November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষ কতটা খেয়াল রাখে সঙ্গীর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি?

তৌকির ইসলাম।। সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করার পর আমরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কথা বলেছি। অনেকেই আবার স্ট্যাটাসও দিয়ে দিল বন্ধুদের উদ্দেশ্যে যে, মন খারাপ হলে স্ট্যাটাস প্রদানকারী ব্যক্তির সাথে কথা বলতে, শেয়ার করতে। এই মনোভাবকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তার আগে জানতে চাই, আমরা সবাই কি আমাদের নিজের পার্টনার বা সঙ্গীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবি? পরের জন্য এত ভাবছি অথচ ঘরের খবর নিচ্ছি না, ব্যাপারটা অনেক বেশি দ্বিচারিতা নয় কি?

প্রথমেই বলে নেই কেন পার্টনার শব্দটি ব্যবহার করলাম। এখানে পার্টনার বলতে আমি বুঝাতে চেয়েছি বিবাহ এবং বিবাহবহির্ভূত যে কোন আবেগতাড়িত সম্পর্ক অর্থাৎ প্রেম-ভালবাসা সম্পর্কীয় সঙ্গী।

এখন আসি মূল কথায়। যখন একজন পুরুষ ও একজন নারী যখন একটি সম্পর্কে বাস করে তখন তারা যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। আমরা যদি একটু খেয়াল করে থাকি তাহলে দেখব যে একটা সম্পর্কে একজন নারীর মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে উপেক্ষিত হয়। হোক সেটা প্রেম, হোক সেটা বিয়ে। একটু বিশ্লেষণ করি।

ধরুন একটি প্রেমের সম্পর্কে অভিমান স্বাভাবিক। ঝগড়া হওয়া স্বাভাবিক। রাগ বা অভিমান ভাঙ্গাতে পারে পুরুষ অথবা নারী যে কোন সঙ্গী, কিন্তু এখানেও রয়েছে একটা লিঙ্গ বৈষম্য। অনেক প্রেমিকের কাছে প্রথম কল অথবা টেক্সট দেওয়াটা যেন তার পুরুষত্বের বলি দেয়া। আবার প্রেমিকাও ভাবছেন যে আমি রাগ করেছি ‘ও’ রাগ ভাঙ্গাবে অথবা ‘ও’ বরাবর এমনই তাই আমি আগে টেক্সট দিয়ে রাগ ভাঙ্গাই। এখন আপনি বলতে পারেন এখানে দোষের কী আছে! রাগ কে আগে ভাঙ্গাবে এটা নিয়ে বিপত্তি নয়, বিপত্তি হচ্ছে এই জেন্ডারবেসড থিয়োরিতে যে ছেলে হয়ে আগে টেক্সট দিলে পুরুষত্ব নিয়ে টানাটানি আর মেয়েরা রাগ করবেই সো ছেলেদের তা ভাঙ্গাতে হবে! রাগ যে কেউ করতে পারে আর যে কেউ ভাঙতে পারে কিন্তু এখানে যখন জেন্ডার ইস্যু চলে আসে তখন তৈরি হয় দূরত্ব। আর পার্টনারদের মানসিক অবস্থাটা ভাবুন তো। জেন্ডার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুজনের মানসিক স্বাস্থ্যের ১২টা বেজে যাচ্ছে। একটা সম্পর্কের মানসিক দিকটা যদি খেয়াল করেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়ে পার্টনারের উপরেই যেন এর দায়ভার। একজন মেয়ে সঙ্গী একটি সম্পর্কে যতটা মানসিক হীনতা, যন্ত্রণায় ভোগেন ঠিক ততটা একজন ছেলে সঙ্গী ভোগেন না। আমি কিন্তু একবারও বলি নি ছেলে সঙ্গী ভোগেন না তবে বলেছি সমান মানসিক যন্ত্রণায় না। ছেলে সঙ্গীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা-চাহিদা-স্বপ্ন-ফিউচার প্ল্যান এসব নিয়ে একজন নারী সঙ্গী যতটা ডিপ্রেশনে থাকেন ঠিক ততটা ছেলে সঙ্গী থাকেন না। এ তো গেল প্রেমের সম্পর্কের কথা। আসুন একটু বিয়ের সম্পর্কে ঢুকি।

আমার কাছে মনে হয় একজন নারীর মানসিক যুদ্ধ শুরু হয় বিয়ের রাত থেকে। নতুন পরিবেশ। নতুন সম্পর্ক। নিজের আপন আলয় ছেড়ে আসার চাপা বেদনা আর অন্যের আলয়কে নিজের করে নেওয়ার যে মানসিক যুদ্ধটা চলতে থাকে তা আমরা পুরুষ সঙ্গীরা কোনদিন অনুভব করতে পারব না। একজন কর্মজীবী বিবাহিত নারীর কথা ধরুন। তিনি অফিস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাস ধরেন, যত দ্রুত গিয়ে ঘরের কাজটা যেন শুরু করতে পারেন আর আমরা পুরুষরা কিন্তু অফিস শেষে বের হয়ে মিনিমাম সময়টুকুও যেদিন থাকে না সেদিনও একটা সিগারেট অথবা এক কাপ চা খেতে খেতে কলিগদের সাথে অফিসের বসের জাত-বংশ উদ্ধার করে বাস ধরি। আর যদি নারী সঙ্গীটি হোম মেকার হোন তাহলে তার ডিপ্রেশন লেভেলটা আরও বড়। হয়তো সারাদিন খেটেও কাজের এপ্রিসিয়েশন নেই কোন। হয়তো নিজের স্বপ্নবলির চাপা আর্তনাদ সবসময় তাকে কুড়ে কুড়ে খায়।

আমি বলছি না পুরুষরা কোন ডিপ্রেশন, মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন না, আমি শুধু বলতে চাইছি আমরা পুরুষরা একই সমানভাবে ভুগি না। আর যেই নারী পার্টনার এতটা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন তার প্রতি আমরা খেয়াল নেই না। আমরা এটাই ভুলে যাই যে তারও হয়তো আকাশটা দেখতে ভালো লাগে, বন্ধুর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, নিজের কিছু শেয়ার করতে ভালো লাগে।

মনের সাহসটা অনেক বড়। পার্টনারের মানসিক স্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের উচিত নয় মানসিক স্বাস্থ্যটাকেও জেন্ডার বেসড করা।

‘ছেলেদের কি টেনশন তা তুমি বুঝবে না! মেয়েদের অল্প কিছুতেই কান্না পায়! ছেলেদের কাঁদতে নেই! মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়! তুমি না পুরুষ মানুষ! মেয়ে হয়ে এতটুকু সহ্য করতে পারো না!’ আমার লেখাটা মুলত এই জেন্ডার বেসড মানসিকতার ব্যাপারে। নিজের সঙ্গীর জন্য অন্তত আসুন মনের জানালাটা উন্মুক্ত করি, পরের জন্য দরজা খুলে দেওয়ার আগে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]