বুলবুল: চুপ করে থাকো
উম্মে ফারহানা।। বুলবুল ছবিটা নিয়ে এত কেন হাইপ- এই প্রশ্ন অনেকেরই। অনেকেই বলেছেন তেমন ভালো লাগেনি, আহামরি কিছু না। সিনেমার অ্যাসথেটিক্সের বিচারে ছবিটা কেমন সেটা বিচারের যোগ্যতা নেই আমার। আমি ফিল্ম ক্রিটিক নই, ছবিতে আমি দেখি কাহিনী, বা বলা ভালো কন্টেন্ট। তো সেই হিসাবে বুলবুল সম্পর্কে আমার বেশ কয়েকটি আলাপ আছে। পাঠকের সঙ্গে সেই আবজারভেশন শেয়ার করার জন্যই এই লেখা।
বুলবুল কি নারীবাদী ছবি? নারীবাদী ছবি বলতে আমরা কী বুঝি? এই জগতের মানুষ কবে থেকে এত মানবিক হয়ে গেলো যে একটি ছবিতে নারীবাদী মেসেজ থাকলেই তাতে আগ্রহী হয়ে উঠবে? বাস্তবে তো দেখি উল্টোটা। এই যে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের লেখাগুলো, লিংক শেয়ার করলেই কিছু মানুষ হামলে পড়ে গালি দেওয়ার জন্য। এই যে আমি, একটা ছাপোষা মাস্টারনি, গলাটা খানিক উঁচু করে কথা বলি বলেই কত মন্দ কথা শুনি, এই জগতে নারীকে টিকে থাকার জন্য কত জোরে চিৎকার করতে হয়, সেসব কথা আর নতুন কী?
বুলবুল কি নতুন কিছু বলেছে? যদি না বলে থাকে, যদি সেই টিপিক্যাল রেইপ রিভেঞ্জ স্টোরি হয়, তাহলে আমি কেন মূল্যবান সময় খরচ করে ছবিটা দেখবো, আবার ছবি নিয়ে একটা আলাপও করে ফেলবো? নতুন কী আশা করি আমরা আজকের নারী লেখক, নারী পরিচালকের কাছ থেকে?
যতটা উঁচু গলায় চিৎকার নারীকে করতে হয় রোজ, সেটিকে ছবিতে দেখাবার দরকার আছে বলে আমি মনে করি। যে সমাজ পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নারীকে বলে চুপ করে থাকতে, স্বামীর কাছ থেকে দাম্পত্য সুখ না পেয়ে ভাসুরের রক্ষিতা হয়েও চুপ করে থাকতে, ধর্ষণের শিকার হয়েও চুপ করে থাকতে, যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একের পর এক শক্তিশালী নারীকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মেরেছে, জোন অভ আর্কসহ অসংখ্য নারীকে উইচক্রাফটের নামে হত্যা করেছে, দেবী বলে পূজা করার সঙ্গে সঙ্গে সতীদাহের নামে পুড়িয়েছে, বিভিন্নভাবে নারীকে সম্পত্তি না দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে, নারীর যৌনসুখ কমাবার জন্য ভগাংকুর কেটে দিয়েছে খৎনা করে, খনার জিভ কেটে নিয়েছে সে শ্বশুরের চেয়ে জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছিল বলে, সেই সমাজে বেঁচে থাকবার জন্য নারীকে আরো জোরে চিৎকার করতে হয় বৈ কি!
