December 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘দা রেইপ অফ দা লক’ এবং আমাদের সমাজ

শেখ তাসনুভা তাসনিম।। আঠারো শতকের প্রথম সারির দিকের এবং সর্বকালের সেরা কবিদের মধ্যে একজন হলেন কবি আলেকজান্ডার পোপ। তিনি একাধারে ছিলেন একজন ইংরেজ কবি, সাহিত্য সমালোচক এবং অনুবাদক। “দা রেইপ অফ দা লক”, “দা ডান্সিয়াড”, “অ্যান এসে অন ক্রিটিসিসম”সহ আরো অনেক অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তিনি, যার মধ্যে অনেকেই হয়তো “দা রেইপ অফ দা লক” এর নাম শুনে থাকবেন।

এটি মূলত একটি মোক হিরোয়িক বা মোক এপিক জাতীয় কবিতা। এটি লেখা হয় আঠারশ’ শতাব্দীর শুরুর দিকে। মোক হিরোয়িক বলতে বোঝায় যেখানে সাধারণত মূল চরিত্রের হিরোইক কোয়ালিটিগুলোকে ব্যাঙ্গ করা হয়, অর্থাৎ, মূল চরিত্র যা করছে সেটা মোটেও আহামরি কিছু না বরং হাস্যকর কিন্তু সেটাকে উপহাস করে খুব বড় বা মহান কিছু বোঝানো হয়। মোক হিরোইককে স্যাটায়ার বা প্যারোডিও বলা হয়ে থাকে। তো এই কবিতার মূল বিষয়বস্তু হল, ব্যারন নামের এক যুবক, যে কিনা বেলিন্ডা নামে এক ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ের এক গোছা চুল কেটে ফেলে! এখন কেন ব্যারন সেই চুল কেটেছিল তার ব্যাখ্যায় পরে যাচ্ছি। আগে কবিতাটি নিয়ে কিছু বলা যাক।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে পোপ শুধুমাত্র ব্যারনের এই মহান কাজকেই ব্যঙ্গ করেন নি, তিনি ওই সময়ের ইংল্যান্ডের চিত্র, নৈতিক অবক্ষয়, অ্যারিস্টোক্রেট অর্থাৎ অভিজাত পরিবারবর্গ, তাদের সমাজ, সেই সময়ের মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রতি ঝোঁক এবং সর্বোপরি বেলিন্ডার এক গোছা চুল কাটার মতো ছোট একটা ঘটনাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়াকে ব্যঙ্গ করেছেন। ‘‘রেইপ অফ দা লক” কবিতাটি আলেকজান্ডার পোপ সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছিলেন, যেখানে শুধুমাত্র চরিত্রের নামগুলো কাল্পনিক ছিল, কিন্তু চরিত্রের মানুষগুলো ছিল আসল।

পোপের বন্ধুমহলে দু’জন ছিলেন, এক হলেন অ্যারাবেলা ফারমোর এবং লর্ড পেত্রে। ফারমোরকে বেলিন্ডা চরিত্রে এবং পেত্রেকে ব্যারনের চরিত্রে দেখা যায়। লর্ড পেত্রে ফারমোরের মাথার এক গোছা চুল কেটে ফেলেন। এর জের ধরে তাঁদের দুই পরিবারের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয় যদিও তার আগ পর্যন্ত তাঁদের সম্পর্ক ভালো ছিল। পরবর্তীতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পোপ তার এক বন্ধুর পরামর্শে লিখে ফেলেন “রেইপ অফ দা লক” স্যাটায়ারটি। নাম শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন যে রেইপ অর্থাৎ ধর্ষণ করা হয়েছে সেই চুল এর গোছা কে!

সেই সময়ে মেয়েরা নিজেদের সৌন্দর্য, পোশাক আশাক নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতো। নিজেদের পরিপাটি রাখা, লম্বা সময় নিয়ে সাজসজ্জা করা এবং ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করানো ছাড়া তাদের জীবনের আর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো না। কে কয়টা ছেলের থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাচ্ছে সেটা গণনাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এবং সেই প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেয়াটা তাদের বিশেষ ক্রেডিট ছিল। সেই সময় চুল ছিল মেয়েদের সৌন্দর্যের অপরিহার্য অঙ্গ, সেই কারনেই বেলিন্ডার চুলের গোছা কাটার ঘটনাকে ধর্ষণের সমান বলে মনে করা হয়েছে। বেলিন্ডার মনে হয়ছে সে এই ঘটনা তার “ভারজিনিটি” হারানোর সমান! এই অতি ক্ষুদ্র একটা ব্যাপারকে এত বড় করে দেখানোকেই পোপ ব্যঙ্গ করেছেন তার কবিতায়। সাথে আরও ব্যঙ্গ করেছেন সেই সমাজকে যাদের গুরুতর সমস্যার এতই অভাব যে এই তুচ্ছ ঘটনার জন্য তাদের বিবাদের সৃষ্টি হয়।

