November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

‘মেয়ে’ বলে লজ্জা পাওয়া বন্ধ করি

ফারজানা নীলা।। “আমার শরীর আমার অধিকার” এই বোধ জন্মাবার আগে কতবার “তোমার শরীর আমার অধিকার” পর্ব পার করে আসে মেয়েরা, তার হিসেব রাখা হয় কোথায়! বোধ হওয়ার পর থেকে কোন রকম শারীরিক নিপীড়নের ভেতর দিয়ে যায় নি এমন কঠিন সৌভাগ্যের মেয়ের দেখা পাওয়া দুষ্কর। প্রতিটা মানুষের শরীর তার নিজের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি হওয়ার কথা। এ যে ব্যাক্তিগত সেটা বোঝার আগেই একে সকলের সম্পত্তি মনে করে বিভিন্ন রকম ক্রিয়া  চলে। চলে খালাত মামাত ভাইদের দ্বারা, পাশের বাসার আঙ্কেলের দ্বারা, বা কোনও দোকানদার বা দারোয়ান দ্বারা।

সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কোনো কন্যা শিশু বা তারও কম, যার হয়তো সবে মাত্র বুকের স্ফীত ভাব বোঝা যাচ্ছে, বা হয়তো সামান্য বাড়ন্ত গড়ন, তাকে দেখে লালসার জিভ আর কামনার চোখ দিয়ে তাকিয়ে সুখে ভরে ওঠে কোন দারোয়ান। মেয়েটি বোকার মত তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারেনা, এতদিন যে দারোয়ান এভাবে তাকায় নি তার গলার নিচে সে কেন আজ এভাবে তাকাচ্ছে। মুখের দিকে তাকানো আর গলার নিচে তাকানো যে এক না, সে জিনিস বোঝার ক্ষমতা সেই বয়সে মেয়েদের হয়ে যায়। কোন এক আশ্চর্য ক্ষমতা বলে মেয়েরা এই ক্ষমতা পায়।

মেয়েটি উত্তর খোঁজে নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে। নিজের মনে উঁকি দেয় “এখন কি ওড়না পরতে হবে?” অথচ কালই তো সে ছাদে গিয়ে দৌড়োদৌড়ি খেলেছে, কই তখন তো কেউ কিছু দেখে নি!

কিছু টাকা পেলেই দোকানে ছুটে গিয়ে কোক কিনে আনা মেয়েটা আজ দোকান থেকে ফিরে নিথর হয়ে বসে আছে। জানতে পারা গেলো দোকানদার তার বুকে থাবা দিয়েছে। এক দৌঁড়ে বাসায় এসে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে বহুক্ষণ। এই দোকানে সে গিয়েছে কতবার। খাতা পেন্সিল কোক চকলেট সব এখান থেকে কিনত সে।কোনোদিন কেউ তো বিশ্রী করে ধরে নি তাকে। আজ কী হলো এমন?

কি বিশ্রী ঘিনঘিনে লাগছে তার সারা শরীর। কি ঘেন্না কি ঘেন্না!

পাশের বাসার  কলেজে পড়ুয়া ভাইয়া কাগুজে নৌকা প্লেন বানিয়ে দেয়, সে আজ প্লেন দিয়ে খেলাও শেখাচ্ছে। মেয়েটি উড়ে উড়ে খেলছে। আগে যেমন খেলত এখনও তেমন খেলে। খেলতে খেলতে ভাইয়ার হাতটা চলে যায় একদম কোমরের নিচে। প্যান্টের ভেতরে। মেয়েটি ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। ছলছল চোখে দৌঁড়ে পালায়।

কেউ বলে নি তাকে কিন্তু সে কীভাবে যেন জানে এসব কাউকে বলতে নেই। এসব খারাপ। তাই সে বলে নি কাউকে। কিন্তু এও তার মনে হয়েছে সে তো খারাপ কিছু করে নি। বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলে মাকে। বুকের জায়গাটা বাদ দিয়ে বলে। কোমরের নিচে জায়গাটা বাদ দিয়ে বলে। বলে হাত ধরেছে।

মা তাকে আরও নিথর করে দিয়ে বলে , তোমারই দোষ! আর যাবে না।

মেয়েদের কেউ বলে দেয় না কিন্তু তারা বুঝতে পারে এভাবে শরীরে হাত দেওয়া  নোংরামি।

মেয়েদের কেউ বলে দেয় না কিন্তু তারা বুঝতে পারে হাত ধরা আর বুকে কোমরে হাত দেওয়া এক না।

মেয়েদের কেউ বলে দেয় না কিন্তু তারা বুঝতে পারে এসবে কোন এক দুর্বহ কারণে মেয়েদের দোষী করা হয়। মেয়েদের কেউ বলে দেয় না কিন্তু তারা বুঝতে পারে এসবে মেয়েদের চুপ থাকতে বলা হয়।

কেন? এই কেন’র উত্তর জানা যায় না পুরুষ নামের সামনে লেজধারী প্রাণিতে বেষ্টিত সমাজে।

কিশোরী এক সময় বড় হয়, নিজেই এর উত্তর খুঁজে নেয়। খুঁজে নিয়ে জানতে পারে এই সমাজে মেয়ে মানেই “দোষের” অন্য নাম। ধর্ষণ করবে পুরুষ, দোষ হবে নারীর। শারীরিক নিপীড়ন করবে পুরুষ, দোষ হবে নারীর। আজেবাজে কথা বলবে পুরুষ, দোষ হবে নারীর।

