বিশ্বযুদ্ধের হাওয়ায় বদলে যাওয়া নারী, যুদ্ধে নারীবাদ
পর্ব-১১: নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া
শারমিন শামস্।। দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ নারীর জীবন বদলে দিয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থপর সমাজ নিজের প্রয়োজনে নারীকে তখন ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছিল কিছু সময়ের জন্য। তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছিল। তখন সেই সমাজের প্রথা, রীতি, ধর্ম কোনটারই কোন আপত্তি ছিল না। এদিকে যুদ্ধকালীন সময়ে নারীবাদের ভূমিকাও হয়ে উঠেছিল লক্ষ্যনীয়। ফেমিনিস্টরা তখন সমাজে ও দেশে দেশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময় পুরুষদের যেতে হয়েছিল যুদ্ধে। তখন হাজার হাজার নারীকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল বাইরে। পৃথিবীর বিশাল কর্মযজ্ঞে তখন তাদের অংশ নিতে দেয়া হয়। পুরুষের রেখে যাওয়া চাকুরিতে নিয়োগ পায় নারীরা। কলকারখানা ও খামারে কাজ শুরু করে নারী। শ্রমিক শ্রেণির নারী তো আগে থেকেই কাজ করত, বিশেষ করে টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিগুলোতে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর প্রায় সব শ্রেণির মেয়েকেই বাইরের জগতে পা দিতে হয়। নারীরা কাজ শুরু করে শিক্ষক, সেবিকা ইত্যাদি হিসেবে তো বটেই, এর বাইরে যুদ্ধের আগে যেসব কাজে তাদের নেয়া হত না তারা নারী বলে, সেইসব কাজেও তাদের নিয়োগে দেয়া শুরু হল। বিপদজনক বোমাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্রের প্ল্যান্টেও কাজ করতে লাগলেন নারীরা। কেউ কেউ হলেন বাস ড্রাইভার। কেউ চালাতে লাগলেন ট্রেন। কেউ বা কাজ নিলেন ভারি শিল্প কারখানাগুলোতে, কেউ অফিসে যোগ দিলেন কেরানি হিসেবে, অথবা কেউ হলেন দোকানের বিক্রয়কর্মী। ইংল্যান্ডে নারীর জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হল প্রথম নারী পুলিশ কর্মকর্তা।
পৃথিবীর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পেরে নারী আনন্দিত হল। গর্বিত হল। একইসাথে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতারও প্রমাণ দিতে লাগলো একের পর এক। নারী কঠিন ও বিপদজনক কাজে পুরুষের সমান দক্ষ সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। এদিকে কাজের সুযোগ বাইরে পৃথিবীটাও নারীর চোখে ধরা দিল। এমনকি নারী খেলাধুলাও শুরু করল, যেসব খেলা আগে শুধু পুরুষ খেলত। যেমন নারীদের ফুটবল ম্যাচ বিরাট জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল।
সবই চলছিল। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। পুরুষ ফিরে এলো যুদ্ধ থেকে। এসেই তারা ধরে নিল, এখন নারী তার আগের জায়গা মানে ঘরে ফিরে যাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই হল। নারীর জন্য তৈরি হওয়া কাজের সুযোগ আবারো কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে গেল।
বছর কুড়ি পর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫)। আবার বাইরের জগতে পা রাখলো নারী। যোগ দিল কাজে। এবারে একটা পরিবর্তন দেখা দিল, সেটা হল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এক বিশাল সংখ্যক নারীকে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধেও যোগ দিতে হল। তবে তাদের কমব্যাট ফোর্সে দেয়া হল না। রাখা হল সাহায্যকারী ভূমিকায়, যেমন অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট ইউনিটে সার্চলাইট অপারেটর হিসেবে কিংবা ইন্টারপ্রেটার করে।
