November 23, 2024
কলামফিচার ৩

ফ্রিদা কাহলো: কী ছিলো তাঁর রাজনৈতিক দর্শন?

ইমতিয়াজ মাহমুদ।।

ফিদা কাহলোর জন্মদিন গেছে কয়েকদিন আগে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে যে আমাদের দেশে ফ্রিদা কাহলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশ বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণ যারা ওদের মধ্যে আপনি দেখবেন যে ফ্রিদা কাহলোকে হিরো জ্ঞান করা, ওর জীবন ও কাজ সম্পর্কে জানা এই নিয়ে বেশ আগ্রহ। শুধু বাংলাদেশই নয়, দুনিয়ার সবখানেই ফ্রিদা কাহলো যেন সর্বত্র। নারী দিবসের কর্মসূচীতে বা নারীবাদীদের নানা কর্মসূচীতে আমেরিকা ও ইউরোপের বড় বড় সব শহরে দেখা গেছে যে ফ্রিদা কাহলোর ছবি স্থান করে নিয়েছে শোভাযাত্রায়, ব্যানারে ফেস্টুনে এবং নারীদের পোশাকে। আর কেবল নারীবাদীদের কর্মসূচী বা প্রাত্যহিক আলাপ আলোচনায়ই নয়, জনপ্রিয় টেলিভিশন শো বা মূলধারার খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন সেসবেও ফ্রিদা কাহলো উপস্থিত। এমন কি বার্বি পুতুল যারা তৈরি করে, ওরাও একটা ফ্রিদা বার্বি বানিয়ে বাজারে ছেড়েছে। এইসব কর্পোরেট সংস্থার যা কাজ, যা কিছু জনপ্রিয় সবকিছুকেই ওরা বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করে- ফ্রিদা কাহলোকেও করেছে।

ফ্রিদা কাহলোর এবারের জন্মদিনে আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক নারীকে দেখেছি ফ্রিদাকে উদ্ধৃত করে বা ওকে উদ্দেশ্য করে পোস্ট লিখেছেন। অনেকেই ফ্রিদার ছবি- ওর ফটোগ্রাফ, পোর্ট্রেইট বা ওর আঁকা ছবি এইসব পোস্ট করেছেন। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে এইসব পোষ্টের যতগুলি সম্ভব পড়েছি। কী ভেবে আমাদের নারীরা, বিশেষ করে নারীবাদী এক্টিভিস্টরা, ফ্রিদাকে স্মরণ করছেন সেটা জানার আগ্রহে। লক্ষ্য করে দেখলাম, ফ্রিদা কাহলোকে নিয়ে মুগ্ধতা যেন ওর ছবি, ওর ব্যক্তিগত জীবন, ডিয়েগো রিভেরার সাথে ওর প্রচণ্ড আবেগতাড়িত সম্পর্ক, ওর অসুস্থতা এইসবে মধ্যেই সীমিত। এর সাথে হয়তো আছে অল্প কিছু নির্বাচিত কোটেশন- The Diary of Frida Kahlo: An Intimate Self-Portrait বই থেকে বা অন্য কোন সূত্র থেকে। নারীমুক্তি, নারী অধিকার এইসব নিয়েও টুকটাক কিছু কথা অনেকে ফ্রিদার সাথে সম্পৃক্ত করে বলেন, এতে করে ওর নারীবাদী আন্দোলনের সৈনিক ইমেজটা রক্ষা হয় বটে কিন্তু সেগুলিও যেন একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি বা একজন ব্যক্তির একান্ত লড়াইয়ের একটা চিত্র উপস্থাপন করে। এই সবকিছুই ফ্রিদা কাহলো সম্পর্কে অনেকখানি রোমান্টিকতা তৈরি করে, কিন্তু এরা সকলেই যেন ফ্রিদা কাহলোর রাজনৈতিক অবস্থান, তাঁর রাজনৈতিক মতামত এবং রাজনৈতিক দর্শন এইসবকে সযত্নে আড়াল করে।

এইটা শুধু যে বাংলাদেশের চিত্র সেটা কিন্তু নয়। পশ্চিমা গণমাধ্যম, পশ্চিমা কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং বাজার অর্থনীতি এইসব মিলে ফ্রিদা কাহলোকে যেন কেটেছেটে তাঁর নিজের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত করে খানিকটা পশ্চিমা নারীবাদীদের সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আটকে ফেলেছে। আমেরিকাতে একজন এটাকে নাম দিয়েছিলেন ‘কর্পোরেট স্যানিটাইজেশন’। অনেকটা চে গুয়েভারাকে যেমনটা ওরা করেছে। কিন্তু এতে করে তো আপনারা ফ্রিদা কাহলোকে হারিয়ে ফেলবেন- ফ্রিদাকে হারিয়ে সেখানে কেবল একটা অর্থহীন আইকন অবশিষ্ট থাকবে যেটা নিতান্ত ফ্যাশন ইত্যাদি ছাড়া আর কোন অর্থই বহন করবে না।

