রানীরা কবে রাজত্ব দাবি করবে?
জান্নাতুল মাওয়া।। ভাওয়ালের মেজো রাজকুমার রামেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী মৃত্যুর বারো বছর পর ফিরে এসে আবার হারানো রাজত্ব দাবি করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন আরো অনেক ভারতীয় জমিদার অথবা রাজকুমারদের মতই শৌখিন, প্রজাবৎসল, উড়নচণ্ডী এবং স্ত্রীবিমুখ ও পরনারী আসক্ত। এই জমিদারেরা বিবাহ করতেন কেবল নিয়ম রক্ষার জন্যে। তারপর স্ত্রীটির দিকে ফিরে তাকানোর সময় তাদের থাকতো না। এই বিষয়টিকে কেউ সমস্যা বলেও গণ্য করতো না। এই জমিদারদের স্ত্রীদের মনোভাব কী ছিলো তাও আমাদের জানার বাইরেই রয়ে যায় সবসময়। কারন তাদের হাতে ক্ষমতা ছিল না, তাই তাদের কথা সকলের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। নিজ স্বামী সম্পর্কে রাজা রামেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী বিভাবতীর মনোভাব কী তা পরিষ্কার জানা না গেলেও ইতিহাসের নথিপত্র থেকে এটা জানা যায় যে, তার স্বামীর মৃত্যুর বারো বছর পর যখন এক নাগা সন্ন্যাসী এসে দাবি করে যে সে-ই রাজা রামেন্দ্র নারায়ণ এবং সে মরে নাই, তখন বিভাবতী এই সন্ন্যাসীকে স্বামী হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
আমাদের জানামতে তখনকার বাঙ্গালী সমাজে একজন সন্তানহীন বিধবার জীবন মোটেই মসৃণ ছিলো না। তবুও বিভাবতী কেন অস্বীকার করলো রাজাকে? তাহলে কি সন্ন্যাসী আসলে মিথ্যা বলছিল? যদিও ঐতিহাসিক ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার রায় সন্ন্যাসী রাজার পক্ষেই যায়। মামলা চলাকালীন একটা সময়ে গোটা বিষয়টা মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে। কারণ ভাওয়ালের রাজকুমারদের মৃত্যুর পর জমিদারি চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। যদিও রাজকুমারদের বোনেরা এবং স্ত্রীরা জীবিত ছিল। তবুও তারা উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি পেল না। তার মানে ব্রিটিশ আইনও তখনকার নারীদেরকে তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি পেতে সাহায্য করে নাই। বরং ব্রিটিশরা এই অবস্থার সুযোগ নিয়েছে শতভাগ। তবে হ্যাঁ, বিভাবতীসহ জমিদার বাড়ির সব নারী তাদের জমিদারির একটা অংশ পেয়েছিলেন ভরণপোষণ বাবদ। এমন একটা অবস্থায় যখন মৃত স্বামী ফিরে আসেন, আবার যখন জমিদার পত্নী হবার সুযোগ ফিরে আসে, তবুও বিভাবতী কেন স্বামীকে অস্বীকার করেন? এই ‘কেন’কে মাথায় নিয়েই হয়তো পরিচালক সৃজিত মুখার্জী তৈরি করেছেন তার বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র- এক যে ছিল রাজা। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীরা যে মাঝে মাঝে নারীবাদকে সাম্রাজ্যবাদের একটা অস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে নারীবাদকে পুরোপুরি খারিজ করে দেয়ার চেষ্টা করে, ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটিতে সেই আলোচনার প্রভাব দেখতে পেয়ে চমৎকৃত হলাম।
চলচ্চিত্রটির একটা বেশ ছোট কিন্তু আমার মতে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো বাদী-বিবাদী দুই উকিলের ব্যক্তিগত কথোপকথন। অবশ্যই পরিচালক এখানে ইতিহাসের নথির পাশাপাশি নিজের স্বাধীন কল্পনাকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন। এমন কথোপকথন ত্রিশের দশকের ভারতবর্ষের দুই আইনজীবীর মধ্যে আসলেই হয়েছিল কি না তা আমরা না জানলেও ঠিক এমন কথোপকথন সব জায়গায় প্রতিনিয়ত হচ্ছে এখন।
দুই আইনজীবীর কথোপকথনে বোঝা যায় সন্ন্যাসী রাজার পক্ষের উকিল ভাস্করের (চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত নাম) মূল চিন্তার জায়গা হলো ব্রিটিশদের হাত থেকে জমিদারি উদ্ধার করে একজন ভারতীয়ের হাতে তুলে দেয়া। আর তাই সে প্রাণপনে লড়ছে, প্রমান করতে চাইছে এই সন্ন্যাসীই আসল রাজা। দুই উকিল যখন কাজের অবকাশে নিজেদের মাঝে কথা বলার সুযোগ পায় তখন ভাস্কর বিপক্ষের উকিল এবং প্রাক্তন বান্ধবি অনুপমাকে বলে “লোকটা যদি সত্যি রাজা হয়?”
