ট্রান্সজেন্ডার, ইন্টারসেক্স ও হিজরা
সৈয়দা সুমাইয়া ইরা।। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে আমার আগের লেখাটা অসম্পূর্ণ ছিলো, ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আমার আরো লেখা উচিৎ ছিল। সেই তাগিদেই আবার লেখাটা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করলাম।
হিজড়া সম্প্রদায় নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে, অনেকেই মনে করে হিজড়া সম্প্রদায় ইন্টারসেক্স বা উভয়লিঙ্গ। তৃতীয়লিঙ্গ মানেই মনে করে ইন্টারসেক্স। আসলে তা পুরাপুরি সত্য নয়, আমাদের দেশের হিজড়া সম্প্রদায়ে যারা যোগ দেয় তারা বেশিরভাগই ট্রানজেন্ডার।
হয়তো কোনো মানুষ শরীরে পুরুষ অথচ মানসিকতায় সম্পূর্ণ মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন, আর পুরুষ হয়ে মেয়েলি আচরণ করার জন্য তাকে বিদ্রুপ করা হয়েছিল ‘হাফলেডিস’ বলে, পরিবারের লোক নিজেদের কোনো পাপের জন্য অভিশাপ মনে করেছে; নিজের এই Gender Dysphoria নিয়ে মানুষটি একসময় চলে যায় হিজড়া দলে। এরাই ট্রান্সউওম্যান।
লিঙ্গ ও যৌন বিশেজ্ঞরা বলেন, এটা হলো হরমোনের প্রভাব। সাধারণত পুরুষের দেহে টেস্টোস্টরন হরমোন আর নারীদের শরীরেন এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টোরন হরমোনের আধিক্য থাকে। কিন্তু একজন পুরুষের দেহে যখন এস্ট্রোজেন হরমোন বেশি দেখা যায় তখন তার আচরণে পুরুষের বৈপরীত্য দেখা যায়। হরমোন ছাড়াও আরো অনেক অজানা কারণে লৈঙ্গিক বৈপরীত্য ঘটে।
ইন্টারসেক্স নিয়ে কিছু বলা দরকার। ইন্টারসেক্স বা উভয় লিঙ্গ, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে Hermaphrodite or intersex or disorder of sex development. হার্মাফ্রোডাইট বা ইন্টারসেক্স হচ্ছে মানবদেহের এমন একটি অবস্থা যার ফলে মানবদেহের বহিঃজননাঙ্গ এবং অন্তঃজননাঙ্গ এর মধ্যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়, অর্থাৎ একসাথে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় থাকে। যার ফলে একজন মানুষের মধ্যে নারী এবং পুরুষ উভয়ের যৌন চরিত্র একইসাথে বিদ্যমান থাকে। ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে একজন মানুষের শরীর নারী এবং পুরুষ উভয় লিঙ্গ তৈরি হয়। আমাদের সেক্স ক্রোমোজমে থাকে, ‘XX’ ‘XY’। কিন্তু ইন্টারসেক্সদের সেক্স ক্রোমোজম হয় ‘XXY or XXX’, অর্থাৎ তাদের সেক্স ক্রোমোজমে সংখ্যা কমবেশি হওয়ার জন্যই এমনটা হয়।
‘হার্মাফ্রোডাইট’ নামটা এসেছে গ্রিক মিথ থেকে। গ্রিক মিথের প্রথম ইন্টারসেক্স ছিলেন ‘হার্মাফ্রোডিটাস’।
বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১.৭ শতাংশ ইন্টারসেক্স মানুষ। আমাদের দেশেও ইন্টারসেক্স আছে কিন্তু খুবই কম। তাদের প্রচলিত ভাষায় হিজড়া বলা যাবেনা, এরা কেউ হিজড়া দলে থাকেনা, পরিবারে কেউ মেয়ে হয়ে থাকে বা কেউ ছেলে হয়ে থাকে। কিন্তু নিজের লৈঙ্গিক পরিচয় সংকটের জন্য পরিবারে তারা সুখে থাকে এমন নয়।
আমাদের সমাজে হিজড়াদের ইন্টারসেক্স মনে করার এই মিথ নিয়ে থাকা মানুষরা রাস্তা-ঘাটে অনেক হিজড়াদের কাপড় খোলেন, অথবা তাদের কাজের সুযোগ দেয়ার নামে তারা সত্যিকার হিজড়া কিনা প্রমাণ করার জন্য কাপড় খোলেন, তার কাপড় খুলে পুরুষলিঙ্গের অস্তিত্ব পেয়ে থাকে নকল হিজড়া বলেন।
একজন পুরুষের কী ঠেকা পড়ছে মেয়েদের মতন সাজসজ্জা করে হিজড়া সম্প্রদায়ে যোগ দিয়ে মানবেতর জীবন কাটানোর? আর মনেপ্রাণে একজন পুরুষ কখনই লিপস্টিক চুড়ি ফিতা পরবে না।
আমার খুব কাছের একজন ছেলেকে আমি দেখেছি ট্রান্সউওম্যান হওয়ার জন্য তার পরিবারের মানুষ, আত্মীয়রা কতো অবহেলা করতো, ধিক্কার দিতো। ছেলেটার অনেক স্বপ্ন ছিলো পড়ালেখা করে বড় চাকরি করে স্বাধীন জীবনযাপন করার, অথচ কৈশোরে চলে যেতে বাধ্য হয় হিজড়া ডেরাতে।
হিজড়াদের কেউ কেউ লিঙ্গছেদন করেন, তাদের বলা হয় ছিন্নি, অনেকেই ভারতে গিয়ে এই কাজ করে আসেন। শারীরিক এই পরিবর্তনের জন্য অনেকে আরো বেশি মেয়েলি হয়ে ওঠেন। লৈঙ্গিক পরিচয়ের জন্য তারা উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। যদিও সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয়লিঙ্গ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু সমাজিকভাবে মর্যাদা পেতে আরো অনেক দেরি আছে।
হিজড়া দলে গিয়েও যে তারা সুখে থাকে এমন হয়, তাদের গুরু এলাকা ভাগ করে দেয় চাঁদা তুলতে, অথচ এই চাঁদার বেশিরভাগ যায় গুরুর পকেটে। অত্যাচারের জন্য ঘর ছাড়লেও শান্তি নাই হিজড়া ডেরাতে এসে।
তাদের থাকার জায়গা কেউ খুব কাছে থেকে দেখে আসলে বুঝতে পারবেন একজন মানুষকে অনৈতিক বানাতে আমাদের সভ্য সমাজ কতোটা দায়ী! আমরা তাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করি, পরিবার থেকে বঞ্চিত করি, সমস্ত নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করি। তারা রাস্তায় ডেস্পারেট আচরণ করে। তথাকথিত সভ্য সমাজ লৈঙ্গিক পরিচয়ের জন্য তাদের সংখ্যালঘুদের দলে ফেলে সমাজের মূল স্রোত থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে আর ক্রমাগত লাঞ্ছিত-বঞ্চিত করে চলেছে।