“তুমি তো সেইরকম নারীবাদী না!”
আফরোজ ন্যান্সি।। একটা কথা প্রায়ই আমাকে শুনতে হয়, “তুমি তো সেরকম নারীবাদী না”। আমি যখন জিজ্ঞেস করি “সেরকম নারীবাদী” বলতে কী বুঝাইলেন বুঝায়ে বলেন! আকারে ইঙ্গিতে তখন তারা এটাই বলার চেষ্টা করেন যে যেহেতু আমি স্লিভলেস পরিনা, ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিনা সেহেতু আমি সেরকম নারীবাদী এখনো হয়া উঠি নাই। এই লোকেরাই আবার ফেমিনিজমের গুষ্টি উদ্ধার করে এই বইলা যে ফেমিনিজম নারীদের জন্য খোলামেলা জামাকাপড় পরার, চৌদ্দব্যাটার সাথে শোয়ার অধিকার চায়। তারা ঢালাওভাবে মনে করেন ফেমিনিস্টরা সবাই খোলামেলা ড্রেস পরে আর দুই তিনটা বিয়া করে আর যার তার লগে শোয় আর ফেমিনিজম মানেই হইলো অনেকের সাথে শোয়ার আর ন্যাংটা হয়া ঘোরার স্বাধীনতা চাওয়া।
একবার আমার এক বন্ধু কইলো, “আমারে অন্তত একজন নারীবাদী দেখা পারলে, যে কিনা কয়েকটা বিয়া করে নাই”। আমি তার আর আমার দুইজনেরই পরিচিত এক ফেমিনিস্টের নাম কইলাম। সে মুখটা কালো বানায়া কইলো, “হ ওইরকম দুই-একজন পাওয়া যাইতে পারে তবে বেশিরভাগ নারীবাদীরাই ওইরকম”। আমি তারে জিগাইলাম যে ফেমিনিস্ট না কিন্তু খোলামেলা ড্রেস পরেন, কিংবা একের অধিক বিয়া করছেন কিংবা জামাই থাকতেও পরকিয়া করেন এমন নারী নাই? সে কইলো আছে কিন্তু সংখ্যায় কম। কিন্তু নারীবাদীরা এইগুলা করবেই।
আমার ভাবলে অবাক লাগে, তারা বেগম রোকেয়ার মতো ঘোমটা পরা, এক জামাইয়ের ঘর করা নারীবাদী চায় কিন্তু কোনো মেয়ে যদি ঘোমটা দিয়া, এক জামাইয়ের ঘর কইরা নারীবাদের চর্চা করতে চায় তাইলে তারা বলে, ‘‘আরেহ আপনে তো ওইরকম নারীবাদী না।’’
আসলে তারা এই কথাগুলা বইলা সাহসী মেয়েগুলার মনোবল ভাইঙ্গা দিতে চায়, আত্মবিশ্বাস নষ্ট কইরা দিতে চায়। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যদি বেগম রোকেয়া এই যুগে জন্মাইতেন তাইলে তারা বেগম রোকেয়ারেও কইতেন ‘‘আপনে তো ওইরকম নারীবাদী না! সবই হিজাব খোলার ধান্ধা অথবা পরপুরুষের লগে ফষ্টিনষ্টি করার ধান্ধা।’’
এই সমস্ত পুরুষতন্ত্রের চাটাদলের কাছে আমার প্রশ্ন, একজন কর্মজীবী নারী যিনি বাপের টাকায়, স্বামীর টাকায় আরামের জীবন পার করার সুবিধা ছাইড়া দিয়া নিজে পরিশ্রম কইরা টাকা উপার্জন করেন তারে ঠিক কী যুক্তিতে আপনি নারীবাদী বলবেন না? অথবা যে নারী রান্নার কাজ হোক কি ব্যাংকের কাজ হোক কি মাটি কাটার কাজ হোক ভয় পেয়ে পিছায়ে যায় না, নারীর কাজ- পুরুষের কাজ ইত্যাদি অজুহাত দেখায়া সুবিধা ভোগ করেন না তারে ঠিক কী যুক্তিতে আপনি নারীবাদীর তালিকা থেকে খারিজ কইরা দিতে চান? কিংবা যে নারী বিয়েতে দেনমোহর নেন না, স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির টাকায় শাড়ি-গয়না দাবি করেন না তারে নারীবাদী বলতে আপনার পুরুষতন্ত্রের বিচি খুইলা পরে ক্যানো? যে সিঙ্গেল মা তার সন্তান লালন-পালনের জন্য ডিভোর্সড জামাইর মুখাপেক্ষী হয়া না থাইকা নিজেই সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব নিজের কাধে তুইলা নিছেন তারে ক্যানো নারীবাদের উজ্জ্বল আদর্শ ভাবতে পারেন না? সেই কন্যা সন্তানরে ক্যানো নারীবাদী ভাবেন না যে তার বৃদ্ধ বাপ-মায়ের ভরণ-পোষণের দায় ভাইয়ের কাঁধে চাপায়ে না দিয়া নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুইলা নিছেন? আর সেই সমস্ত নারী যারা দিনরাত কিবোর্ড চেপে যাচ্ছেন- বই লিখছেন, যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন, যারা পতিতা নারীদের নিয়ে কাজ করছেন, যারা নিম্নবৃত্ত নারীদের নিরাপদ পিরিয়ড, নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে কাজ করছেন তাদের সমস্ত অবদান আপনারা খারিজ করে দিতে চান কোন কুযুক্তিতে?
