September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

মা বাবা হয়ে মেয়ের জীবন অঙ্কুরেই নষ্ট করবেন না!

নুসরাত নুরশিয়া।। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক অহেতুক চাপিয়ে দেয়া নিয়ম বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। নিয়মটা হলো অন্যের দাসত্ব করার জন্য শৈশব কাল থেকেই একটি মেয়ে কে শারীরিক এবং মানসিকভাবে তৈরি করা হয়। এটি খুব ভুল একটি প্রক্রিয়া, যা একজন মানুষের জীবনের সামগ্রিক সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

সামাজিক বৈষম্য, নিগ্রহ এই নেতিবাচক কথাগুলো এড়িয়ে ভাবার চেষ্টা করি সবসময়। কিন্তু ঠিক এই মুহুর্তে যে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করবো তাতে ওই শব্দগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

জন্মের পর থেকেই শুরু হয় নারী জীবনের গ্লানি। মেয়ে জন্ম দেওয়া নারীটির প্রতি তার পরিবারের অনেকেই ততক্ষণে অখুশি হয়ে গেছেন। মা মেয়ের যত্নআত্তিতে এর কুপ্রভাব পড়তে শুরু করে। অনেক হবু মা তো ছেলে জন্ম দেয়ার দুশ্চিন্তায় নিজের প্রেগ্রনেন্সির সময়টাই ঠিকমতো উপভোগ করতে পারেন না। আর সমাজ ততক্ষনে দুখি মনে মেকি হাসিমুখে একে ওকে বলে বেড়ান ‘‘ছেলে যা মেয়েও তা’’।

এই রূঢ় পৃথিবীতে সদ্যজাত ‘নারী’ প্রাণটিকে স্বাগতম জানানোর ক্ষেত্রে তার পরিবারে যে সূক্ষ বৈষম্যটুকু হয় সেটুকু আবার সজ্ঞানেই এড়িয়ে যান সবাই। জ্ঞান হওয়ার পর তার শৈশব, কৈশোরকে ধুলায় মিশিয়ে জাগতিক, অতিজাগতিক সবকিছু শেখানোর সাথে সাথে খুব কৌশলে তাকে এটাও শিখিয়ে দেয়া হয় যে, এটা তোমার নিজের বাড়ি নয়, তুমি এখানে অস্থায়ী এবং তোমাকে চলে যেতে হবে। এরপর থেকে সে সচেতন এবং অবচেতন মনে অন্য কোথাও যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। মেয়েটির বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, স্থাপত্যের প্রতি যতই আগ্রহ থাকুক না কেন, সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যায় তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে আগ্রহী করার চেষ্টা চলে সংসার গুছিয়ে রাখার মতো বিষয়গুলোতে। সে বুঝে নেয় প্রজন্ম ধরে তার মা এভাবে এসে থেকে গিয়েছেন এবং সবাই এটাই করে। ব্যাস, হয়ে গেলো। মেয়েটি নিজেকে নিজের বাড়িতেই আশ্রিত ভেবে বেড়ে উঠতে থাকে এবং ভবিষ্যতে সে একজন আত্মমর্যাদাহীন,পরনির্ভরশীল, অক্ষম নারীজীবন পার করে। এটা কতটা ভয়ংকর অনূভুতি তা হয়ত লিখে বোঝানো অসম্ভব। বহু মেয়েকে দেখেছি ‘‘আমি যাচ্ছি বাবা’’ গানটি শুনতে!

একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে মেয়েদের নিজের পরিবারেই আর জায়গা হয় না। আহা কি যে এক দুঃসময়! মনস্তাত্বিকভাবে মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে সংকোচ নিয়ে থাকতে হয়। হঠাৎ-ই পাল্টে যায় পরিবারের আপনজনদের আচরণ। শাড়ি পরিয়ে ট্রে হাতে তাকে একদল উৎসুক মানুষের মধ্যে ছেড়ে দেতে পারলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন অভিভাবকেরা। এই যে সমাজ তাকে তৈরি হওয়ার আগেই যুদ্ধের ময়দানে নিক্ষেপ করে, এক অনিবার্য অনিশ্চয়তায় ফেলে বা তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাই বা কী? দুষ্টচক্রে পড়ে যাওয়া পরিস্থিতির শিকার একজন নারীকে ভেবে নিজের মধ্যে হাহাকার বোধ করি। আমি কি এর দায়ভার এড়াতে পারি? না,পারি না।