এবার আসি মূল কাহিনীতে, বেলিন্ডা যে কিনা কবিতার নায়িকা, সকালে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে ওঠে। সে দেখে এরিয়েল নামের একটা স্পিরিট তাকে বলছে, সে অতীব সুন্দরী, লাস্যময়ী একজন নারী যার সৌন্দর্যের জুড়ি মেলা ভার। খুব শীঘ্রই তার সাথে একটা অঘটন ঘটতে চলেছে। কিন্তু সেটা কোথায় বা কীভাবে সেটা বলে না। তারপর বেলিন্ডা নিজেকে তৈরি করে লম্বা সময় নিয়ে। তার এক একটা প্রসাধনী যেন তার এক একটা অস্ত্র, যেগুলো দিয়ে সে তৈরি হচ্ছে কোন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। তার প্রসাধনীর পাশে একটা বাইবেলও শোভা পায়। যেন সেই বাইবেলও তার প্রসাধনীর অংশ যা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই ঈশ্বরসৃষ্ট পৃথিবীটাই তার সেই যুদ্ধমঞ্চ। পাউডার দিয়ে একদম সাদা করে ফেলা মুখে অতিরঞ্জিত লাল রঙ মেখে সে নিজেকে আয়নায় পূজা করে।

তারপর সে একটা সোশাল ইভেন্ট এ যায়। সেখানেও সে নিজেকে অন্য সবার থেকে সুন্দরী ভাবতে থাকে। সেই ইভেন্টে ব্যারন উপস্থিত ছিলো যে সুন্দর জিনিস সংগ্রহ করতো। যা তার চোখে সুন্দর, তাই সে সংগ্রহ করে রাখতো। সেই ব্যারন বেলিন্ডার চুলের এক গোছা কাটার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তার মতে বেলিন্ডার চুলের গোছাটাই তার সংগ্রহের সেরা জিনিস হতে পারে কারণ বেলিন্ডার সোনালি চুল অনেকের ঈর্ষার কারণ। ব্যারন সেই চুলের গোছা পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে কায়মনে প্রার্থনা করে। শুধুমাত্র একটা চুলের গোছা পাওয়ার জন্য ব্যারনের এমন কার্যকলাপ পোপের লেখনীতে হাসির উদ্রেক করে।

তারপর ব্যারন আর বেলিন্ডা “অম্ব্রে” নামে একটা কার্ড গেম খেলা শুরু করে। পোপ এমনভাবে খেলাটির বর্ণনা দেন যেন তারা আসল যুদ্ধমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে। যেন জীবন মরণের প্রশ্ন শুধুমাত্র এই খেলাকে ঘিরে। একই সাথে পোপ সেই অভিজাত সমাজকেও ব্যঙ্গ করেন একটা কার্ড গেমকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার জন্য। অবশেষে বেলিন্ডা জিতে যায় এবং উদযাপন শুরু করে। এরপর ক্লারিসা নামের আরেকজন যুবতী ব্যারনকে কাঁচি এগিয়ে দেয় বেলিন্ডার চুলের সেই গোছা কাটার জন্য। ব্যারন সেই চুল কেটে ফেলে এবং বেলিন্ডা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। পরবর্তীতে বেলিন্ডা সেই চুলের গোছা উদ্ধারের চেষ্টা করে, সেটা আর পাওয়া যায় না।

