কী হবে এই মৃত্যুর কারণ জেনে?
সাদিয়া মেহজাবিন।। ২১ জুলাই, ২০২০। সম্ভবত এই দিনে প্রকৃ্তি তার সকল কান্না আমাদের দেবে বলে আগে থেকে এক নীল নকশা করে রেখেছিল। সামান্য একটি কল আমাদের এক মায়ের, এক ভাইয়ের বুকভাঙা কান্নার মুখোমুখি করেছে। আমরা জানতে পারলাম আমাদের সকলের প্রিয় এক দিদি এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। এই প্রথম আত্মার রেজিস্ট্রি হতে আমি দেখলাম।
প্রশান্তির এক নিদ্রার জন্যে গলায় ফাঁস দিয়েছে প্রিয় সে দিদি। দিদির সেই প্রাণবন্ত হাসি মুখ বারবার সকলের কাছে এসে যেন বলছে, “এবার তবে যাই?”
সারারাত এক নির্ঘুম রাতের পর আমরা দুপুর নাগাদ যাই শ্মশানে। গিয়ে দেখি হাসি হাসি মুখের সে মেয়ে তীব্র প্রশান্তির ঘুম দিচ্ছেন। মায়ের কান্নার সেই শব্দ প্রকৃতির সকল দরজায় গিয়ে বলেছে, “আমার মেয়ে কই? কীভাবে থাকব আমি এখন?”
দিদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় মুখ। মহসিন কলেজের সেরা ছাত্রী, খাস্তগীর স্কুলের প্রাণবন্ত চেনা চেহারা। সারি সারি করে সবাই কেবল দেখছে কেন এই প্রয়াণ? বন্ধু, বড়দাদারা, দিদি সকলের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া। এই সেই প্রিয় মেয়ে নিলম না, যে আমাদেরকে দেখলে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরত। সবসময় হাসিমুখের এই মেয়ে কেন এমন করেছে জানতে হাজার মানুষের বিলাপ।
অঝোর ধারে বৃষ্টির এই মায়া সকলকে ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু মায়ের সেই বিলাপের চেয়ে বেশি না বৃষ্টিপতনের শব্দ। মা অনবরত চুমু খাচ্ছেন আর বলছেন, “ওজি ইন্দিলা ক্যান হাসি হাসি এরে আঁরে এদিন দুগ দি গেলি?” মায়ের সেই মুখ তখন আমার কাছে নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর মত নিষ্পাপ মনে হয়েছে।
বিলাপের পালা চলছে, চলবে। আমরা পাশে বসে আছি একবার শেষ দেখব বলে। দিদি এখনো হাসি মুখ নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে নীল এক পদ্ম গঙ্গায় বসে হেসে চলেছে অবিরাম। তখন মায়ের প্রত্যেক চুমুতে যেন আমি দিদিকে বলছি, “কেন এমন করলে? মায়ের কথা কেন ভাবনি?” দিদি হয়তো বা বলছেন, “বেঁচে থাকা খুব ভার ছিল রে!” ঠিক তখন পাশ থেকে এক লোক বলে উঠল, “এই সে মেয়ে যার জন্যে আমার সন্তান বৃত্তি পেয়েছে।”
কেন এই নীল নকশা সবাইকে কাবু করল? এবার সকলের যন্ত্রণার পাল্লাকে আরো ভারি করে দাহ করার পালা। আমি এই প্রথম দেখলাম কীভাবে চোখের সামনে আমারই এক দিদিকে আগুলে পুড়িয়ে ফেলা হবে। সবাই বলে যে মারা গেছে তার আর কীসের ব্যাথা। হায়! আগুনের প্রত্যেকটা হলকা সকলের মনে বেদনার হল্লা বাজিয়ে চলেছে অবিরাম। দিদির বড় ভাই সকল আচার অনুষ্ঠান মেনে গিয়েছে, নিজের একমাত্র বোনকে আগুন দিতে। যে বোনকে ছোট থেকে পিঁপড়ার কামড় থেকেও বাঁচিয়েছে আজ তাকেই দাহ করবে।
মনে হয়েছিল প্রকৃতি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আগুন দেওয়া হয়েছে। পুড়ছে। আগুনকে তখন আমার কোন এক পাহাড়ের মহা প্রলয় মনে হয়েছে। মানুষ পোড়ার গন্ধও বুঝি হয়? এও ছিল সকলের কপালে? বিকট সে গন্ধ সকলের দম বন্ধ করে দিয়েছে। সময়ের এক স্তব্ধতায় আমরা ছিলাম। সময় যেন এবার আমাদের থেকে প্রতিশোধ নিল।
দিদির ছাই মা যত্নে তুলে ধরেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে ভারি বস্তু সম্ভবত এটি। সব পালা শেষ করে এবার দিদি ছাই হয়ে গেছে। সকলের মনে একই প্রশ্ন- কেন এমন করা? সমাজের কালো দিকের তো শেষ নেই। সকলে এখনো ব্যস্ত প্রমাণ করতে, সম্ভবত প্রেমের কারণেই এই কাজ।
না, আমি জানি সমাজের এই কালো দিক, সমাজের এই ছায়া দিদি আর নিতে পারেনি। আমাদের সমাজে দেহের মৃত্যুর রেজিস্ট্রি হলেও আত্মার হয় না। তাই তো কখন সে আত্মা মরে গেলো, হাসি মুখ এই মেয়ে কাউকে বুঝতে দেয়নি। ভিতরের গভীর এক বিষন্নতা দিদিকে খেয়ে চলছিল বারে বারে। আমি চাই না কোনো কারণ জানতে। জেনে কী হবে? মা তার মেয়েকে ফিরে পাবে? তবে সমাজে এখন কী পরিমাণে মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন তা বলে বলে আর চাই না নিজেকে বোকা প্রমাণ করতে। এখন প্রতি ৪০ সেকেন্ডে এক জন মানুষ আত্নহত্যা করছে। আপনি আমি কখন সচেতন হব আমি জানি না। তবে আমি বারবার ক্ষমা চাচ্ছি প্রিয় মানুষদের বেদনাকে আবার খুঁড়িয়ে কাগজে কলমে আনার জন্যে।
দিদি ভালো থেকো। আমার কাছে এখনো মৃত্যু প্রশান্তির, আনন্দের, নিজেকে এক অন্যভাবে চেনার, নিজেকে নিজের মত করে পাওয়ার।