লেখাপড়া জানলে, বুঝতে শিখলে, নিজের কথাটা নিজে বলতে পারলে নারীকে কত গঞ্জনা সহ্য করতে হয় সে কি আপনি আমি জানি না? যে নারী প্রতিবাদ করবে সে হয়ে যাবে খল, ধূর্ত, সে হয়ে যাবে পেত্নি, হিন্দিতে ‘চুড়েল’, উল্টো গোড়ালির প্রেতিনী। এই খল হয়ে যাওয়া, খারাপ মহিলা হিসেবে গালি খাওয়ার শিকার কি আমরা প্রতিনিয়ত হই না? নিজের ইচ্ছেমত পোশাকে ছবি তুলে সেটি যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে সাইবার বুলিয়িং আমরা কি সহ্য করি না? কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই অনলাইনে ধর্ষণের হুমকি পাইনা? পাই, কারণ সমাজের দরকার আমাদেরকে ‘চুপ করানো’। চুপ করাবার জন্য সমাজ আপনাকে আমাকে যে কোন সময় ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারতেই পারে। জোরে কথা বলা মেয়েদের প্রতি এই উৎকট বিদ্বেষ সমাজে আজও বিদ্যমান।
আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিন তাঁর উয়োম্যান হেইটিং গ্রন্থে বলেছেন নারীঘৃণার আদিরূপ দেখতে পাওয়া যায় রূপকথায়। স্নোহোয়াইটের সুন্দরী সৎ মা, হ্যান্সেল-গ্রেটেল আর সিন্ডারেলার সৎ মা, সব ডাইনি আর খল চরিত্রেরা সেখানে নারী। ভালো নারীও আছেন, তবে তাঁরা মৃত কিংবা মৃতপ্রায়, স্লিপিং বিউটি একশ বছর ঘুমিয়ে থাকে, স্নো হোয়াইট কাচের বাক্সে পড়ে থাকে। ডোয়ার্কিনের মতে নারীঘৃণার আধুনিক রূপ দেখা যায় চলচ্চিত্রে। সেখানে নারীকে ধর্ষিত এবং নিপীড়িত হতে দেখে দর্শক ‘মজা নেয়’, বলা বাহুল্য, এই দর্শককূল হলো পুরুষ, তারা নারীকে অসম্ভব ঘৃণা করে বলেই নারীর অত্যাচারিত হবার দৃশ্যে তারা ভিজ্যুয়াল প্লেজার পান। লরা মালভি যেটিকে বলেছেন স্কোপোফিলিয়া বা দৃষ্টিসুখ, সেই সুখ পাবার জন্য প্রেমের নয়, ধর্ষণদৃশ্যের প্রয়োজন পড়ে মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ চলচ্চিত্রে এবং হালের জনপ্রিয় বলিউডি সিরিয়ালে সকল শক্তিশালী, উচ্চকণ্ঠ এবং তথাকথিত খারাপ নারীদের আমরা দেখি স্লিভলেস ব্লাউজ প’রে হাতে মদের গ্লাস আর ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বেড়াতে। সমান্তরালে ভালো নায়িকারা শাবানার মতন সর্বংসহা, সকল অন্যায় নির্যাতনের পরেও তাঁরা টু শব্দটি করেন না। অত্যাচারীর মুখের উপরে কিছু বলেন না, দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে কিংবা কালিমাতার মন্দিরে ফরিয়াদ জানানো পর্যন্ত তাঁদের সামর্থ।
এই ভিকটিমহুডের প্রদর্শন দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত, ক্লান্ত এবং ক্ষুব্ধ। তর্কের খাতিরে বলা যায় যে রেইপ রিভেঞ্জের গল্প নতুন নয়, মূলধারার বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিতেও ধর্ষককে শাস্তি দেওয়া নারীর চরিত্র পাওয়া গেছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, সেইসব নারী প্রচলিত ভিক্টোরিয়ান ধারণা ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড হোর’কে প্রশ্ন করে না। সেইসব ছবিতেও ভিক্টিম নারীকে ডাইনি বানানোর সামাজিক ষড়যন্ত্রকে খুলে মেলে ধরে না। উল্টো পায়ের ডাইনি কেন ডাইনি হলো, কীভাবে হলো সেই প্রশ্ন করে বুলবুল, ডাইনি আর দেবীর মধ্যে যে খুব সরল সাদাকালো বিভাজন নেই সেই কথাটাই পরিষ্কার করে বলে দেয়।
