নারীর পোশাক ও সমাজের মন
আমিন আব্বাস নোমান।। আমি পুরুষ তবুও লিখছি নারীর পোষাক নিয়ে। একেবারে প্রান্তিক নারীর।
আমি বিয়ে করি ২০১৩ সালের শেষের দিকে। যাকে বিয়ে করি সে আমার একাকীত্ব জীবনের বন্ধু, সখা সব। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি, সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ। এখানে বলে রাখি একাকীত্ব জীবনের মানে হলো আমি একজন প্রতিবন্ধী। সেলিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত জন্ম থেকে। মফস্বলে বড় হওয়া এবং বসবাস। কিন্তু এই ঘুনে ধরা সমাজব্যবস্থা অসহ্য লাগে। তবুও কীসের ভয়ে যেন মেনে চলি। বিয়ের পর থেকে আমি চাই আমার স্ত্রী যে কোন পোশাক পরুক তার পছন্দমত।
বিয়ের চার বছর পর ছুটিতে ঢাকা যাই বেড়াতে। ঢাকাতে দুই খালা ও ফুফাত ভাইদের বাসায়। ভেবেছিলাম ঢাকায় মেয়েদের পোশাক নিয়ে কাসুন্দি ঘাটা হয় না। তাই খালার বাসায় তাকে বলি এখানে নিশ্চিন্তে তোমার ইচ্ছেমত পছন্দের জামা পরো। কেননা খালাতো বোন এবং খালাতো ভাইয়ের বউ তারা যে সব ধরনের পোশাক পরে। তো এখানে কীসের সংকোচ। খালার বাসায় যাবার পরের দিন শপিং এ যাবো সে জিন্স ও শার্ট পরলো। সামনাসামনি খালাকে দেখলাম খুশি। কিন্তু মার্কেটে দোকানদারদের চাহনি অবাক করার মত তার পাশে আমাকে দেখে। কোন কোন ক্রেতা তো প্রায় আমাদের খেয়ে ফেলবে তাদের চাহনি দিয়ে। কোন কোন দোকানদার আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ও কে?’ কেউ কেউ মন্তব্য করে, এসব মেয়েরা স্বামী একটা সো রাখে। কেউ কেউ আমাকে পরামর্শ দেয়, তুমি অসুস্থ মানুষ বউরে এগুলা পরতে মানা কোরো। আমি বলি, আমিই ওকে পরতে বলছি।
যাক সেসব নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু ঢাকা থেকে চলে আসার কিছুদিন পরে যখন খালার মন্তব্যগুলো শুনেছি, কেমন যেন লাগে! অন্য খালাদের কাছে উনি বলেন, গরীব ঘরের মেয়ে, এমন চলা কেমন লাগে, ঢাকা এসে বেহায়াপনা করে গেল, আমার মেয়েদের সাথে টেক্কা দিতে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
২০১৮ সাল প্রশিক্ষনের জন্য এক বছরের জন্য জেলা শহরে বাসা নিই। বাসায় আমার স্ত্রী টি-শার্ট, লেগিংস, টপস, স্কার্ট, শর্ট স্কার্ট, ট্যাঙ্ক টপস, শার্ট পরে। এতে আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবার মনে হয় গা খুব চুলকায়। কেন চুলকায় জানি না। তবে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট যে আমি প্রতিবন্ধী এটা বড় বিষয়। আমার প্রতিবন্ধিতার সাথে তার পোশাককে জড়িয়ে যা ইচ্ছে বলা যায়।
তো সেই বছর আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন সন্ধ্যায় ঘুরতে এবং ডিনার করতে বেরুই। ইচ্ছে হলো দুজনে ডানা মেলে ঘুরি যদিও সাথে আমাদের চার বছরের মেয়ে সঙ্গী হলো। রিকসা করে ঘুরবো, শপিং করবো, তারপর ডিনার করে অনেক রাতে বাসায় ফিরবো। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে রাস্তায় শুনছি নানা কথা। কারণ আজ সে শখ করে পরলো জিন্স এবং শার্ট, সাথে চুল খোলা। তাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমি প্রতিবন্ধী হওয়ায় তেমন বের হইনা, রাতে তো আরো না। তার এই পোশাকে রাস্তায় সবার চোখ তার দিকে, সাথে নানান কথা। একজনতো কী একটা বাজে কথা বলে আমাকে প্রায় তার পাশ থেকে ফেলে দিল। পরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি তার স্কার্ফ সিগারেটের আগুনে পোড়া। আবার রেস্টুরেন্টে ‘আধুনিক’ মানুষ যারা আছে তাদের অনেকের মন্তব্য যার স্বামী প্রতিবন্ধী, সে এমন পোশাক পরে কীভাবে? তবে কি প্রতিবন্ধী, তার স্ত্রী বা মেয়েরা নিজের ইচ্ছেমত চলতে পারবেনা?
তবে আমরা শপথ নিয়েছি সে পরবে এ পোশাকগুলা যত দিন বেঁচে আছি। তার টি-শার্ট, লেগিংস, টপস, স্কার্ট, শর্ট স্কার্ট, ট্যাঙ্ক টপস, শার্টগুলো তোলা থাকবে না, বরং পরম যত্নে ব্যবহার হবে। বেঁচে থাকবে তার পছন্দ আর আমার শখ।
আমিন আব্বাস নোমান: প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]