ফ্রিদা কাহলোর পুরো নাম ছিল ম্যাগডেলেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালডেরন। তিনি নিজে এটাকে সংক্ষেপ ক’রে করেছিলেন ফ্রিদা কাহলো। রিভেরার সাথে বিবাহের পর অফিশিয়ালি ফ্রিদা কাহলো ডি রিভেরাও লেখা হতো বটে, কিন্তু সাধারণভাবে ফ্রিদা কাহলো নামেই দুনিয়াজুড়ে ওর পরিচিতি। জন্মেছিলেন মেক্সিকোতে ১৯০৭ সনে, কিন্তু তিনি নিজে বলতেন যে তাঁর জন্ম ১৯১০ সনে। না, বয়েস কমানোর জন্যে তিনি এটা বলতেন না। ১৯১০ সন ছিল মেক্সিকোর বিপ্লবের বছর, আর ফ্রিদা নিজেকে বলতেন বিপ্লবের কন্যা। এইজন্যেই তিনি নিজের জন্ম সন বলতেন ১৯১০। এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন, সেই থেকে বাকি জীবন তিনি কাটিয়েছেন তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে। জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় তিনি হাঁটতেই পারতেন না বা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। তিনি ছিলেন একাধারে একজন শিল্পী, একজন বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী ও সেই সাথে নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক। কিন্তু তাঁর শিল্পকর্ম বলেন বা নারী অধিকার আন্দোলন বলেন বা লেখালেখি ইত্যাদি যাই বলেন না কেন সবকিছুরই মৌলিক ভিত্তি ছিল তাঁর মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় খুবই কম বয়সে যখন তিনি মেক্সিকো শহরে ন্যাশনাল প্রিপারেটরি স্কুলের ছাত্র। তখন তাঁর বয়স মাত্র চৌদ্দ, শিল্পী হয়ে ওঠেননি তখনো। দুই হাজার ছাত্রছাত্রীর সেই স্কুলে ফ্রিদা ছিলেন একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্য। এর কিছুদিন পড় ষোল বছর বয়সে তিনি মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এর পর থেকে আমৃত্যু তিনি পার্টির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। আপনি যদি Dairy of Frida Kahlo পড়েন তাইলে দেখবেন যে তিনি তাঁর ডাইরিতে লিখছেন ‘প্রতিবিপ্লব-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিজম-ধর্ম-মূর্খতা-পুঁজিবাদ এবং বুর্জোয়া অপকৌশলের এই পুরো কায়দা’ এইসবের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা। তিনি নিজেই প্রবল আগ্রহে প্রত্যয় জানাচ্ছেন, আমি সেই বিপ্লবের অংশ হতে চাই যাতে করে গোটা দুনিয়াকে একটা শ্রেণিহীন বিশ্বে রূপান্তরিত করতে পারি যাতে করে আমরা শোষিত শ্রেণির জন্যে একটা নয়া ছন্দ তৈরি করতে পারি।

ডিয়েগো রিভেরার সাথে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত বছর তিনেক তিনি বাস করেছিলেন আমেরিকাতে। তখন আমেরিকাতে চলছিল তিরিশের সেই মহা মন্দা। সেইসময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন সাথে বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ রূপ। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও শ্রেণিচেতনাকে আরও শানিত করেছিল। সেখান থেকে ফিরে তিনি মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক ও কর্মী হিসাবে আরও বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন। সংগঠক হিসাবে কাজ করতেন, পার্টির জন্যে বক্তৃতা লেখা, বক্তৃতা দেওয়া, তহবিল সংগ্রহ করা এইসব করতেন। যুদ্ধবিরোধী, পারমানবিক বোমার বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে কর্মসূচী করতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে গুয়েতেমালায় নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে আমেরিকার হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মেক্সিকো সিটিতে এক বিশাল বিক্ষোভে হুইল চেয়ারে করে উপস্থিত হয়েছিলেন ফ্রিদা কাহলো।