নিজের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ, এক কথায় বলতে গেলে নিজের জন্য নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা অর্জন করতে যে যুদ্ধ করতে হয়েছে তা পরিবার পাশে থাকলে সহজ হতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিনগুলিতে দেখতাম হলের আপুরা পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও ‘বাড়ি’ যেতেন না। ভেবে নিতাম এমনিতেই হয়ত যান নি। সময় গড়িয়েছে নিজের বেলায়, সেই অভিজ্ঞতা হওয়ার আগেই পরিবার থেকে ব্যবস্থা হয়ে গেলো! হল থেকে সোজা শ্বশুরবাড়ি। আমার আধুনিকমনা পরিবার সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েকে আর কিছু দিন নিজের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলেন না।

এরপরে ঘটনা যা হওয়ার তাই হলো। ফেরত এলাম সেখান থেকে কিছু দিন পরেই। ততদিনে অনেক সময়, সম্ভবনা শেষ হয়েছে, কেননা আমার পরিবার একজন পুরুষ অভিভাবক যোগার করে দিয়ে নিজেদের দায় মিটিয়ে ফেলেছিলো এবং অন্য কাজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। পরিবার থেকে বুঝিয়ে দেয়া হলো এবার অবলা হয়ে থাকো, আর কোন রাস্তা নেই। অনেক ঘাটজল খেয়ে ঠিক করলাম অন্য পথে হাঁটার। সে গল্প আরেক দিন।

একটা মেয়ের নিজেরই পরিবার পড়াশোনা শেষ হতে বা না হতেই মেয়েকে স্বাবলম্বী হওয়ার ফুসরতটুকু দেয় না কেন? এক কথায় পঙ্গু করে,অসহায় জুবুথুবু করে পাঠায় কেনো অন্য কোথাও? ছেলের বেলায় দিব্যি পড়াশোনা শেষ, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ব্যাপক তাড়া। মেয়ের বেলায় বাড়িতে জায়গা নেই!

মায়ের সংসারে মেয়ে সন্তানের জায়গা হয় না, নিরাপত্তা পায় না, এই মা’টি কি জানেন না তিনি নিজে কী জীবন কাটিয়েছেন! তবুও মায়েরই যেন তাড়া বেশি। মা  মেয়েটির সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে বলতে পারেন না আমি যা করেছি তুমি তা করবে না। আমার পরিচিত সফল-অসফল বড় আপু এবং বান্ধবীরা এখনো অনেক কাল বাড়ি যান না। মেসে থাকেন, হলে থাকেন এমন। সংসার আপনার মেয়েকে কী দেয়? থাকা, খাওয়া, সামাজিক এবং আর্থিক নিরাপত্তা?

জেনে রাখুন এগুলোর বিনিময়ে আপনার মেয়েকেও পরিশ্রম করতে হয়, হাজারটা কথা শুনতে হয়, সবার মন জুগিয়ে, ইচ্ছে না করলেও বিবাহ অন্তর্ভুক্ত বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হয়। ভেবে দেখুন, যে মেয়েটাকে জন্ম থেকে বড় করে আপনারই আর সহ্য হয় না, উঠতে বসতে খেতে বসে তাকে কথা শোনান, সেখানে হঠাৎপরিচয় হওয়া মানুষেরা তাকে আর কতটুকু সম্মান, ভালোবাসা দেখিয়ে গ্রহণ করবে? তার চেয়ে বরং মেয়েকে আপনার বাড়িতে আর কিছুদিন থাকতে দিন, তৈরি হতে দিন, সে নিজের পরিচয় নিজে তৈরি করতে পারবে। আপনিও তখন নিজেকে তার মা, বাবা, ভাই বলতে পেরে গর্বিত বোধ করবেন। পেছন থেকে আর টেনে ধরবেন না, প্লিজ। প্রজাপতির মতো জীবন হওয়ার কথা যাদের, সমাজ,পরিবার হয়ে অযৌক্তিকভাবে সেই সুন্দর জীবনগুলো আর অঙ্কুরেই নষ্ট করবেন না।এর দরুন ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবার, সমাজ, সভ্যতা।

নারীর আছে মেধা, অদম্য শক্তি, মুক্ত মন এবং আত্মবিশ্বাস। নারী জানে সে কী চায় আর কী চায় না। এবং সে মোটেও সরাসরি হ্যাঁ বা না বলতে ভয় না। নারী অবশ্যই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে তার ব্যাক্তিগত জীবনের যে কোন কাজের জন্য তাকে ‘জাজ’ করার অধিকার আর নিজের এবং উপরওয়ালা ছাড়া আর কারো নেই, এবং সে এও জানে যে কোনকিছু নিয়ে সারাজীবন বসে থাকার কিছু নেই!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]