নারীভারত: প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে
মাসকাওয়াথ আহসান।। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস বিজ্ঞানের অনেক জটিল সমীকরণ সহজেই সমাধান করতে পারলেও; নারী রহস্যের কোন সমাধান করতে পারেননি। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নারীকে বুঝতে এতোই ঝামেলা হয়েছিলো যে, তিনি বিয়ের আগের কিছু লিখিত শর্তে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেন তার প্রেমিকাকে দিয়ে।
এর কারণ হচ্ছে নারী হচ্ছে ধরিত্রীর মতো সুন্দর অথচ জটিল একটি বিষয়। এই ধরিত্রীর অপার সৌন্দর্য; অক্সিজেন হাওয়া, সোন্নত পাহাড়, উদার সমুদ্র, আশ্রয়ের মরুদ্যান যেমন আছে; তেমনি ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’ কিংবা ভূমিকম্প আছে। এই ধরিত্রী যেমন সুন্দর; তেমনি ভয়ংকর এক ব্যাপার।
ধরিত্রীর আচার আচরণ পৃথিবীর নানা জায়গার ভৌগলিক বৈচিত্রের মতোই বিচিত্র আনন্দ ও রাগময়।
খান আতার কন্ঠে ও অভিনয়ে ‘এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে’ গানটির চিত্রায়নে যেমন দক্ষিণ এশীয় নারীর একটি ধ্রুপদী চিত্র পাই আমরা। শরতচন্দ্রের ‘দেবদাস’ চরিত্রটিই দক্ষিণ এশীয় পুরুষের জীবন। সারাজীবন প্রেম খুঁজে প্রেমের দরোজায় মৃত্যু দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষের নিয়তি যেন।
দক্ষিণ এশিয়ার চিন্তাভাবনা খুব বেসিক; ‘লিখে রেখো এক ফোটা দিলেম শিশির’-এই কথাটি দক্ষিণ এশিয়ার স্ত্রী প্রতিদিন তার স্বামীদের বলেন; প্রেমিকা তার প্রেমিককে বলে। এই ফেভার খুব বেশি কিছু নয়; একটু গরম ভাত। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের রান্না করা ইদানিং আউট অফ ফ্যাশান। তাই স্বামীকে একটু ভাত রেঁধে খাওয়ানোই বিরাট ব্যাপার। ভাত রাঁধলে নারীবাদ ধর্মের অবমাননা হয়ে যায়। ভাত রান্না না করা বিশাল এক প্রতীকী প্রতিবাদ। অনলাইনে এখন মেনু দেখে ভাত-তরকারি অর্ডার করাই ট্রেন্ডি; পোচন্ড ফ্যাশানেবল।
দক্ষিণ এশিয়ার ৭০-৮০-র দশক পর্যন্ত নারীর ভাত রান্না করার ঐতিহ্য ছিলো; তার জন্য বিরাট ভাতের ভাস্কর্য গড়ে একবিংশ পর্যন্ত নমঃ নমঃ করতে হয় শেখ হাসিনা- খালেদা জিয়া-রওশন এরশাদের প্রজন্মকে। এই তিনজনের নামের সঙ্গে বাবা ও স্বামীর টাইটেল দেখে আপনি বুঝতে পারবেন; বাবা আর স্বামীর জন্য সামান্য ভাত ফুটিয়ে; একটু চা করে দিয়ে; কীভাবে তারা আজ অবধি জাতিকে চা-কর ধমকের মাঝে রেখেছেন।
মতিয়া চৌধুরী ধরিত্রীর মতো জাতিকে ভাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন; সেজন্য তরুণ প্রজন্মকে ক্ষেপে গিয়ে “রাজাকার” বলেছেন। এতে নাতির দুঃখ করার কিছু নাই; সবাই মিলে অগ্নিকন্যা নাম দিয়ে দেবার পরেই উনি জাতির জনকের চামড়া দিয়ে ঢোল বাজিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন। নাতি ও দাদা যে কথা শুনলেন উনার কাছে; ঐটাই দক্ষিণ এশিয়ার নিয়তি। প্রতিদিন পুরুষকে অসংখ্য আপত্তিজনক কথা শুনতে হয় নারীর কাছ থেকে। শুধু নারীবাদী পোর্টাল নয়; নারী আপাদের রাত এগারোটার ধমক স্ট্যাটাস নয়; দক্ষিণ এশিয়ার ঘরে ঘরে ধমকের পরশমনি ছুঁইয়ে সে আগুন ছড়িয়ে আছে সবখানে।