এবার আমাদের সমাজের দিকে একটু তাকানো যাক। আমরাও কি একই কাজ করছি না? সুন্দরের মাপটা আমরা কীভাবে করছি? আমাদের সমাজে সৌন্দর্যের মাপকাঠিটা ঠিক কী? যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ফরসা মানেই সুন্দর। অনেক সময় একটা মেয়ে ফরসা হলে আমরা তার অন্য যোগ্যতা বিচার করারই প্রয়োজন মনে করি না, কারণ আমরা ধরেই নেই সেই মেয়ের বিয়ে হবেই কারণ সে সুন্দরী। তাই তার আর কোন যোগ্যতা না থাকলেও চলবে। আবার একটা কালো মেয়ের হাজার যোগ্যতা থাকলেও, তার বিয়ে নিয়ে তার আশেপাশের লোকজন চিন্তায় পড়ে যায় কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে এই ভেবে। শুধুমাত্র “সোশাল স্ট্যান্ডার্ড” অনুযায়ী সুন্দরী না হওয়ার কারনে কত কালো মেয়ে হীনমন্যতায় ভোগে, ডিপ্রেশনে ভোগে।

আবার কিছু সেলার থাকে তারা ফরসা হওয়ার ক্রিম বিক্রি করে যেগুলো মাখলে রাতারাতি ফরসা হওয়া যাবে এমন প্রতিশ্রুতি তারা দিয়ে থাকে। স্কিন কেয়ার করা এক জিনিস আর রাতারাতি ফরসা হতে চাওয়া আরেক জিনিস। আপনার স্কিন আপনি কোমল রাখতে চান, দাগহীন রাখতে চান, ব্রনমুক্ত রাখতে চান, সর্বোপরি ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জলতা বজায় রাখতে চান, হ্যাঁ, তার জন্য অবশ্যই আপনি স্কিন কেয়ার করতেই পারেন। কিন্তু নিজের স্বাভাবিক রঙের থেকে দুই তিন শেড এমনকি ছয় সাত শেড পর্যন্ত ফরসা হতে গিয়ে মুখে যা তা মেখে নিজের ত্বকের ক্ষতি করাটা অবশ্যই স্বাভাবিক না। এই ক্রিমগুলোতে ক্ষতিকারক উপাদান থাকে জেনেও এই ক্রিমগুলো মানুষ বিক্রিও করে আবার সেগুলো কেনাও হয় প্রচুর পরিমানে। একটা মেয়ে কতোটা ডেস্পারেট হলে নিজের ত্বকের ভালমন্দ বিচার না করেই এগুলো ব্যবহার করা শুরু করে। তার কারণ ছোট থেকেই তো তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে “ফরসা মানেই সুন্দর”।

শুধু আশেপাশের সমাজ না, মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও ঠিক এই ধরণের কাজ করে। অনেক প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়, একটা মেয়ে কালো বলে তার বিয়ে হচ্ছে না, ভালো কোথাও চাকরি হচ্ছে না, আবার সেই প্রসাধনী মেখে ফরসা হয়ে গেলে অনায়াসেই তার বিয়ে হচ্ছে, চাকরি হচ্ছে। এভাবে সমাজেই এই সৌন্দর্যের মাপকাঠির ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

এই কবিতার সাথে আমাদের সমাজের চিত্র মেলানোর আমার একটাই কারণ ছিল। সেটা হলো ক্লারিসা নামের সেই যুবতীর শেষ বক্তব্য- যেটা তার বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দেয়। কবিতাটির শেষ অধ্যয়ে ক্লারিসার সেই বক্তব্যের মূলভাব হল, একটা সমাজ যেভাবে একজন নারীর সৌন্দর্যের প্রশংসা করে এবং সম্মান করে, ঠিক তেমনভাবেই তার বুদ্ধিবৃত্তিকে কেন করে না? কোনরকম নৈতিক গুণাবলি না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রূপের কারণে একটা মেয়েকে কেন angel বা দেবদূত এর সাথে তুলনা করা হবে? সে আরো বলে, মেয়েরা বুদ্ধিগত দিক থেকে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট কারণ তারা একমাত্র যে কাজটা করতে পারে, সেটা হল সুশ্রী থাকা যেটা তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যেহেতু সৌন্দর্য জিনিসটা স্বল্প সময়ের জন্য, কাজেই বিদ্যা বুদ্ধির মতো স্থায়ী কিছুরই প্রশংসা করা উচিৎ। ব্যারনের হাতে কাঁচি তুলে দেয়ার পেছনেও তার এই কারণটাই ছিল। সে দেখাতে চেয়েছিল একটা চুলের গোছা আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মানুষের জীবনে থাকে যেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানো আরো বেশি জরুরি।

সর্বোপরি, যে জিনিসটা আপেক্ষিক, অস্থায়ী সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সমাজের এই ব্রেইন ওয়াশ থেকে নিজেকে বের করতে হবে সবার আগে। নিজের ওপর আস্থা তৈরি করাটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]