তখন বিভাবতীর উকিল অনুপমা উত্তর দেয়, “তাহলে তো আমি আরো বেশি করে লড়বো, আমি চাইনা স্কাউন্ড্রেলটা রাজত্ব ফিরে পাক। আইন ব্যাপারটা ভারতীয়ও নয়, ব্রিটিশও নয়, ওটা জাস্ট পুরুষদের বানানো। সুতরাং তুমি লড়ো তোমার ম্যাপের ওপর আঁকিবুকি কাটা অ্যাবস্ট্রাক্ট দেশের জন্য, আমি আমার রক্ত মাংসের চন্দ্রাবতীর (চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রানী বিভাবতীর নাম) জন্য লড়ে যাবো”।
যদি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি বা সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদায় চিহ্নিত করা হতো তাহলে কি ব্রিটিশরা রাজা নেই এই কথা বলে জমিদারি দখল করতে পারতো? যদি রাণী বিভাবতী সত্যিই একজন রাণীর সম্মান পেতেন তাহলে কি তিনি তার স্বামীকে অস্বীকার করতেন? সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদেরকে আসলে তাদের প্রকৃত সমস্যাটা নির্ণয় করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নানান দেশে তাদের ক্ষমতার বাহু বিস্তার করার সময় সেটাকে জায়েজ করার জন্যে যে কারণগুলো দেখায় তার মধ্যে একটা হলো, আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে নারীদের শোচনীয় অবস্থা। এবার সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা করতে গিয়ে আজকাল অনেকেই অস্বীকার করতে শুরু করেছে যে তাদের অঞ্চলের নারীরা আসলেই নানানভাবে পিছিয়ে আছে। অথচ তারা দাবি করে তারা মজলুমের পক্ষে কথা বলছে। যদি সত্যিই মজলুমের পক্ষে তারা কথা বলে থাকে তবে নিজ অঞ্চলের নারীদের নিপীড়নের বিষয়টা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারণা বলে চেপে যাবার এই হিপোক্রেসিটা কেন তারা করে এটা স্পষ্ট না। অথচ তাদের সংগ্রামে নারীবাদীদেরকে মুখোমুখি দাঁড় না করিয়ে নিজেদের পাশাপাশি দাঁড় করালেই তাদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যেত।
আজকে একশ্রেণির ইসলামিস্ট সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাধারীদের মূল কথা হলো, নারীকে দিয়ে সুন্দর পরিবার গঠন করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে আনো। নারীর আসল স্থান হলো ঘর, তাদের আসল কাজ হলো সন্তান লালন-পালন করা। অর্থাৎ নারীকে পরনির্ভরশীল করে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরই সাহায্যে নিজেদের অনুগত একটা আগামী প্রজন্ম তৈরি করা। এই জন্য তারা ইতিমধ্যে নানানভাবে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের প্রচারণার একটা অন্যতম ধাপ হলো, নারীর পক্ষ থেকে উত্থাপিত যে কোন বিষয় এবং সমস্যাকে পশ্চিমা বলে চিহ্নিত করে খারিজ করে দেয়া।
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া আরেকটি চলচ্চিত্রের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। বুলবুল নামের এই চলচ্চিত্রটিতে ১৮৮১ সালের ভারতবর্ষের এক হিন্দু জমিদার বাড়ির গল্প বলা হয়। আমার মতে এই চলচ্চিত্রের কি ওয়ার্ডগুলো হলো, “শরম, মর্যাদা, ঘর, পতি, চুপ, পর্দা, নিয়ন্ত্রণ”। খুব পরিচিত না শব্দগুলো?
মেয়েদেরকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য এই শব্দগুলোর ব্যবহার অঞ্চলভেদে, ধর্মভেদে এক ও অভিন্ন। তাই নারীবাদও কোন বিশেষ অঞ্চলের নয়, কোন বিশেষ ধর্মের পক্ষে অথবা বিপক্ষে কথা বলাও নারীবাদের এজেন্ডা নয়। নারীবাদের এজেন্ডা হলো নিপীড়িত, মজলুম মানুষের পক্ষে কথা বলা। অতএব যারা নারীদের ইস্যু এড়িয়ে গিয়ে মজলুমের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করে; যাদের এজেন্ডাতে, মতবাদে নিপীড়িত নারীদের কথা থাকেনা; তারা যখন নারীর মাতৃত্বকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপন চেষ্টা করতে থাকে; তখন প্রত্যেকটি সচেতন মানুষের উচিত হবে এই মুভমেন্টগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]