স্ত্রীকে ‘বশে’ রাখবেন, নাকি সম্মান করবেন- সিদ্ধান্ত আপনার
আফরোজ ন্যান্সি।। একটা সময় পর্যন্ত আমার মনে হতো মানুষ কিভাবে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করে! চেনা নাই জানা নাই একজন নারী বা পুরুষকে হুট করে বিয়ে করে ফেলে যারা, তারা কি মানুষ না এলিয়েন! মনে হতো ভালোবাসা না থাকলে সেই বিয়েটা ক্যামন বিয়ে আর সেই বিয়ে সারাজীবন ধরে মানুষ কীসের টানে বয়ে বেড়ায়!
অনেক পরে আমি রিয়ালাইজ করতে পারলাম যে রিলেশান ম্যারেজ কিংবা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ আসলে ম্যাটার করেনা। সম্পর্কগুলো টিকে থাকে মূলত পারস্পরিক সম্মানবোধের ওপর। টিনএজ বয়সে কিংবা যুবক বয়সে কারো চেহারা দেখে কিংবা কথায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়াটাকে ভালোবাসা বলি আমরা ঠিকই কিন্তু শুধু সেই ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে দু’চার বছর ভালোভাবে কাটিয়ে দেওয়া গেলেও একটা গোটা জীবন পার করা সম্ভব হয়না। একটা জীবনের ভাগিদার যে হবে সে যদি আপনাকে সম্মান না করে কিংবা আপনি যদি তাকে সম্মান না করেন তাহলে ভালোবাসাটা খুব বেশি দিন মধুর হয়ে থাকবেনা, থাকেনা। সম্মানবোধের অভাবে ভালোবাসাটা একটু একটু করে তিক্ত হতে থাকে। চারাগাছে যেমন জল দেওয়া দরকার হয় তেমনি আপনার সম্পর্কেরও পরিচর্যা দরকার আর সেই পরিচর্যাটার নামই হলো সম্মান।
আমার বিবাহিত কলিগদের দেখি, তাদের গল্প আড্ডার একমাত্র পছন্দের টপিকই হলো তাদের নিজ নিজ বৌ এর বদনাম করা। কেউ কেউ আবার বেশ গর্ব করে বলে যে, “অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি বাচ্চা কানতেছে পরে বৌ রে দিলাম এক থাপ্পড়।” এই ঘটনায় বাহবা দেন অনেকে। হোক প্রেমের বিয়ে কিংবা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, যে লোকটা বাচ্চা কেন কাঁদলো এই কারণে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন তিনি তার স্ত্রীকে সম্মান করেন না বলেই এমনটা করেন আর তার স্ত্রীও ওই মুহুর্ত থেকে তার প্রতি সমস্ত সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘদিন প্রেম করে বিয়ে করা আমার বান্ধবী আফসোস করে সেদিন বলছিল, রাতে ওয়াশরুমে গেছে দুই মিনিটের জন্য এর মধ্যে দেড় বছরের মেয়ে জেগে উঠে কান্না শুরু করছে। তার স্বামী ঘুম থেকে জেগে তাকে মেজাজ খারাপ করে বলতেছে “ক্যামন মা হইছো ওয়াশরুমে গিয়া বইসা থাকো আর মেয়ে কাঁদতে থাকে?” স্বাভাবিকভাবেই এরকম ঘটনার পরে দীর্ঘদিন প্রেম করে বিয়ে করা মানুষটাকে অচেনা মনে হয়, অনীহা তৈরি হয় তার প্রতি। অনেককেই দেখি বন্ধুদের সামনে, পরিবারের সামনে এমনকি বাইরের মানুষের সামনে স্ত্রীকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলে এটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে স্ত্রীর উপর তিনি খুব কর্তৃত্ব ফলান। এতে করে তিনি নিজেকে কর্তাস্থানীয় ব্যাক্তি বলে জারি করলেও অন্যের কাছে নিজেকে আসলে ছোটই করেন আর সঙ্গীর কাছেও নিজের সম্মানের জায়গাটা হারান।
প্রতিদিনের এমন অসংখ্য ছোট ছোট মিসবিহেভের ঘটনার ফলাফলস্বরূপ দিনশেষে সম্পর্কগুলো পারস্পরিক সম্মানবোধ হারিয়ে পরিচর্যাহীন এক একটা ডাস্টবিনে পরিণত হয়। যে ডাস্টবিন নোংরা আর দুর্গন্ধের উদগীরণ ছাড়া ভালো কিছুই দিতে পারেনা। আর পারস্পরিক সম্মানবোধহীন এইসব ডাস্টবিনে যে সন্তানরা বড় হচ্ছে তারা কি পরবর্তী জীবনে তার সঙ্গীকে সম্মান করতে পারে!
