November 25, 2024
কলাম

সম্পর্ক ও ব্রেক আপ: থাকুক মানবিকতা, শ্রদ্ধা

আঞ্জুমান  রোজী।। যে কোনো সম্পর্কই সুন্দর এবং পবিত্র, যদি তা সততা, বিশ্বাস আর আন্তরিকতার ওপর নির্ভরশীল হয়! হতে পারে সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক; প্রেমের সম্পর্ক; কিংবা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। সম্পর্ক হওয়ার জন্য কোনো দিনক্ষণ বা সময় নির্ণয় সম্ভব নয়। সম্পর্ক অনেকসময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাহুতভাবে হয়ে যায়। ধীরে ধীরে নানা রকম বাঁক ঘুরে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যায় মানুষ। মানুষ যে সম্পর্কের মধ্যেই জড়াক না কেন; সেই সম্পর্কের শুদ্ধতা রক্ষা করা উভয় পক্ষের কাছেই গুরুদায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বাস্তবে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার করুণ কাহিনীর ঘনঘটাই দেখি বেশি।

সম্পর্কের মধ্যে যখন ভুল বোঝাবুঝির কারণ ঘটতে থাকে; তখন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভুলের অবসান ঘটিয়ে ফেলা উচিত। ভুল বোঝার কারণ প্রথমত এক পক্ষ থেকে শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে দুপক্ষের মধ্যে সেই ভুলের ডালপালা বিস্তারলাভ করে। প্রথমপক্ষ যখন ভুল করে, তখন ভুল স্বীকার করে নেওয়াই উত্তম। কিংবা ভুল বুঝে নিয়ে, ভুল ভাঙ্গিয়ে দেওয়া শ্রেয়। অন্যথায় সম্পর্কে ফাটল ধরতে বাধ্য। আর যদি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে, একপক্ষ আনাড়ি টাইপের আচরণ করে যায়; তখন বুঝে নিতে হবে, এই সম্পর্কের প্রতি সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। কিংবা নতুন  কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে! তাছাড়া অন্য কোন কারণও থাকতে পারে! সে-যাই হোক! একপক্ষ সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে; অন্যপক্ষ ধীরে ধীরে নীরব ভূমিকায় চলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক!

তবে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বা সমাপ্তি টানতে হলে যে কোন এক পক্ষকে সরাসরি মুখোমুখি বসে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া উচিত। তা না হলে, অন্যপক্ষ সম্পর্কের টানাপোড়নে থাকবে! তাছাড়া বলে-কয়ে বিদায় না নিয়ে গোপনে আড়ে-আবডালে যদি একপক্ষ এড়িয়ে যায় বা অবহেলা করে কিংবা প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তাহলে বলবো, এটা একটি অনৈতিক, অমানবিক প্রচেষ্টা। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে গেলে যে কোন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। এতে করে কেউ দূরে সরে গেলেও ভুল বোঝার অবকাশ থাকবে না! এমনকি একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা, মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকবে!

বেশিরভাগ নারী পুরুষ সম্পর্ক শেষ করার দায় নিতে চায় না। এমনকি বলে-কয়েও এর সমাপ্তি টানে না। এক ধরণের অবহেলা, অপমান আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যায়। এই কাজটা যে কত বড় অন্যায়, অনৈতিক, অমানবিক এটা বোধহয় অনেকেই বোঝেন না কিংবা উপলব্ধি করেন না! যে বিষয়টা দেখতে পাচ্ছি সমকাল পত্রিকার সাংবাদিক পারুলের ক্ষেত্রে। একা একা সম্পর্কের দায়ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। বিচারহীনতার দেশে বিচার চাচ্ছে। যেখানে অধিকাংশ পুরুষ মনে করে, এসব কোনো বিষয়ই না; যে পুরুষ চলে যায়, তাকে ছেড়ে দেয়া শ্রেয় মনে করে। কিন্তু কতটা ক্ষত নিয়ে একটা নারী সম্পর্ক ভাঙ্গার যন্ত্রণায় ভোগে সেটা পুরুষের অনুভূতিতে আসে না। একটা সম্পর্কের ভিত হলো কমিটমেন্ট, যে কমিটমেন্ট দাঁড়িয়ে থাকে সততা আর বিশ্বাসের উপর। সেই সততা, বিশ্বাস যখন ভেঙ্গে যায় তখন মনও ভেঙ্গে যায়। কমিটমেন্ট না রাখতে চাইলে আলাপ আলোচনা করে তা ভেঙ্গে দিতে পারে। কিন্তু যখন প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তখন সেই পুরুষটিকে বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ যে সে কতবড় অন্যায় করেছে! শাস্তির কিছু ব্যবস্থা তো থাকতেই হয় ।

সম্পর্ক যখন সুন্দর ছিল, মধুময় ছিলো, সেসব কথা মনে করেই কিন্তু সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে সম্পর্কের ইতিটানা যায়। অথচ অনেকেই এই কাজটা না করে কেমন যেন এড়িয়ে যায়, নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এতে অপরপক্ষ যে কতটা ভেঙ্গে পড়তে পারে বা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হতে পারে, তা মোটেও বোঝে না বা আমলে আনে না। আমি আবারও বলছি, বিষয়টা শুধু অন্যায়ই না, মহাঅন্যায় এবং অমানবিক। একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের চরম অপমান। কাউকে দেওয়া এই কষ্ট এক সময় অভিশাপ হয়ে কষ্টদাতার বুকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে, আসেই! ইতিহাস তাই বলে! কষ্ট দেওয়ার সময় কোন কষ্টদাতাই এই ব্যাপারটি ভাবে না বা মাথায় রাখে না! বিষয়টা নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।

পশ্চিমাদেশে এই বোধটা বেশ সচল। কেউ সম্পর্কের ইতিটানতে চাইলে, বলে-কয়ে বুঝিয়ে সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটায়। কিংবা যে কোন গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজে বের কর। কাউকে হেয় করা, অপমান করা বা ছোট করার অবকাশ নেই। সবাই বোঝাপড়ার একটা স্তর থেকে একে অপরকে বুঝে নেয়। এটা হলো মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের প্রতি পরম শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এমন অনেককেই দেখেছি যারা আমাকে এসে বলেছে, ‘‘আমাদের ব্রেক আপ হয়ে গেছে।’’ আমি জিজ্ঞেস করি, ‘‘কীভাবে?’’ তখন সে বললো, ‘‘গতকাল আমাকে ডিনারের অফার করে ব্রেক আপের কথা বলেছে!’’ বিষয়টা সহজ না, তবে সুন্দর। মেয়েটা আবার ধীরে ধীরে নতুন করে জেগে ওঠে।

পৃথিবীটা সুন্দর এবং বিশাল। শুধু একজনের জন্য জীবন ব্যর্থ হবে কেন? এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন৷ যে চলে যেতে চায়, বোঝাপড়ার মধ্যদিয়ে তাকে চলে যেতে দেওয়াই ভালো। সম্পর্ক থাকুক আর নাইবা থাকুক, অন্তত মানুষ হয়ে যেন একে অপরের পাশে থাকি। মানুষ মানুষের জন্য। বলা যায়না কখন কোথায় কে কীভাবে কাছে আসবে! তাই সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক, অন্তত মনুষ্যত্বটুকু অটুট থাকুক, থাকুক মানবিক যোগাযোগ! সেইসাথে থাকুক একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]