‘সতীত্ব’, রক্তের দাগ এবং আমাদের কুসংস্কার
সায়েবা বিনতে জহির।। বছর দুয়েক আগে দেখা একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। দৃশ্যটা অনেকটা এমন যে, বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামী সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর সাথে শারীরিক মিলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কেননা তিনি তার স্ত্রীর সতীত্বের প্রমাণ চান। শারীরিক মিলনের পর সাদা বিছানার চাদরে রক্তের দাগ না থাকায় তিনি দ্রুত ওই কক্ষ ছেড়ে চলে যান এবং নিজের মায়ের কাছে অভিযোগ করেন যে কেন একজন অসতী মেয়ের সাথে তার বিয়ে দেওয়া হলো? চলচ্চিত্রের বাকি অংশে মেয়েটিকে কী পরিমাণ শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে তা হয়তো আমরা বুঝতেই পারছি।
এখানে একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট যে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী বিয়ের আগে কোনো প্রকার যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে কিনা, নারী পবিত্র কিনা তার প্রমাণ নির্ভর করে সতীচ্ছদ পর্দা অক্ষত থাকা না থাকার উপর। পৃথিবীব্যাপী বহু সমাজেই সতীত্ব পরীক্ষার এই অবৈজ্ঞানিক এবং ভিত্তিহীন প্রক্রিয়াটি এখনো চালু আছে। তবে সত্যটি হলো অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই প্রথম সহবাসের সময় রক্তপাত হয়না এবং এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। আজকের লেখাটির পেছনে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আমাদের যুবসমাজকে এই অমূলক প্রথা কিংবা মিথটির ব্যাপারে কিছুটা হলেও শিক্ষিত করে তোলা।
প্রথমেই আমাদের জানা প্রয়োজন সতীচ্ছদ পর্দা আসলে কী?
সতীচ্ছদ পর্দা বা হাইমেন নারীর প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ। যোনিমুখের সামনে অবস্থানকারী এই পর্দাটি, যোনিমুখের কিছুটা অংশকে ঢেকে রাখে। সবার এটি থাকবে এমনও নয় এবং একেকজনের ক্ষেত্রে এটি একেক রকমের হয়ে থাকে। শারীরিক গড়নের মতোই প্রাকৃতিকভাবে কারো কারো হাইমেন থাকেনা, কারো হাইমেন বড় হয়, কারোটা ছোট, কারোটা পুরু, আবার কারোটা একেবারেই পাতলা। আমাদের এটিও জানা প্রয়োজন যে হাইমেন আলাদা করে দেখা কিংবা অনুভব করা যায়না।
কেবল যৌনমিলনই কি সতীচ্ছদ পর্দার অপসারণের জন্য দায়ী?
আমাদের সমাজে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে প্রথম সহবাসের সময় সতীচ্ছদ পর্দাটি ছিঁড়ে যাওয়ার ফলেই রক্তপাত হয় এবং যৌনমিলনে অভ্যস্ত মেয়েদের আগে থেকেই এই পর্দাটি অপসারিত হয়ে যাওয়ার কারণে বিয়ের পর যৌনমিলনের সময় রক্তপাত হয়না। কিন্তু বিজ্ঞান বলে অনেকের ক্ষেত্রে হাইমেন এতোটাই ছোট থাকে যে সহবাসের ক্ষেত্রে এটি কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনা৷ আবার কোনো কোনো নারীর ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজে থেকেই হাইমেন অপসারিত হয়। সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ঘোড়ায় চড়া, ভারি কাজ বা ব্যায়াম করার ফলেও হাইমেন অপসারিত হতে পারে। এমনকি ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহৃত টেম্পুনের কারণেও এমনটা হতে পারে। সতীচ্ছদ পর্দা অপসারিত হলে যে রক্তপাত হবে এই ধারণাটিও নিতান্তই অমূলক। বরং সত্যিটা হলো ‘সতীত্ব’ প্রমাণের কোনো প্রক্রিয়া নেই। অনেকগুলো দেশের নারীর উপর করা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায় যে হাইমেনের ভিন্নতার কারণে অধিকাংশ নারীর প্রথম সহবাসে রক্তপাতের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বরং জবরদস্তির করে যৌনমিলনে অনেক নারীর শরীরে অভ্যন্তরীন ক্ষত সৃষ্টির কারণে রক্তপাত ঘটে থাকে।
আজকের দিনেও নারীকে নিজের চারিত্রিক পবিত্রতার প্রমাণ দিতে হয়- বিষয়টি সত্যিই হতাশাজনক। একজন নারী কুমারী কিনা তার উপর নির্ভর করে তার সামাজিক মর্যাদা। কোনো কারণে ভার্জিনিটি রিচ্যুয়াল বা সতীত্বের পরীক্ষায় ফেইল করে বসলেই জোটে চরিত্রহীন, নোংরা মেয়েমানুষের তকমা। কিছু কিছু জায়গায় তো মেয়ের পুরো পরিবারকেই একঘরে করে দেওয়া হয় আজীবনের জন্য! তবুও স্বপ্ন দেখি এমন এক সমাজের যেখানে বিছানায় লাল ছোপ দেখা যাওয়া বা না যাওয়ার উপরে কোনো মেয়ের সম্মান নির্ভর করবেনা, এই নিকৃষ্ট সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেনা এবং অভিধানে সতীত্ব বলে কোনো শব্দ থাকবে না। আসুন সতীত্ব পরীক্ষার মতো এই নোংরা মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের শিক্ষিত করি এবং নারীদের যথাযোগ্য সম্মান দিই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]