আমি এক নয় বছরের বাচ্চাকে চিনি যে কিনা তার মাকে এবং মায়ের পরিবারের কোনো লোকের সাথেই ভালো আচরণ করেনা। উল্টো তার মা যদি তার মামার বাড়ির আত্মীয়কে কোনো উপহার টুপহার দেয় তাহলে শিশুটি তার বাবার কাছে নালিশ করে মাকে গালি শোনানোর জন্য। একটা নয় বছরের কোমলমতি শিশু এই নোংরামোটা কোথায় শিখলো? পরিবারের বাইরের কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই নয়! অন্যদিকে একটা চমৎকার লেখা পড়েছিলাম যেখানে একজন ব্যাক্তি বলে যে সে তার জীবনে সবথেকে বেশি ভালোবাসে তার বাবাকে কেননা তার বাবা তার মাকে সম্মান করে, ভালোবাসে। আফসোস আমাদের বেশিরভাগ সন্তানরাই এরকম করে ভাবতে বা বলতে শেখে না। বুঝতে শেখার পর থেকে যে শিশুটি দেখেছে তার বাবা তার মাকে সম্মান করে না, সেই শিশুটি তার মাকে সম্মান তো করবেই না, বরং বড় হবার পর নারীজাতির কাউকেই সে সম্মান করতে পারবে না। একবার একজন খুব গর্ব করে গল্প করছিলো যে ‘‘আমার বাবা সারাজীবনে একবারই আমার মা’রে থাপ্পড় মারছিলো আর সেইটাও আমার জন্য। জীবনে আর কোনোদিন আমার মায়ের গায়ে হাত তোলে নাই’’। আমি খুব অবাক হলাম এটা ভেবে যে আমাদের সন্তানদের কাছে কত স্বাভাবিকভাবেই না এই ম্যাসেজ যাচ্ছে যে তার বাবা ইচ্ছে করলেই তার মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে এক বা একাধিকবার। একবার মাত্র হাত তুলছে এটা নিয়ে গর্বও করতে পারে আমাদের সন্তানরা!