উঠতি বয়সের কিশোরী দেখে  মাথা ঠিক রাখতে না পারা পুরুষরা, দোষ মেয়েদের উপরই দেয়।  কারণ যাদের মাথায় যৌনতার বদলে মগজ থাকে, তারা এভাবে হামলে পড়ে না, থাবা দেয় না, বিষবাক্য উগড়ে দেয় না।

ঠিক একই ভাবে “আমি তো মেয়ে” এমন নিচু আর তুচ্ছ চিন্তা না করে যেসব মেয়েদের মগজ আছে তারা এসবের প্রতিবাদ করতে শেখে, করতে শেখায়। তারা তাদের সন্তানদের শেখায় এসব হলে ‘বলা যাবে না কাউকে’ এগুলো দুর্বলদের কথা। সবার আগে সে যেন মায়ের কাছে আসে। মা’ই তার হয়ে লড়বে, তার কিশোরী মেয়ের হয়ে সে প্রতিবাদ জানাবে। সে শেখাবে এসব ‘ওড়না পরা না পরা’ সমাধান না। সমাধান প্রতিবাদে। সে শেখাবে এগুলো “লজ্জার” না বরং অন্যায়। মেয়েদের সাথে হওয়া অন্যায়। আর অন্যায়ের বিপরীতে প্রতিবাদ না হলে কোনোদিন ন্যায়ের মুখ দেখতে পাওয়া যাবে না।

মাথায় যদি দাদি নানীদের মত গেঁথে থাকে “আমি তো মেয়ে” তাহলে শিশু আর কিশোরী বয়সের দুর্বলতা আর ভয় আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। সেই ভয়ের ফলে কোনোদিন নিজের পার্টনারকেও মানা করতে শেখে না মেয়েরা। পার্টনার চাইলেই করতে হবে কারণ সে তো ‘মেয়ে’। তার আবার ইচ্ছে অনিচ্ছা কি!

অথচ মনে আনতে হবে, তখন আমি ছোট ছিলাম বলে কেউ আমার কথা শোনে নি। কিন্তু অন্যায়টা হয়েছিল আমার সাথে, আমি মেয়ে বলে হয় নি। তারা পুরুষ বলে হয়েছে। যৌনতা ছাড়া মগজহীন পুরুষ বলে হয়েছে। শরীর একান্ত  নিজস্ব বলে এই শরীরে কিছু করার আগে অবশ্যই সম্মতি দেওয়ার অধিকার আসবে। এই সম্মতি দেওয়ার অধিকার নারীর যেমন পুরুষেরও তেমন। কেউ কারো মতের বিপরীতে কিছু করার অধিকার রাখে না।

এই বোধের জন্ম বাবা মা’দের দেওয়া উচিত সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া সন্তানদের। কিন্তু আমরা দেই না। বরং আমরা উলটো শেখাই। শেখাই যে এখন তোমার খেলাধুলা করতে হবে না, ওড়না দিতে হবে বুকে, ছেলেদের সাথে খুব মিশবে না, একা একা দোকানে যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং আরও ভয়াবহ শিক্ষা এও দেই, কেউ কিছু বললে বা করলে কাউকে কিছু বলবে না।

মগজ বিকশিত হওয়ার প্রথমেই আমরা মেয়েদের শেখাই “এগুলোতে মানুষ খারাপ বলে”। মেয়ে নিজে খারাপ না করলেও তাকে খারাপ বলবে কেন? মানুষ খারাপ বলবে বলে চুপচাপ সহ্য করতে হবে কেন? একজনের শরীরে হাত দেওয়ার আগে অনুমতি নিতে হবে না কেন?

এই কেনগুলো করতে আমরা শেখাই না। মগজ যদি বিকশিত হয় তবে নিজেই এই কেনগুলো করতে শিখি। এবং পরবর্তী প্রজন্মকে করতে শেখাই।

আমি মেয়ে না, মানুষ আগে। আমার শরীর আমার অধিকার এই বোধের বিকাশ ঘটলে আরেকটা শিশু কিশোরীকে প্রশ্ন করতে শেখাই। প্রতিবাদ করতে শেখাই। শরীর ওড়না দিয়ে ঢাকব কি ঢাকব না সেটাও ঠিক করার অধিকার নিজের।

নিজের কাছে অন্যায় মনে হলে অবশ্যই সেটার প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদ করব কি করব না সেটা ‘অন্যরা কি ভাবছে’ সেটার উপর নির্ভর করে না।

আমি মেয়ে বলে আমাকেই রয়ে সয়ে চলতে হবে এটা ভাবা অন্যায়, বরং ভাবতে শিখতে হবে, আমি মেয়ে বলে আমার সাথে যা খুশি কেউ করতে পারে না।

প্রতিটা জীবের জৈবিক চাহিদা থাকবে। এই চাহিদা পূরণের জন্য নরনারী উভয়কে সম্মতি দিতে হবে। কেউ কারো উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার রাখি না। এই বোধ এই শিক্ষা পুরুষ এবং নারী উভয়েরই প্রয়োজন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]