December 3, 2024
অনুবাদসাহিত্যকবিতাফিচার ৩

আন্না আখমাতোভা ও তাঁর একগুচ্ছ কবিতা

হাসান মোরশেদ।।

আন্না পর্ব

আন্না আখমাতোভা, যার পুরো নাম ছিল আন্না আন্দ্রিভনা গোর্নিকা। রাশান কবিতার ‘সেন্ট পিটার্সবার্গ’ ঘরানার প্রধান কবি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একটা সময়ের শিল্প ও শিল্পবোদ্ধাদের সংঘ। আন্না’র নিজের গল্প তেমন আলাদা কিছু নয়। সকল সমাজে সকল সময়ে একজন কবি এবং একজন প্রতিভাবান মানুষের বেড়ে ওঠার গল্প। হ্যাঁ, নারী হিসেবে তার গল্প আরো বেশি কিছু বেদনাময়।

কিশোরী আন্নাকে নাম বদলাতে হয়। বাবা চাননি বখে যাওয়া মেয়ের ‘আজেবাজে’ লেখার সাথে তাঁর অভিজাত নাম উচ্চারিত হোক। প্রথম বিয়ে আরেকজন কবিপুরুষের সাথেই। নিকোলাই গোমিলয়েভ, যিনি কখনোই আন্না’র কবিসত্তাকে গুরুত্ব দেননি। একবার ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন, যখন আলেক্সান্দর ব্লক ঘোষণা করেছিলেন ‘কবি হিসেবে আন্না, নিকোলাই থেকে অনেক উঁচুতে।’

এরপর আরো দু’জন বিদগ্ধ জনের সাথে তাঁর ঘরসংসার। সবশেষে নোবেলজয়ী বরিস পাস্তরনেকের সাথে রহস্যঘেরা প্রেম, যা শেষপর্যন্ত পরিনতিহীন। তবে আন্না আখমাতোভার জীবনে পরোক্ষভাবে সব থেকে গভীর দাগ ফেলেছিলেন কমিউনিষ্ট লৌহমানব জোসেফ স্ট্যালিন।

আন্না ও তাঁর সমসাময়িক কবিরা রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিগত নির্জনতাকে ঘিরে যে ঘরানার কবিতা লিখতেন, বলশেভিক বিপ্লবের পর সেগুলোকে প্রতিবিপ্লবী আখ্যা দেওয়া হয়। স্ট্যালিন আমলে তাঁর প্রথম স্বামী কবি গোমিলয়েভকে মৃতুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর তৃতীয় স্বামী নিকোলাই পুনিনও মারা যান শ্রমশিবিরে। পার্টিজান হওয়ার পরও পাস্তোরনাকের সাথে পার্টির আচরণ তো ইতিহাস।

আন্নার একমাত্র ছেলেরও পুরো তারুণ্য কেটেছে বন্দীশিবিরে। স্ট্যালিনের জন্য প্রশংসাগাঁথা রচনা করেও আন্না দীর্ঘবছর ছেলেকে দেখতে পাননি। স্ট্যালিনের রাজনৈতিক সহচর আন্দ্রে জিদানভ একবার জনসম্মুখে তাঁকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অর্ধেক গনিকা, অর্ধেক তাপসী’ বলে।

পার্টিজান ছিলেন না বলে ১৯২৫ থেকে ১৯৫২- এ দীর্ঘসময়ে তাঁর কোন কবিতা প্রকাশিত হয়নি সোভিয়েতে। পশ্চিমে পালিয়ে যাওয়া কবিবন্ধুদের ধারণা ছিলো আন্না আর বেঁচে নেই।

বাইরের পৃথিবী আন্নাকে প্রথম জানতে পেলো যখন তিনি ১৯৬৫ তে ইতালি ও ইংল্যান্ড ভ্রমণের অনুমতি পান। ইংল্যান্ডে এলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।

আন্না’র কবিতাগুলো আরও বেশি নন্দিত হতে থাকলো ১৯৬৬ তে তাঁর মৃত্যুর পর। সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আন্না আখমাতোভা স্মৃতি জাদুঘর’, যেখানে জীবনের এক দীর্ঘ সময় পার করেছিলেন এই কবিতার তাপসী।

মূল রাশান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা আন্না’র কবিতা প্রথম পড়েছিলাম অন্তত দুইযুগ আগে। বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করা এক কিশোরের জন্য সে পাঠ অবশ্য বেশ ভারি ছিলো। তবু অনুভূতি দিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। ধারণপর্বটা শেষপর্যন্ত কিছুটা বোঝা আর অনেকটা না বোঝাতেই আটকে গিয়েছিল। আরো পরে যখন পেশাগত কারনে ইংল্যান্ড থাকি কয়েক বছর, আর চমৎকার যোগাযোগ ঘটে কিছু মানুষের সাথে, সারা পৃথিবীর কবিতা যাদের পঠনে ও মননে, ঠিক এ অবস্থায় স্মৃতিতে ফিরে আসেন আন্না আখমাতোভা ‘কবিতার গনিকা, কবিতার তাপসী’।