নিজেদের জন্য না হোক অন্তত আপনার ঔরসজাত সন্তানকে একটা সুন্দর শৈশব দেওয়ার জন্য, একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য হলেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। যে মানুষটা দুই তিন ঘণ্টা ধরে চুলার আগুনে গরমে ঘেমে আপনার জন্য আপনার পছন্দের খাবার রান্না করে আপনার সামনে খাবারের থালা সাজিয়ে দিলো,তাকে “গ্লাসে ঠান্ডা পানি দেওয়া হলো না ক্যানো” এই প্রশ্ন না করে নিজেই ফ্রিজ থেকে পানি বের করে আনতে শিখুন। ২৪/৭ যে মা তার শিশু সন্তানের টেইক কেয়ার করছে সে যদি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে আর মাঝরাত্তিরে সন্তানের ডায়াপার চেইঞ্জ করতে উঠতে না পারে তার সাথে মিসবিহেভ না করে নিজেই সন্তানের ডায়াপার চেইঞ্জ করে দিন। তরকারিতে একদিন লবণ কম হলেই রক্তচক্ষু দেখাতে নেই এতে করে তার মনে আপনার জন্য সম্মানের জায়গাটা নষ্ট হয়। এইসব ছোটখাটো অসহিষ্ণুতার ফলে হয়তো আপনার স্ত্রী আপনাকে প্রতি পদে পদে ভয় পেয়ে চলে, একটা কথা বলার আগে, একটা কাজ করার আগে দশবার ভাবে যে এই কথা বললে ঝাড়ি খেতে হবে কিনা, আপনি হয়তো মনে মনে আনন্দের জোয়ারে ভাসেন এই ভেবে যে স্ত্রীকে চরম বশে রাখা গেছে। বাঙালি পুরুষ হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করছেন এমন একজন বাধ্য স্ত্রী পেয়ে। আফসোস! আপনি আপনার স্ত্রীর মনের খবর রাখেন না। মনে মনে সে আপনাকে কতখানি ঘৃণা করে তা যদি জানতে পারতেন তাহলে হয়তো দুঃখে আত্মহত্যা করে বসতেন।
সবশেষে একটা ঘটনা বলি। এক লোক প্রায়ই ছোটখাটো ইস্যুতে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনি কি রাস্তাঘাটে যে কোন অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করেন কিংবা মারপিট করেন?’’ সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘রাস্তাঘাটে কেন মারপিট করবো?’’ আমি বললাম, ‘‘তাহলে বৌ’কে মারেন কেন?’’ সে খুব গর্বিত একটা ভাব নিয়ে বললো, ‘‘বৌ তো আমার ঘরের মানুষ!’’
শুধু ইনিই না, যারাই বৌ পেটান তারা প্রত্যেকেই এরকমটা ভাবেন- বৌ তো আমার কাছের লোক, আমার অধীনস্ত, তাছাড়া বাইরে গিয়ে মারপিট করলে পাল্টা মার খেয়ে আসারও ভয় থাকে। কিন্তু বৌ’কে একতরফা মারা যায়, শক্তিতে সাহসে সে পেরে উঠবে না জেনে। অথচ হওয়ার কথা ছিলো সম্পূর্ন বিপরীত। ঘরের মানুষটির প্রতিই আপনার সবথেকে বেশি যত্নশীল হওয়া উচিৎ ছিল। আপনার ভালো-মন্দে, বিপদে-আপদে যে মানুষটা আপনার পাশে থাকছে তাকেই আপনার সবথেকে বেশি কেয়ার করার কথা ছিল। যতই আপনি মুখেমুখে নারীজাতির গুষ্ঠি উদ্ধার করেন না কেন একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে সংসারে নারীরা খুব অল্পে খুশি হতে জানে। একজন পুরুষ সুন্দরী শিক্ষিত উপার্জনক্ষম রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ সচেতন স্ত্রী পেয়েও অসুখি থাকতে পারেন কিন্তু একজন নারীর সুখি হতে এত এত কিছু দরকার হয়না। নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বাঁচতে পারলেই একজন নারী খুশি মনে আপনার চার দেয়ালের ঘরটাকে স্বর্গ বানিয়ে দেবে। তবু যে পুরুষ বলে, সবকিছু করেও বৌয়ের মন পাইনা, হয় সে মিথ্যে বলে নতুবা সে নিজেই জীবনসঙ্গী হিসেবে অযোগ্য।
নারী প্রকৃতির মতো সহজ এবং সুন্দর। এবার আপনি আপনার যত্ন, ইতিবাচক চিন্তা আর শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে তাকে আরো সুন্দর করে তুলবেন নাকি অশ্রদ্ধা, অসম্মান করে তার মনে আপনার জন্য ঘৃণার ডাস্টবিন তৈরি করবেন সেই দায়িত্ব আপনার।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]