রাবেয়া: সুঁইয়ের ফোঁড়ে জীবনের গল্প
নাজিফা আক্তার শারিকা।। সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো রাবেয়ার। সেই ভোরবেলা উঠে কয়টা চাল সিদ্ধ করেছে। সাদা পানির মধ্যে অপরিপক্ক কিছু চাল! একে চাল সিদ্ধ ছাড়া আর কিইবা বলা যায়! তরকারি বলতে লবন-মরিচের স্বাদ আরকি, আর সামান্য একটু আলুভর্তা।
কিন্তু কী করবে? এ মাসে হাত একেবারেই খালি। ঠিকমত ফোটানো ভাতও কপালে জোটে না। আর মাছ-তরকারি সে তো কল্পনার বস্তু। আজ ওর বড্ড তাড়া। আজ সকাল সকাল যেতে হবে হবে। গত দুদিন যেতে পারে নি। যে জায়গায় জরুরি কারনে একদিন বন্ধ দিলে দুদিনের বেতন কাটা সেখানে দুদিন বন্ধ দেয়া… আল্লায় জানে কী হয়! মনে মনে ভাবে রাবেয়া।
গত দুদিন প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল ওর। কিন্তু কাউকেই বলেনি। কারন এমনিতেই করোনার জন্যে অনেক গার্মেন্টসেই শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে। এখন যদি ওর জ্বর এটা ম্যানেজার জানে তবে- ভাবতেই গা শিউরে ওঠে রাবেয়ার। সামনে আবার কোরবানি। শিউলি রোজার ঈদে একটা লাল জামার বায়না ধরেছিলো। কিনে দিতে পারে নাই। সারাদিন কি কান্না! একটু সেমাইও মুখে দেয়নি। এবার কী করবে? বেতন না পেলে ক্যামনে জামা কিনে দেবে ওরে! শিউলি রাবেয়ার একমাত্র মেয়ে।
রাবেয়া। ঢাকার আমজাদ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির একজন অপারেটর। ওভারটাইমসহ বেতন পায় ১১ হাজার টাকার মতো। সাভারে বস্তির একটা ঘরে স্বামী-সন্তানসহ থাকেন। ভাড়া তিন হাজার টাকা। তবে শর্ত আছে জানুয়ারি আর জুন মাসে ২শ টাকা করে বাড়বে। এ যেন মরার উপরেই খড়ার ঘা!
রাবেয়ার স্বামী হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত। মাসে হাজার দেড়েক টাকার ওষুধ লাগে। তারপর চাল, নুন,তরিকারি খরচে মাস শেষে শূন্য মুখেই দিনাতিপাত করতে হয় রাবেয়াকে। মেয়েটা লেখাপড়ায়ও ভালো ছিলো। কিন্তু অভাবের সংসারে ওকে বাড়িয়ালার বাড়িতে কাজে দেয় রাবেয়া।
আজ বেতনের টাকা দেবে। কে জানে কত কাটবে আর কত দেবে। দুর্বলদের অধিকারের আন্দোলন যে আদতে ব্যর্থতাই! অবশেষে জীবনযুদ্ধে আর এক ধাপ এগিয়ে যেতে লড়াইয়ে নেমে পড়ে রাবেয়া। এখনো পুরোপুরি ভোরের আলো ফোটেনি। তাই রাস্তাঘাট খালি অনেকটা। ব্যস্ত নগরীতে নির্জন পথ পেয়ে গার্মেন্টসের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলে।
বিকেল ৬টা। বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। আজ বেতনটা নিয়েই যেতে হবে; নইলে নুন পানিটুকুও জুটবে না আর। ম্যানেজারের রুমে গেল টাকার কথা বলতে।
রাবেয়া: স্যার আমার টাকাটা কি আজকে পামু? দেওন যাইব?
ম্যানেজার: তুমি এই মাসে বন্ধ দিছো না দুইদিন। আবার কীসের টাকা?