মূল রাশান থেকে ইংরেজি। সেখান থেকে বাংলা। আর এটা কোনভাবেই আক্ষরিক অনুবাদ নয়। যা করেছিলাম তাকে আমি বলি, ভাবানুবাদ। যেন এক মহান শিল্পীর আঁকা ছবি দেখে এলাম। এবার চোখ বুঁজে নিজস্ব কল্পনায় তাঁকে আবার দেখলাম। চোখ খুললাম। এবার নিজের আঁকার পালা, সেই ছবিটাই। ছবিটা ঠিক রাখার চেষ্টা তো থাকবেই, কিন্তু জলরংয়ে আঁকা মূল ছবি যে  পেন্সিলে আঁকা স্কেচ হয়ে যাবেনা, এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায়না। এই ভাবানুবাদগুলো ২০০৬ এর কোন এক সময়, ইংল্যান্ডে।

কবিতাপর্ব

অন্যজীবন

 

এসব ছাড়িয়ে অন্য কোথাও জীবন আছে জানি,

অন্য রকম। সেই জীবনে একটি কিশোর সন্ধ্যেবেলা

সীমানা ছাড়ায়। এক কিশোরী, সেই কিশোরের

চুলের ফাঁকে আঙুল বোলায়। হাজার কয়েক

প্রজাপতি তাদের ঘিরে জ্যোৎস্না ঝরায়।

কিন্তু আমরা টুকরো মানুষ, ভগ্নজীবন আঁকড়ে থাকি

মুক্ত হবার প্রবল নেশায়, চারপাশেতে দেওয়াল গড়ি।

হঠাৎ কেবল হন্যে বাতাস, ভাবনাঘরে ঝাপ্টা দিলে

মনে পড়ে অন্য জীবন।

সেই জীবনে একটি কিশোর,

জ্যোৎস্নাময়ী এক কিশোরী…

অন্য জীবন, অন্য কোথাও_

আমরা কি আর পৌঁছতে পারি?

 

অবকাশযাপন

 

দক্ষিণ সমুদ্রতীরে অন্য কেউ যাক অবকাশে

অন্য কেউ উপভোগ করুক স্বর্গভূমি,

এখানে উত্তুরে হাওয়া, এখানে আমি

আমার স্মৃতিরা মেঘদল হয়ে,ভাসে আকাশে।

পাশে কেউ নেই,আমি তো আছি আমার

সমস্ত অতীত ও সমপ্রতি

জ্বেলেছে প্রদীপ,যেনো নিয়তি,

স্নিগ্ধ শিখাটি হেমন্তবেলা সাথী উষ্ণতার।

 

শেষ প্রণয়ের গান

 

ক্রমশ শীতল হয়ে এসেছিলো আমার সকল

তখনো অনেকটা প্রহর হেঁটে যাওয়া কেবল,

প্রাচীন গল্পের মতো আরো দীর্ঘ দীর্ঘ পথ

হায়! ক্লান্ত আমি, ফুরিয়েছে চলার শপথ।

হেমন্তের বিষাদ সন্ধ্যায় কেবল জেগেছিলো

মেপলের শীর্ন পাতা, আর তারা বলেছিলো

‘ওগো বিষন্ন মেয়ে, এসো বসি ওই প্রান্তে

এসো একসাথে ঝরে পরি এ করুণ হেমন্তে’

‘আমি ও বিরহপ্রিয়, আমি ও কাঙ্গাল বড়ো

হে মেপল, হে প্রিয়… আমাকে গ্রহণ করো’

আমাদের শেষবেলা শুধু এই কথা হয়েছিলো,

একটি প্রদীপ তার হলুদাভ শিখা জ্বেলেছিলো।

 

আমার ছুটে চলা

 

ছুটে চলা বেশ জ্যামিতিক।

কারো বেলা এক সরলরেখা

কারো বৃত্তাকার;

যেনো বেলা শেষে বাড়ি ফিরে আসা

অথবা, প্রতীক্ষা হারানো প্রেমিকার।

সবারই ছুটে চলা বেশ জ্যামিতিক

শুধু আমারই বেলা নিয়তি বিপরীত;

স্মৃতি থেকে গন্তব্য মুছে গেছে,

মুছে গেছে নামসহ নারী

যেনো লাইন থেকে ছিটকে পড়েছে

করুণ ট্রামগাড়ি।

 

প্রিয় বরিস, তোমার জন্যে

 

ফুরিয়েছে আমাদের কথোপকথন

বিদেয় নিয়েছে বসন্ত বেলা

এসেছে স্তব্দতার প্রহর

ভেসেছে বিষন্ন ভেলা।

স্বর্গের ফুলদল প্যাকেট বন্দী

শবচারী হবে তারা,

শোকে নত বিশাল ছায়াপথ,

ক্ষুদ্র পৃথিবী কাফনে মোড়া।