দক্ষিণ এশিয়ার নারী সামন্ত চিন্তার নারী; ঝাঁসির রাণী। নারীদের জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদের মতো কোন শেরে বাংলা কোথাও নেই।
ইন্দিরা গান্ধীর মতো আয়রন লেডি; মানেকা গান্ধীর মতো ছেলে-বউ; ঝগড়া যেখানে সমানে সমান, সেখানে বিমান চালানোর সময় মা বনাম স্ত্রীর কুরুক্ষেত্র নিয়ে ভাবলে বিমান দুর্ঘটনা কিন্তু ঘটবেই।
এই যে পাকিস্তানে ১৪১ জন পাইলট ফেইক লাইসেন্সের কারণে গ্রাউন্ডেড; এইখানে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর প্রতিটি সফল পুরুষের পিছে একজন অসামান্য নারীর ভূমিকা আছে। পাইলটের মা বনাম স্ত্রীর ঝগড়া; পাইলটের কোন সহকর্মী ভ্রমণসঙ্গিনীর প্রণোদনা প্যাকেজ এসবের কারণে ডিসিপ্লিন্ড সার্ভিসের একটি লোক বিমান চালনার লাইসেন্স দেবার পর সে আর পুনঃপরীক্ষা দেবার সময় পায়নি; কারণ স্ত্রী দেশে থাকতে রাজি হয়নি; ফলে ক্যানাডায় সেকেন্ড হোম গড়তে হয়েছে; গরীব দেশে টাকা উপার্জন করে ধনী দেশে ঢেলে দিয়ে আসা অন্ধ সেকেন্ড হোমার প্রজন্মের লোক সে; আবার দুবাইয়ে পাপিয়া-বিলাসের ব্যাপারও আছে। আশার ছলনে ভুলি আজ সে গ্রাউন্ডেড। স্ত্রী কিংবা পাপিয়া দু’জনের সঙ্গে সম্পর্কই নিষ্প্রভ হয়ে যাবে টেকাটুকা রপ্তানী করতে না পারায়।
মরুভূমিতে উটের গ্রীবা ধরে ছবি তোলা সাংসদ রেজিয়া সুলতানার টেকাটুকার যৌথ খামারের সোনার ছেলে পাপলু। বদির বউয়ের টেকাটুকার গাছ বদি বাবা; বাবরের বউয়ের ক্ষমতার স্পাইক বাবর, ভি আই পি হজ তাঁবুতে হাবিলদারের মতো ধমকে সবাইকে বের করে দিয়ে একা ঠান্ডা খাওয়া দুলুর বউ; কীভাবে ভড়ভড়িয়া গ্রাম থেকে এসে ঢাকায় ক্ষমতা ও টেকাটুকার ব্যাংক বসিয়ে ফেলে; এটাই দক্ষিণ এশীয় নারীর মোটামরফসিসের চিরন্তন চিত্র।
বাবা বা স্বামীর জোরে বেনজির ভুট্টো ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ায় স্বনির্ভর এনজিও-র জমিদার রাণি; গার্মেন্টস ও কর্পোরেট এলাকায় ছাঁটাই দোলা দেয়া দিলরূবা আপারা আছেন। কালচারাল ভটভটি এলাকায় রাজকীয় সংগীত বিদ্যালয়ের মালিক; শোবিজের বাংলিশ ট্রেন্ডি আপার দোকান; সরকারি চাকরির মানব দরদী ছবি ও বৃদ্ধকে কান ধরানো বিসিএস শোবিজ আপার দোকান; এরকম নানারকম নারী দোকানের সামন্তরা আছে। তারা সবাই এক একজন , উনিই পারেন; উনিই পারবেন আপা।
দক্ষিণ এশিয়ার নারী সতত ইন্টেলিজেন্ট নারী; অভাব সোশ্যাল ইনটেলিজেন্সে। এই কারণে নারী মুক্তির পথে প্রধান বাধা নারী।
কথায় কথায় নারীবাদী আপা ও দিদিরা বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এটা কিন্তু একটা তৈরি করা ন্যারেটিভ। কট্টর মোল্লাটিকেও স্ত্রীর সামনে ভেজা বেড়াল হয়ে থাকতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম ও সংস্কৃতির যে রূপ; তা কিন্তু নারীর লালিত। আজকের দিনের হিজাপি আপ্পি আর কপালে সিঁদুরের ঘাঁটি আঁকা আপ্পিই কিন্তু রক্ষণশীলতা লালন করেন।