৩     

আপনি যখন বলবেন ফ্রিদা কাহলো আপনার হিরো বা আপনি যখন ফ্রিদা কাহলোর কথার মধ্যে আপনার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাবেন বা আপনি যখন ফ্রিদা কাহলোর স্পষ্ট কথা, তাঁর নিজস্ব ফ্যাশন তাঁর ছবি তাঁর রঙ তাঁর জীবন দেখে মুগ্ধ হবেন তখন আপনার জন্যে ফ্রিদার রাজনীতি ও ফ্রিদার দর্শনও জানা প্রয়োজন। কেননা আপনি যদি না জানেন কোন রাজনৈতিক দর্শন আপনার হিরোকে হিরো বানিয়েছে তাইলে ফ্রিদাকে হিরো বলা, সেটা হবে কেবল একটা খোকলা অন্তঃসারশূন্য আইকনপূজা মাত্র। কেননা আপনি যখন ফ্রিদার কথার মধ্যে আপনার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দেখবেন তখন আপনি যদি না জানেন কোন রাজনীতিতে তিনি তাঁর নিজের জন্যে তাঁর নিজের মানুষের জন্যে এবং আপনার জন্যে মুক্তির পথ দেখেছিলেন সেটা জানাটাও জরুরী। নাইলে ঐটুকু কথা পড়ে মুগ্ধতা একটা অন্তঃসারশূন্য অর্থহীন গিমিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। আপনি যদি ফ্রিদার ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকেন, ওর ফ্যাশন ওর জীবনের রঙ দেখে যদি আপনার মনে শ্রদ্ধা জাগে, তাইলে আপনাকে জানতে হবে কোন সে দর্শন, দুনিয়া দেখার কোন সে দৃষ্টিভঙ্গি, যেটা ফ্রিদাকে ফ্রিদা বানিয়েছে। নাইলে আপনার আলিয়া ভাটে মুগ্ধতা আর ফ্রিদা কাহলোতে মুগ্ধতার কোন ফারাক থাকবে না।

আর আপনি যদি সিরিয়াস নারীবাদী হয়ে থাকেন বা নারীমুক্তি যদি আপনার রাজনৈতিক ও আদর্শিক লক্ষ্য হয়ে থাকে এবং আপনার যদি মনে হয় নারীমুক্তির জন্যে ফ্রিদা কাহলোর লড়াইটা ও লড়াইয়ের পথটা বুঝে দেখা দরকার তাইলে তো আপনাকে ফ্রিদা কাহলোর রাজনীতি ও দর্শনটা অবশ্যই জানতে হবে বুঝতে হবে।

দেখেন, নারীর সমান অধিকারের কথা যারা বলেন বা নারীমুক্তির কথা যারা বলেন বা কোন না কোনভাবে যারা নিজেদেরকে নারীবাদী মনে করেন, তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যটা কী? লক্ষ্যটা হচ্ছে, এমন একটা সমাজ গড়া যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বিভেদ থাকবে না, রাষ্ট্র নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য করবে না, সমাজ নারীকে পুরুষের অধীন একটি ভোগের পণ্য বিবেচনা করবে না। সেই লক্ষ্যে আপনি কীভাবে পৌঁছবেন? নারীর সমস্যাটা কেবল চিহ্নিত করলে তো হবে না। কেবল সমালোচনা করলে তো হবে না। আপনি বলবেন যে নারীকে এই সমাজ পুর্নাঙ্গ মানুষ বিবেচনা করে না- এই সমানে নারী হচ্ছে ঊন-মানুষ। উত্তম কথা। তাইলে এই সমাজ ভাঙ্গতে হবে না? আপনি বলবেন যে বাজার অর্থনীতিতে নারী কেবল একটি পণ্য মাত্র। সত্যি কথা। ভাল কথা। তাইলে বাজার অর্থনীতি হঠাতে হবে না? একটা ক্রিটিক্যাল প্রজেক্ট নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। নারীর জন্যে নারীবান্ধব পৃথিবী গড়বেন কোন্ পথে, সে পৃথিবীর কী রূপ হবে সেটা নির্ধারণ করতে হবে না?

এইখানেই ফ্রিদা কাহলোর র‍্যাডিকাল রাজনীতি, মার্ক্সবাদী দর্শনে ফ্রিদার আস্থা এইটা বুঝাবার প্রয়োজনীয়তা। আপনি ফ্রিদা কাহলোকে আপনার হিরো মানবেন আর মার্ক্সবাদকে সযত্নে এড়িয়ে থাকতে চাইবেন সেটা তো সততা হলো না। মনে রাখবেন, প্রচলিত এই সমাজ ও রাষ্ট্র, এই বাজার অর্থনীতি, এই ধর্ম, এই সমাজ এইসবকে আঘাত না করে নারীর মুক্তি আসবে না। আর সেই আঘাতের পথটাই ফ্রিদা কাহলোর পথ।

 

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]