সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়
সৈয়দা সুমাইয়া ইরা।। সমকামিতা কোন যৌন বিকৃতি নয়, অপ্রাকৃতিকও নয়। এটা নরমাল সেক্সুয়াল ভেরিয়েশন। যদিও বিজ্ঞানীরা এখনো সমকামী হওয়ার প্রাকৃতিক কারণ জানতে পারেননি, তবে প্রাণি জগতে পনেরশ’র বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার প্রমান পেয়েছেন। এক সময় মনোবিজ্ঞানীরা সমকামকে মানসিক অসুস্থতা বলতেন, কিন্তু আধুনিক মনোচিকিৎসকরা বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় একমত হন যে, সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়, যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।
১৯৭০-র পর থেকে বিশ্বজুড়ে বহু স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং আচরণগত-সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ সমকামিতাকে মানব যৌন অভিমুখীতার একটি স্বাস্থ্যকর প্রকরণ হিসেবে দেখেন, যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ একে অসুস্থতা হিসেবে বহাল রাখেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মনোরোগ সংস্থা সমকামিতাকে অসুস্থতার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এর কিছু মাস পরে মার্কিন মনোচিকিৎসক সমিতি মানসিক অসুস্থতা হিসেবে সমকামিতার সংজ্ঞাকে বাতিল করে। মার্কিন মনোচিকিৎসক সমিতির প্রতিনিধি কাউন্সিল ১৯৭৫ সালে এবং এরপর অন্যান্য স্বাস্থ্য ও মনস্তত্ববিষয়ক বৃহত্তর সংস্থাগুলো ওই নতুন সংজ্ঞা অনুসরণ শুরু করে, যার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯০ সালে মানসিক বিকৃতির তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাতিল করে দেয়।
সম্প্রতি আমি একজন সমকামী ব্যাক্তির সাথে কথা বলে জেনেছি সে নাস্তিক হয়েছে, কারণ ইসলাম ধর্মে সমকাম পাপ আর এটি শাস্তিযোগ্য দণ্ডনীয় অপরাধ এইজন্য। যেহেতু সে সমলিঙ্গের ব্যাক্তির সাথে যৌনসম্পর্ক করে পাপ করছেই, তার চেয়ে সে নাস্তিক হয়ে যাওয়াটাই সে বেটার মনে করসে!
এটা কি আসলে কোন সমাধান! মুখে নাস্তিক হলেও তার মনে কি সারাক্ষণ অপরাধের অনুভূতি থাকবে না? সবসময় কি মনে হবে না যে সে পাপ করছে! মরে গেলে জাহান্নামে যাবে!
কোরআনে আছে, ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি লূত (আঃ) কে প্রেরণ করেছিলাম। যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা চরম অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার কাজ করছো যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বে কেউ কখনো করেনি। তোমরা কামপ্রবৃত্তি পূরণ করার জন্য মেয়েদের কাছে না গিয়ে পুরুষদের কাছে যাচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী জাতি।” [সূরা আ’রাফ(৭): ৮০-৮১]’
আর ইহুদি মিথে সডোম ও গোমোরাহ নামের দুটি শহরের বিবরণ আছে, যে শহর দুটি ধ্বংস করেছিল হিব্রু ঈশ্বর কারণ সেই শহরগুলোয় যে মানুষগুলো বাস করতো তারা খুবই খারাপ প্রকৃতির ছিল। এই দুটি শহরেই একজনই মাত্র ভালো মানুষ ছিলেন, যার নাম ছিল লট। ঈশ্বর লটকে সতর্ক করতে দুজন দেবদূতকে পাঠিয়েছিলেন একটি নির্দেশ দিয়ে, যত দ্রুত তার পক্ষে সম্ভব সে যেন তার পরিবারসহ সডোম শহর ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যায়। লট ও তার পরিবার পাহাড়ের উদ্দেশ্যে শহর ছেড়ে বের হয়ে যায়, ঠিক তারপর ঈশ্বর সেখানে আগুনের আর জ্বলন্ত পাথরের বৃষ্টিপাত ঘটান। লট ও তার পরিবারের সব সদস্যদের বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তারা যেন পিছু ফিরে না তাকায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লটের স্ত্রী ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন। তিনি পেছন ফিরে তাকিয়ে এক পলক দেখতে চেয়েছিলেন। সুতরাং ঈশ্বর তাকে দ্রুত লবনের একটি স্তম্ভে পরিণত করেছিলেন, কিছু মানুষ এখনও দাবি করেন যে চাইলে আপনি সেখানে এটি আজও দেখতে পারবেন।
কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ দাবি করেছিলেন যে তারা প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন যে একটি বিশাল ভূমিকম্প সেই এলাকাটিকে ধ্বংস করেছিল, প্রায় ৪০০০ বছর আগে যেখানে সডোম ও গোমোরাহ অবস্থিত ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
দু’টো কাহিনীতে মিল পাওয়া যায়। সে সময়ের একটা ভূমিকম্পের অলিপিবদ্ধ গল্প অশিক্ষিত মানুষের মুখেমুখে অতিরঞ্জিত আকারে ছড়িয়ে গিয়ে একটা মিথ তৈরি হয়ে যায়। আবার কোরআনে বর্ণিত লূত (আঃ) এর কাহিনীর সূত্র ধরে মুসলিম রাষ্ট্র সমকামকে পাপ হিসেবে চিহ্নিত করে আর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমাদের দেশে সমকামী অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত, তাদের হয়তো নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হয়, নাহলে অভ্যস্ত হতে হয় ‘ক্লোসেটেড গে’ হয়ে বিবাহিত জীবনে।
আরেক শ্রেণি আছেন, যাদের তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয়, আসলে লিঙ্গের কি কোন ‘প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয়’ হয়? প্রায় সকল ট্রান্সজেন্ডাররা (রূপান্তরিত লিঙ্গ) সমাজে, পরিবারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হাসি ঠাট্টার পাত্রে পরিণত হোন, তাদের ভিন্ন দেহে আটকে থাকে অচিন মনের মানুষ। শরীরে পুরুষ অথচ মস্তিষ্কে নারী। তারা একসময় বাধ্য হোন হিজড়ে সম্প্রদায়ে যোগ দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]