হেফাজতের হুজর শফি তাদের তেঁতুল বলা, ভারতের ত্রিশূল বাবা রামদেবেরা কিংবা পাকিস্তানের সবুজ পাগড়ির মওলানা ফজলু যখন বলে, ভূমিকম্পের জন্য নারীর জিনস প্যান্ট দায়ী; এগুলো তাদের যৌন-অবদমনজনিত যৌবন জ্বালাময় সিপি গ্যাং খিস্তি। এর সঙ্গে তাদের জৈবিক চাহিদা জড়িত। একটা লোক কোন কাজ করেনা; রাজনীতিকদের কাকতাড়ুয়া হয়ে শুয়ে-বসে থাকে; ফলে যৌন চিন্তা ছাড়া আর কীই বা করবে সে।
এরকম লোক জঙ্গি নেতা হিসেবে পরিচিত হয় মিডিয়ায়; অথচ তারা গোয়েন্দা-সংস্থার কাকতাড়ুয়া। বাড়ির অর্থনীতি মন্ত্রী স্ত্রীর লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার মুখে তাকে জঙ্গিবাদের ফ্রি ল্যান্সিং করতে হয়। মাঝে মধ্যে জঙ্গি টাইপের ফেইক হুমকি ধামকি দিয়ে; বেশি ডেসপারেট হয়ে গেলে জঙ্গি হামলার দায়িত্ব পালন করে। আবোটাবাদে জীবনের শেষ দিনগুলোতে টেকাটুকার যোগানের অভাবে ওসামা বিন লাদেনও করুণ সুরে গাইতেন, ‘ও মানুষ; তুমার দুইডা চোখ দেখবা; দুইডা কান শুনবা ; কিন্তু একটা মুখতো; স্ত্রীর সামনে ইট্টু কথা কম কবা।’
হুজুরদের স্ত্রীর সুললিত বুদ্ধি পরামর্শ ও চাপাচাপিই তাকে ক্ষমতাসীনের নজরানা নিয়ে শোকরানা মেহেফিল করে আসতে বাধ্য করে। হুজুরের সততা নির্ভর করে স্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনে।
শোকরানা মেহেফিলে, শেখ হাসিনা যে ভঙ্গিতে মোল্লা শফিকে একটি খাম তুলে দেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি বাড়িতে মিলাদ বা পূজা শেষে ঠিক ঐ ভঙ্গিতে মওলানা সাহেব ও ঠাকুরের হাত খাম তুলে দেন নারী, টিভিতে জাকির নায়েকের বক্তৃতা শুনে নারী তীব্র জোশে বলে, ঢাকার লঞ্চ ডুবি থাইকা, ভারতের ট্রেন দুর্ঘটনা-পাকিস্তানের বিমান দুর্ঘটনা; সবই ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র।
এই যে নিজের দোষ না খুঁজে ইহুদি-নাসারার ষড়যন্ত্র খোঁজা; এটা নিজের অক্ষমতা না খুঁজে স্বামীর ষড়যন্ত্র খোঁজারই ভূ-রাজনৈতিক ডিসকোর্স। নারীই একটি দেশের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ঢাকার জগলুল, কলকাতার জগেন্দ্র বা লাহোরের জঙ্গিলা খান; এরা এক টুকরো রুটি আর গরম ভাতের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিবাহিত জীবনে লীন। আসল গেম মেকার হচ্ছে নারীই। সেই সংস্কৃতি নির্মাণ করে ‘ঘর ঘর কী কাহানী’-র প্রতিযোগিতামূলক ও মোহরমুখী জীবনের ফাঁদে।
দক্ষিণ এশিয়ার নারী সতত উচ্চাভিলাষী; ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্নীতির পেছনের প্রধান জ্বালানী শক্তি স্ত্রী; আর প্রণোদনা আসে ‘টেকাটুকা’কে ঈশ্বর মানা লোভী ও পাকস্থলিকেন্দ্রিক সমাজ প্রতিবেশ থেকে।
