুখে ঘুরে বেড়ায়। তবে মুভি দেখা আর ইয়োগা ক্লাসের ব্যাপারে তাদের ব্যাকুলতা চোখে পড়ার মতো। বৈচিত্র্য আনতে শিশুদের জন্য বিভিন্ন দিবসে পাপেট শো-সহ থিমভিত্তিক অনুষ্ঠান করা হয়।

নিজের কাজে লজ্জা নেই বরং তৃপ্তি আছে, এটা  শুরু থেকেই শিশুদের মনে গেঁথে দেয়া হয়। এছাড়া বিনয়, আদব, মানবিকতা, ন্যায় অন্যায়, বন্ধুত্ব, দেশপ্রেম এগুলোও বুনে দেয়া হয় সযতনে।

বাসা হোক বা সিসিডি, সারাক্ষণ চারদেয়ালের মাঝে থাকাটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। তাই শুরু থেকেই আমরা শিশুদের নিয়ে চলে যাই প্রকৃতির কাছে। তারা মন ভরে ছুটে বেড়ায়। ঘাস, পানি আর মাটির স্পর্শ নেয়। অভিজ্ঞতার ছোট্ট ঝুলিটা তারা পূর্ণ করে প্রকৃতি থেকে পাওয়া বিস্ময় আর আনন্দমাখা শিক্ষা দিয়ে।

সিসিডিতে কর্মরত সবার মানসিকতাকে এক সমান্তরালে আনতে প্রতি সপ্তাহে গ্রুমিং হয়। শিশুর পুষ্টি, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও মানবিকতার ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া হয় না। এছাড়া, শিশুর বেড়ে ওঠার নানা দিক জানতে ও জানাতে প্রতি মাসে বাধ্যতামূলক প্যারেন্টস মিটিং করা হয়। পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে নিজের সন্তানকে দেখার জন্য অভিভাবকদের সিসি ক্যামেরার একসেস দেয়া হয়।

উদ্যোক্তা হিসেবে আমার মনে হয়েছে, দেশে ডে-কেয়ারের ধারণাটা এখনও নতুন। অনেকেই ভাবেন, এটা আধুনিক বাবা মা’র বিলাসিতা। অনেকেই ভয় পান পরিবারের সঙ্গে শিশুর দূরত্ব তৈরি হওয়ার। এছাড়া ডে-কেয়ারের জন্য কোন ট্রেড লাইসেন্স নেই। অনেক টাকার বিনিয়োগ লাগলেও ব্যবসার ধরণ মুনাফাভিত্তিক না হওয়ায় কোথাও থেকে সাপোর্ট পাওয়া যায় না। তাই এই ব্যবসায় খরচ তুলে আনাই কঠিন। কিছুদিন আগে সরকার ডে-কেয়ারের ব্যাপারে জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন, ২০১৮’র খসড়া প্রণয়ন করেছে। তবে সেখানে ডে কেয়ার ওনারদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন কথা নেই। নারীর কর্মক্ষেত্রে ফেরা নিশ্চিত করতে উন্নত দেশে যেখানে সরকার ডে কেয়ারগুলোকে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে, সেখানে আমাদের দেশে এখনও ডে-কেয়ারের গুরুত্ব নিয়েই নানা বিভ্রান্তি দেখা যায়।

সিসিডিতে আসা কর্মজীবী মায়েরা প্রায়ই বলেন, ‘ক্যারিয়ারের এত দূরে এসে চাকরি ছাড়াটা খুব কষ্টদায়ক। সিসিডি সেই স্বপ্ন বিসর্জন হতে দেয়নি’। আবার ভীষন দুঃশ্চিন্তায় থাকা মা কয়েক মাস পরে হাসি ছড়াতে ছড়াতে বলেন, ‘আপনাদের এখানে এসে বাচ্চাটা কথা বলা শিখেছে। আমি তো আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম’। আমার নিজের মেয়ের মতো বাসায় একা একা থাকা শিশুগুলো সিসিডিতে এসে ভাই-বোন খুঁজে পায়, বন্ধু পায়। খেলাধুলা, মান-অভিমান, মারামারি, ভালবাসা, ছুটে বেড়ানো এসব কিছুর মধ্যে সত্যিকারের একটা শৈশব পায়।

এক বছরের মাথায় উত্তরায় সিসিডি’র আরেকটা শাখা হয়েছে। অনেক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

সিসিডি এখন অনেক মায়ের স্বস্তি ও নির্ভরতার জায়গা। মায়েদের এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ আর ভাবনাহীন করতে সিসিডি কাজ করে যাবে শেষদিন পর্যন্ত। স্বপ্নের সাথে কি আপোষ হয়?

মাতৃত্ব নারীর দুর্বলতা নয়, শক্তি।

কেয়ার ফর চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট-সিসিডি: ঠিকানা- মিরপুর সেন্টার : ১/১, অ্যাটিভো, প্রেস্টিজ, পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা।

উত্তরা সেন্টার : বাসা-২৯, রোড- ৯, সেক্টর-৪, উত্তরা, ঢাকা।