এদিকে রাশিয়ায় নারীকে রাখা হল কমব্যাট ফোর্সে, প্রায় দুই হাজার মেয়েকে স্নাইপার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধেও পাঠানো হল। কিছু নারী গেলেন বিমানবাহিনীতে। নাজি অধ্যুষিত ফ্রান্স, ইটালি ও পোল্যান্ডে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিল নারী। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত যোদ্ধা নাবিক মেরিনা রাস্কোভা শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে বোমারু পাইলটদের একটি রেজিমেন্ট তৈরি করলেন, যাদের ডাকা হত Night witches নামে। যুদ্ধ শেষে এদের মধ্যে অনেককেই জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
নারীকে নিজের কাজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য দুই দুইটা বীভৎস বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। যদিও যুদ্ধগুলো শেষ হওয়ামাত্র তাদের অবস্থা দাঁড়ালো যুদ্ধের আগের দিনগুলোর মতই। ততদিনে নারীর কাজের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্ষমতাসহ আর যা কিছু প্রয়োজন, সব কিছুই সমাজের সামনে আক্ষরিক অর্থে প্রমাণ হয়ে গেছে।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে নারীবাদ
নারীর জন্য ভোটাধিকার আন্দোলন যখন চলছে, এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভোটাধিকার আন্দোলনে জড়িত কিছু নারীবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন। তারা বললে, যুদ্ধ পুরুষের স্বার্থগত সংঘাতে সৃষ্টি এবং চাইলেই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্যদিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটানো যায়। অন্যদিকে কেউ কেউ বললেন, লিঙ্গবৈষম্যের অবসানের জন্য যদি যুদ্ধ যৌক্তিক হয়ে থাকে, তবে এক জাতির সাথে অন্য জাতির দ্বন্দ্ব হলে সেই যুদ্ধেরও যৌক্তিকতা আছে।
ভোটাধিকার আন্দোলনকারী নারীবাদীদের অনেকে বিশ্বযুদ্ধের কাজে জড়িয়ে গেলেন। ব্রিটিশ নারীবাদী এমিলিন প্যাঙ্কহার্স্ট যুদ্ধে নারীদের নিয়োগের কাজে হাত দিলেন। অথচ তারই কন্যা সিলভিয়া বিপক্ষ ভূমিকায় ছিলেন। তিনি তার খবরের কাগজে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্যদিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর তাগিদ দিতে লাগলেন। সিলভিয়ার মত বহু নারীবাদী শান্তি ও নারীবাদের কথা বলে একে অপরের হাত ধরে প্রচারণা চালাতে লাগলেন।
১৯১৫ সালের এপ্রিলে নেদারল্যান্ডের হাগে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব উইমেন আলোচনায় বসল কীভাবে দ্রুত যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় সেই ইস্যুতে। তাদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকান শান্তিকামী আন্দোলনকারী চেন অ্যাডামস, ডাচ চিকিৎসক আলোটা জ্যাকবস, জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্টিভিস্ট লিডা গুস্তাভা হ্যাইমান এবং হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক রোসিকা স্কুইমার।
কনফারেন্সে দুটি নীতি নির্ধারণ হল। এক. যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুর অবর্ণনীয় কষ্টের কথা তুলে ধরে দেশে দেশে মানুষের ভেতর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। দুই. নারীর ভোটাধিকার, কারণ ভোট দিতে পারলে নারী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব রাখতে পারবে।
কয়েক মাসের ভেতর কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়া শুরু করলেন দাবিদাওয়া নিয়ে। যদিও তাদের সাফ্যল্য সে অর্থে ধরার মত না, তবুও এটা বলতেই হবে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির জন্য মধ্যস্থতার কথাগুলো তারা উচ্চারণ করে গেছেন।
হাগের সভা থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব উইমেন ফর পার্মানেন্ট পিস নামে একটি কমিটিও করা হয়। এই কমিটি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় শান্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে।
অস্ট্রেলিয়ায় ভিডা গোল্ডস্টেইন ও ইলেনর মুরের নেতৃত্বে সিস্টারহুড অব ইন্টারন্যাশনাল পিস ও উইমেনস পিস পার্টি নামের শান্তিকামী দলগুলো স্বাধীনতার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করে।
[চলবে]