আত্মসমালোচনাই সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যায়। লেখক কারো প্রতিপক্ষ নয়। আলীপুর দাতব্য হাসপাতালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের পাশে হেনরিয়েটা, কলকাতায় মাদার তেরেসা, দল ভোটে জেতার পরে মনমোহন সিং-কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এগিয়ে দেয়া সোনিয়া গান্ধীকে দেখে লেখকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, প্রতীচ্যের নারী কী সেই জোয়ান অফ আর্কের উত্তরসূরী যাকে অন্ধকার আদিম চার্চ পুড়িয়ে মেরেছিল; অনুভূতির উইচ হান্টিং-এর কালে।
এই জোয়ান নির্লোভ, হাসিখুশি, ঋজু অথচ ভাতের খোঁটা দেয়না; হিসেব করে কথা বলে। দেখা হবার দ্বিতীয় দিনে এমনকি পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সম্পর্কের ডেফিনেশান খোঁজেনা। বলে না যে, বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে; একটা সিদ্ধান্ত নাও। টেনশন সেন সে নয়। সে জানে, হোয়াট ইজ শি আপ টু। সে নিরাপত্তার মধ্যে ভালোবাসা খোঁজে না; ভালোবাসা খোঁজে ভালোবাসারই মাঝে। একটাই তো জীবন কী হবে এতো ছোট-খাটো হিসাব করে।
জোয়ান ফরাসি খাবার রেঁধে নিয়ে এসে একসঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খায়, একবারও বলেনা রান্নাঘরে কত গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে রেঁধেছি; তোমার তো চিন্তা করতে হয়না; টেবিলে খাবার আইসা পড়ে। জোয়ান টেবিল ফুটবল খেলে, ধ্রুপদি সংগীতের সঙ্গে ব্যালেতে দশম শ্রেণির ছাত্রীর লাজুক হাসিতে মন্দ্র নাচে; ‘আমি আমার ফ্যামিলি আমার বোন আমার ভাই’ এমন পাতকুয়া আমিত্বের গল্প নেই; বাচ্চাকে নানুবাড়ি কেন্দ্রিক করে তোলার মনোপলি প্রতিষ্ঠার ফাঁপা চিন্তা করে না; বাচ্চাকে দাদা বাড়িতে যেতে সর্বোচ্চ বাধা দেয়না; টেকাটুকা নিয়ে কোন কথাই বলেনা; তোরা যে যা বলিস ভাই আমার এলিট জীবন চাই; একথা বলে না।
জোয়ান খুব সিরিয়াসলি মুভি দেখে, বই পড়ে, পরিবেশের পক্ষে সোচ্চার থাকে; এই জোয়ান ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনে আবার যেন জোয়ান অফ আর্ক হয়ে ওঠে; আর সব কিছুই করে আমরা হয়ে; আমির রোগ যে তার একেবারেই নেই। করোনাকালে প্যারিসের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে; জার্মানিতে ডাক্তারদের নগ্ন প্রতিবাদ রিটুইট করে। এই জোয়ান একদিনও পরচর্চার লোভে এসে বলেনা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখরো-র বউডা বুড়ি অনেক। অন্যের এরিয়া অফ প্রাইভেসিকে সে শ্রদ্ধা করে।
আর এই লেখাটা লেখার দায়ে লেখককে কত তিক্ত কথা শুনতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার পোচন্ড রাগী সমাজে; সে তো সহজেই অনুমেয়। লেখকের এরিয়া অফ প্রাইভেসিতে ফুচকি দেয়া গোয়েন্দারা উকুন তোলার আসরে লেখককে ধুয়ে দেবে। কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সংকোচেরই বিহবলতা নিজেরে অপমান।
মাসকাওয়াথ আহসান: শিক্ষক ও সাংবাদিক