রাবেয়া: স্যার আমার টাকাটা খুবই দরকার। ঘরে অনেক অভাব। টাকাটা না পাইলে যে আমার স্বামী -সন্তান না খাইয়া থাকব। তবে আমি ওভারটাইম করে পোষাইয়া দেবোনে।
হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল ম্যানেজার লোকটা। এগিয়ে আসে রাবেয়ার দিকে। তার পিঠের উপর হাত বুলিয়ে বলে, আহহহ রাবেয়া! কী দরকার আছে তোমার এই অসুস্থ বুড়া লোকটার জন্য এত কষ্ট করার।ফালাইয়া চইলা আসলেই তো পারো!
মুহুর্তের মধ্যেই ক্রোধে চিড়বিরিয়ে ওঠে রাবেয়া শরীর। ওর শরীরের প্রতিটি কনায় স্ফুলিঙ্গের মতো জমতে শুরু করে ঘৃণা, রাগ আর প্রতিবাদ। ইচ্ছা করে, এই নরপশুর ধর থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে ফেলতে, চিৎকার করে বলতে- তোদের এই টাকা আর দরকার নেই আমার। আর একদলা থুতু ছিটিয়ে আসতে ওই নোংরা মুখের উপর। তবুও চুপ করে সহ্য করে যায় রাবেয়া। কারণ গরীবের প্রতিবাদ ব্যর্থতারই প্রতিরূপ!
একবিন্দু পানি গড়িয়ে পরে ওর চোখ থেকে।
টাকাটা নিয়ে ব্যস্ত শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে রাবেয়া, ভাবতে থাকে তার জীবনের কথা। ছোটবেলায় থেকেই কষ্ট, দুঃখ তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।পড়ালেখায় খারাপ ছিল না। কিন্তু বাবা অভাব সরানোর জন্য তাকেই পরিবার থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে দিয়ে হয়ত আপদ বিদায় করেছিল। স্বামীর সংসারেও সংগ্রাম পিছু ছাড়েনি। দুই বছরের মাথায় স্বামী শয্যাশায়ী। মুখপোড়া অভাবের কাছে বিকিয়ে দিতে হয়েছে তার সমস্ত আবেগ আর যৌবনকে। আর এখন সংগ্রামের কালে প্রতিনিয়ত থাবা পড়ছে তার ইজ্জতের উপর। আচ্ছা নারী কি সব সময়ই পণ্য। কারো কাছে বিক্রির পণ্য, আবার কারও কাছে ভোগ্যপণ্য!
বাসায় ফেরে রাবেয়া। ফেরার পথে কিছু তরকারি কিনে নেয়। গিয়ে রান্না চড়ায়। স্বামীকে আর বাচ্চাদের খাওয়ায়। সবকাজ শেষে আবার সেলাই করতে বসে আর মাসের হিসেব কষে। বাসা ভাড়া, ওষুধ, চাল, ডাল সবমিলিয়ে মাসের শেষে আবারও শূন্য হাত! হাহাকার করে ওঠে বুকের ভিতর। কবে শেষ হবে এই সংগ্রামী জীবন!
শুধু রাবেয়া না, এরকম লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিকের জীবনগাঁথা একই। মাস শেষে হাহাকারধ্বনি বাজে, হিমশিম খেতে হয় পরিবারকে এগিয়ে নিতে, কিংবা কখনো অনিচ্ছায় বিকিয়ে দিতে হয় শরীর। তাদের প্রতিটি সূঁচের ফোড়ে রচিত হয় মৃত্যুর পথরেখা!
থাক এসব ভাবার সময় কই? কালকে শিউলির জন্যে লাল জামাটা কিনবে। কোরবানির দিন সকালে মাইয়াডা জামাডা দেইখা কি যে খুশি হইবো- ভাবতেই মনডা ভালো হইয়া গেলো রাবেয়ার।
নাজিফা আক্তার শারিকা: নবম শ্রেণি, সৃজনী বিদ্যানিকেতন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুমকী,পটুয়াখালী