নাকি আপনারা এসব দেখতেই চান না?
সত্যি এটাই যে নারীর যোগ্যতা, ভালো কাজ, কঠোর পরিশ্রম এসব আপনারা আসলে দেখতেই চান না। আপনাদের অসুস্থ চোখ কেবল নারীর বগল, নারীর স্তন, নারীর খোলা পেটের পেলব ত্বক দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে। আপনারা নারীকে পরিমাপ করেন তার স্তনের মাপে। নারীবাদ নিয়া আপনাদের কোনো পড়াশোনা- জানাশোনা নাই, আপনারা শুধু অযৌক্তিক তর্ক কইরা অ্যাটেনশান পাইতে চান। গলির টং দোকানে বইসা যে লকলকে দৃষ্টি, জঘন্য মানসিকতা নিয়া আপনারা কুকুরের সঙ্গম দেখেন সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়াই আপনারা নারীবাদকে দেখেন, নারীদেরকে দেখেন।
প্রায়ই আমি সার্কাজম কইরা বলি যে, নারীবাদ নারীকে সুবিধার চাইতে অসুবিধা দিছে বেশি। পুরুষতন্ত্রের সিস্টেম মাইনা নিলে নারী নিশ্চিন্তে একটা জীবন কাটায়ে দিতে পারতো। আমি এমন বহু নারীরে চিনি যারা বাপের, স্বামীর এবং সন্তানের ঘাড়ে ভর কইরা আর অন্য নারীদের নিয়া কুটনামি কইরা একটা জীবন আরামসে কাটায়ে দিতেছেন। নারীবাদী শুনলে তারা ছ্যা ছ্যা করেন অথচ এদের অনেকেই তলে তলে বহু কিছু করেন, জামাই তো দূরের কথা স্বয়ং খোদাও তা জানতে পারেননা। অন্যদিকে নারীবাদে বিশ্বাস করা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন অনেক নারী ওইরকম অসম্মানজনক আরামের জীবন স্বেচ্ছায় ত্যাগ কইরা আসছেন। নারীবাদ বিশ্বাস করার দরুন তাদের দশভূজার মতোন একইসাথে দশদিক সামলাতে হচ্ছে, কখনো হয়তো হিমশিম খেতে হচ্ছে কিন্তু অসম্মানের জীবন তারা বেছে নেন নাই।
আমি নারীবাদী বলতে সেইসব তুখোড় সাহসী নারীদের বুঝি যারা পুরুষতন্ত্রের দেওয়া সকল সুবিধা লাত্থি মেরে ফেলে এসে স্ট্রাগলের জীবনকে বেছে নিয়েছেন, নিজের এবং সামগ্রিক নারীমুক্তির স্বার্থে। এই স্ট্রাগলটা তারা স্লিভলেস প’রে করলেন কি বোরখা প’রে করলেন কি কাপড় না প’রেই করলেন তা নিয়া না ভাবলেও চলবে, কেননা নারীবাদের সুফলগুলি সমাজের সকল স্তরের সকল শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষমাত্রই ভোগ করবেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]