September 20, 2024
জীবনের গল্পফিচার ২

“আমি মনে করি আমি খোদার এক বিশেষ সৃষ্টি”

সাদিয়া মেহজাবিন।। যত বেশি অন্যের গল্প শুনব কিংবা ভাবের আদান প্রদান করব আমরা তত বেশি মানবিক হয়ে উঠব। বিংশ শতাব্দীর এ সময়ে আমাদের বেশি প্রয়োজন মানবিকতার। এই মহামারীতে মানবিকতাই পারে আমাদের বদলে দিতে। সমাজে এখনো আপনি ব্যতিক্রমী ভাবনার জন্যে অবজ্ঞার শিকার হতে পারেন। সময় এখন বদলে গেছে, এখন নিপীড়িত মানুষের কথা সকলে বলছেন। তবে আজকে যার গল্প বলছি তার অনেক দুর্দশার পরেও তিনি এক সাহসী যোদ্ধা এবং সফল এন্ড্রোজিনি।

ভাবছেন মাইকেল জ্যাকসন কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা বলছি? না, তাদেরকে নিয়ে লেখার সাহস আমার হয়নি তবে আজকে যাকে নিয়ে লিখছি তিনিও সাহসী এক মানুষ। আপনাদের তথাকথিত ভাষায় এক হিজড়া বা মাইগ্গার গল্প বলছি যিনি আমাদের নিপীড়ন আর অবজ্ঞাকে দূরে ফেলে জীবনযুদ্ধে সফল কর্মজীবী।

তার নাম সজীব সতেজ। নামের মতই তিনি সতেজতায় ভরা। ৬ বা ৭ বছর বয়সেই বুঝে গিয়েছেন তিনি অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। শারীরিক দিক থেকে তিনি পুরুষ তবে মানসিকতা এবং অন্য কিছু ক্ষেত্রে মেয়ের মত। আমরা সবাই জানি এমন মানুষদের আমাদের সমাজ কিভাবে পিষে ফেলে। তাকে পারেনি পিষে ফেলতে। স্কুল জীবন শেষ করে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে এবং উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ থেকে ভালো ফলাফল করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেছেন।

ভাবছেন একজন হিজড়া কীভাবে এত দূর গিয়েছেন? খুব মনোবল না থাকলে তা সম্ভব নয়। কেবল কাগজের বিদ্যা নয় তার আছে নাচের বিদ্যা। নাচকে অসম্ভব ভালোবাসেন বলেই নাচকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথম আলো বন্ধুসভা, সজীব সতেজ ড্যান্স গ্রুপ, আস্হা একাডেমি, প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বাতিঘর  স্কুল এমন বিভিন্ন সংঘের সাথে নৃত্যশিল্পী হিসেবে আছেন। এখন বান্দরবান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কর্মরত আছেন। উপেক্ষাকে পাত্তা না দিয়ে তিনি এখন সফল। পাশে পেয়েছেন সবসময় মা এবং বোনকে। তার সাথেই কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিলো। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে গুছিয়ে তার কিছু কথা সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। অবিকৃভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

“আমি ছোট থাকতেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি ব্যতিক্রম। আমার চাহিদা অন্য দশ পুরুষের মত নয়। আমার মা বাবা বুঝে গিয়েছেন তবে প্রথমে মানতে পারছিলেন না। ভাবছিলেন চোখ বুজে থাকলে সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমি জানি আমার এই সমস্যা ঠিক হবার নয় যদিও এটা কোনো সমস্যা নয়। আমি স্কুল জীবন বা সমাজ থেকে হাজার অবজ্ঞার শিকার হয়েছি। তবে আমি ভালো সময়কেই মনে রাখতে চাই। আমার এক বান্ধবী ছিল, নাম পূজা। সে সবসময় আমাকে আগলে রাখতে চেয়েছে। আমার মা বোন আমাকে সাহায্য করেছেন অসীম। আমি অনার্স প্রথম বর্ষে সবাইকে জানিয়ে দিই আমি এমন। তখন থেকেই আমি নাচের সাথে যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানে যেতাম। নাচকেই ভালোবাসি। আমাকে অনেক আগে থেকেই হিজড়া, মাইগ্গা এসব শুনতে হয়েছে। আমি মন খারাপ যত না করেছি তার চেয়েও দেখেছি আমার কিছু বন্ধু, শিক্ষক আমাকে কত উৎসাহ দিতেন।

আমি নাচকেই জীবন করে নেব ভেবে পড়াশোনা করতে চাইনি কিন্তু মা বলেছেন যেহেতু তুমি ব্যতিক্রম তোমার একটা শিক্ষার কাগজ খুব দরকার, নাহলে তোমাকে তারা ছুড়ে ফেলে দেবে। তাই পলিটিক্যাল সাইন্সে পড়ি, এর মাঝে নাচের বিভিন্ন সংঘের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমার খারাপ লাগত যখন ইউনিভার্সিটিতে এসে আমি শিবিরের এক বড় ভাইয়ের জন্যে হলে রুম নেওয়া থেকে কত ঝামেলায় পড়ি। আমি নানাভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছি। অনেকে খারাপ প্রস্তাব দিয়েছে, আমি রাজি হইনি। তখন বিভিন্ন ভাবে আমাকে ঝামেলায় ফেলেছে। আমার ফেবু আইডি হ্যাক করে আমাকে লজ্জায় ফেলেছে। আমি কখনোই এসব দেখে বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবিনি। ভেবেছি আমি যদি চলে যাই আমার মত যারা আছেন তাদের কী হবে, আমার মা বাবা যারা এত কষ্ট করেছেন তাদের কী হবে।

আমি আমার মত যারা আছে তাদের জন্যে কিছু করতে চাই। আমি আমার মত অনেককেই সাহায্য করে, উৎসাহ দিয়ে তাদের করুণ জীবন থেকে ফিরিয়ে এনেছি। এখন নাচকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। তবে কর্পোরেট অফিসে কাজ করতে চাইনি কেননা এ সমাজ সে কথা ভাবার নামও মুখে আনতে দেয়নি। তাছাড়া আমি চাইনি মুক্তমনা, সাংস্কৃতিক মন থেকে সরে গিয়ে করর্পোরেট কাজে যেতে। তারা হয়তো বা আমাকে সেখানে কুলষিত করে ফেলতো।

আমি এখন কাউকে ভালোবাসতে ভয় পাই। অনেকেই আমাকে প্রস্তাব দিয়েছেন কিন্তু আমি চেয়েছি আমার নাচকেই ভালোবাসতে। তাদের কাউকে বিশ্বাস করতে আমার ভয় হয়, কেননা এ সমাজের সব কালো চোখ আমি দেখেছি। আমি নিজেকে এত ভালোবাসি সে জন্যে আমি আজ এখানে। আমি মনে করি আমি খোদার এক বিশেষ সৃষ্টি। যিনি আমাকে দিয়ে পুরো জাতিকে কিছু বোঝাতে চেয়েছেন”।