রূপকথা হিসেবেও যদি দেখেন বুলবুল ছবিটি, তাহলেও এটি অন্যান্য রূপকথা থেকে আলাদা। ডোয়ার্কিন যেমন বলেছেন, পুরাণে, মহাকাব্যে, সাহিত্যে, ইতিহাসে যেভাবে লিলিথকে, ক্লাইটেমেনেস্ট্রাকে, মিডিয়াকে, কালিকে, হেলেনকে, ফাতেমাকে কলংকিত করা হয়েছে, খল বা ডাইনি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেভাবে নারীকে দেখানো হয়েছে সকল পাপের, সকল দুর্ঘটনার হোতা হিসেবে, বুলবুল তেমন চরিত্র নয়। তাকে এবং তার জা বিনোদিনীকে এক কথায় ভালো বা মন্দ বলে ক্যাটাগরাইজ করা যায় না। এমনকি প্রধান তিনটি পুরুষ চরিত্র (সুজিত বাদে), ঠাকুরেরা তিন ভাই- এদের কাউকেই এক কথায় হিরো বা ভিলেন হিসাবে আখ্যা দেওয়া যায় না। পুরুষতন্ত্রের এজেন্ট হিসাবে কাজ করা এই চরিত্রগুলো ব্যক্তি হিসেবে একজন জমিদারের আর্কিটাইপ, একজন প্রতিবন্ধী, আরেকজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সন্দেহপ্রবণ যুবক। যেভাবে বুলবুলকে ডিমনাইজ না করেই চিত্রায়িত করা হয়েছে, একইভাবে নিপীড়ক, ধর্ষক এবং হত্যাকারীকেও কোনমতেই অমানবিক মেলোড্রামাটিক অসুর বা রাক্ষস হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়নি।
এই ব্যাপারটি দুই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
১. ধর্ষককে ডিমনাইজ করে এক ধরনের মানসিক সান্ত্বনা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভাবখানা এমন যে ধর্ষক মঙ্গলগ্রহ থেকে উড়ে আসা কোন উদ্ভট জন্তু; আসলে যে সে আমাদের সমাজের অংশ, আমাদের পরিবারেরই সদস্য, সেই বাস্তবতাকে খানিক আড়াল করার চেষ্টা চলে। এখানে তা করা হয়নি।
২. ধর্ষণ নারীর বিরুদ্ধে ঘটা মানবতাবিরোধী অপরাধ, এর মূল কারণ নারীর অসহায় আর দুর্বল হওয়া। অনেক সময় পুরুষ এবং ছেলেশিশুরাও ধর্ষণের শিকার হন, যখন তাঁরা প্রান্তিক, অসহায় এবং শক্তিহীন থাকেন। কাজেই ধর্ষণ আসলে একটি শক্তির প্রয়োগ। পুরুষ তার লৈঙ্গিক অবস্থানের জন্যই ধর্ষণ করার ক্ষমতা পেয়ে যায়, এমনকি একজন প্রতিবন্ধী পুরুষও ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে। তার স্বল্প বুদ্ধিতেও সে বোঝে নারী নিপীড়নযোগ্য। অর্থাৎ ধর্ষণের মতন জঘন্য অপরাধের মূলে রয়েছে ধর্ষিতের প্রান্তিক অবস্থান এবং ধর্ষকের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ। মানুষের মধ্যেই যারা এই ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পাবে এবং সাজা হবে না বলে জানবে তারা ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে।
মূলত, নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে না পারা ধর্ষণের জন্য দায়ী। এর সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক যতটা ক্ষমতার সম্পর্ক, তার চেয়ে বেশি। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কাঠামোকে ভেঙ্গে না দিলে ধর্ষণ ঠেকানো যাবে না। হরর বা গথিক জনরা হিসেবে বুলবুলের শেষ দৃশ্যে পুড়ে যাওয়া বড় বউয়ের প্রেতাত্মা হাজির হওয়ার দৃশ্যটি সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে দেখানো হলো কি না সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, এই ছবিতে নারীর ক্ষমতা এবং শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সমাজের ভ্রান্ত ধারণার মূলে একটি কুঠারের আঘাত হয়তো করা গেছে। শক্তিশালী নারীকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে একটা চিৎকার হয়তো দেখাতে পেরেছেন পরিচালক।
চুপ করে থাকতে বাধ্য হতে হতে যখন আমাদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন এইটুকু চিৎকারই বা কম কী?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]