তজুমদ্দিন থেকে নর্থ কান্ট্রি: গল্পগুলো এক
সেঁজুতি জাহান জিনাত।। ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চৌমুহনী সংলগ্ন মেঘনা নদী। কুলকুল বয়ে চলা মেঘনা। অখণ্ড অথবা ছেঁড়া ছেঁড়া জীবনের ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে প্রবহমান মেঘনা। গত ৪ জুলাই এই তজুমদ্দিনের মেঘনায় ঘটে গেছে সারা বছর সারা দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার একটি।
এখানে একজন ষোড়শী লঞ্চের বাবুর্চিদের হাতে ধর্ষণের ভয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল মেঘনার বুকে। আপনার মনে হতেই পারে এটি একটি সিনেমার দৃশ্য। সত্য কিনা তা নিয়ে বিরাট বিস্ময়ও জাগতে পারে মনে।
ভাগ্যিস মেয়েটির সহায় ছিল মেঘনা। তাই জীবনে বেঁচে গেছে সে। এখন কতটুকু সামাজিক বাঁচা বাঁচবে সেটি দেখবার বিষয়। সেই সব দেখা জীবন দৃশ্যের ভেতর আবার কোন চলচ্চিত্রের সংযোগও ঘটে যেতে পারে। কে জানে!
এমনই একটি জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্র নিকি ক্যারোর ‘নর্থ কান্ট্রি’। মনে হবে যেন জীবনের এপিঠ ওপিঠ দেখছি। ভোলার তজুমদ্দিন এবং নর্থ কান্ট্রি যেন একই ঘটনার সাক্ষী। ১৬ বছরের দুই ভিন্ন ভূখণ্ডের কন্যাশিশুর ভাগ্যে প্রায় একই রকমের দুর্ঘটনা।
নর্থ কান্ট্রি, যেখানে লোহার খনিতে থাকা লোহার মতো মানুষগুলো ভূমিকে নরম পেয়ে জবরদস্তি করে যায় যুগের পরে যুগ। নর্থ কান্ট্রি, জোসি এইমেজের গল্প, গল্পটা সত্য ঘটনার আশ্রয়ে লেখা।
জোসি এইমেজ, বেঁচে থাকবার জন্য বায়োলজিক্যালি যা যা থাকা প্রয়োজন তার থেকে একটু বেশিই ছিল তার। যেখানেই যেতো, দশজন নিজেদের কাজ রেখে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকত।
যখন তার বয়স ১৬ তখন স্কুলের এক সহপাঠী, ববি শার্পের সঙ্গে হালকা ভাব হতে চেয়েছিল, কিন্তু হয়নি শেষ পর্যন্ত। এই না হওয়ার পেছনে জোসি বা তার পরিবার নয়, বরং জোসির মন্দভাগ্যটাই দায়ী।
জোসি সুশ্রী, সকল পুরুষ তাকে ভোগ করতে চায়। স্কুলের শিক্ষক ১৬ বছর বয়সেই তাকে ধর্ষণ করে, এই ধর্ষণের দৃশ্য তার সেই হবু বয়ফ্রেন্ড দেখে ফেলে এবং কোন প্রকার প্রতিবাদ না করে উলটো জোসির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে জায়গা ত্যাগ করে। একবারে ত্যাগ করলেও হতো, জোসির জীবনের প্রায় অনেকাংশ জ্বালিয়ে ফেলে সে।
ধর্ষণের ফল হিসেবে বাল্য বয়সেই একটি ছেলের মা হয় জোসি। ছেলেটা সে চায়নি, কিন্তু হয়ে গেছে। ছেলেকে বলেছে তার বাবা আর্মির একটা অপারেশনে মারা গেছে। বিয়ে হয় জোসির। সেখানে মেয়েও হয় একটা। কিন্তু আগের অবৈধ ছেলেকে নিয়ে এবং শুধুমাত্র সুশ্রী হওয়ার জন্য পুরুষ লোকেরা তাকে প্রতিনিয়ত বিরক্ত করে বলে তার দণ্ড হিসেবে স্বামী জোসিকে অনবরত নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে দুই সন্তানকে নিয়ে জোসি বাবার বাড়ি চলে আসে। বাবা তাকে প্রথমেই একটি অশ্লীল প্রশ্ন করে যার জন্য জোসি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কোন বাবাও যে তার মেয়েকে এভাবে বলতে পারে তা সত্য ঘটনা না হলে অবিশ্বাস্য লাগত। বাবা কাজ করেন সেই নর্থ কান্ট্রির লোহার খনিতে। জোসি তার এক বান্ধবিকে ধরে ওখানে কাজ নেয়, যেটা তার বাবা ভালো চোখে দেখে না। কেননা, এই মেয়ের বর্ধিত শ্রী এবং আত্মবিশ্বাস তাদেরকে যথেষ্ট জ্বালিয়েছে এমন ইতিহাস আছে।
জোসি কাজ নেয় এবং দেখে সেখানে তার সেই হতচ্ছাড়া বয়ফ্রেন্ডটা, যে তাকে স্কুলশিক্ষকের অপকর্মের মাঝে ফেলে রেখে ভেগেছিল। জোসির পক্ষ থেকে এই ববি শার্পের মতো লোকের জন্য ঘৃণা বরাদ্দ রাখাটা খুবই স্বাভাবিক। ববি জোসির ওপর তার ঘৃণার শোধ তোলে। দিনের পর দিন জোসিকে নোংরা ভঙ্গিতে উত্যক্ত করে চলে। অথচ কোম্পানির কাছে নালিশ করে জোসি কারখানার পুরুষ শ্রমিকদের মনোরঞ্জন করে বেড়ায়। কোম্পানি থেকে তাকে চাকরি ছাড়বার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। জোসি, ছাড়তে চায় না কিছুতেই। ছাড়লে দুটো শিশুকে সে কী খাওয়াবে? অত্যন্ত নিরুপায় জোসি।
কোম্পানিতে শুধু জোসিই নয়, অন্য নারী শ্রমিকেরাও ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পুরুষের সঙ্গে কারখানায় কাজ করছে বলে পুরুষের মতো করে বুকপকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে এক নারী শ্রমিককে এক পুরুষ শ্রমিক মলেস্ট করে। সিনেমায় এভাবে বলা গল্পটাই যেনো তজমুদ্দিনে দৃশ্যায়িত হলো বাস্তব জীবনের ক্যানভাসে। এক পর্যায়ে জোসি আইনের আশ্রয় নেয়। সেখানে তার বিরুদ্ধে কোম্পানি একজন নারী আইনজীবী নিয়োগ করে। কোম্পানিকে তার এক্স বয়ফ্রেন্ড বোঝাতে এবং বিশ্বাস করাতে সমর্থ হয় যে জোসি একজন দেহব্যবসায়ী। মামলা চলতে থাকে এটাকেই বেইজ করে।
একজন নারীকে জোর করে ভোগ করতে পারা বা না পারা পুরুষের ভাষা সব সময় একই হয়। বর্ধিত শ্রীর নারী মানেই রূপোপজীবিনী, অর্থাৎ হোর (whore, বেহেস্তের হুর নয়), এমনকি পুরুষের এই দৃষ্টি-ভাষায় অনেক নারীও তাই মনে করে।
আরেকজনকে আয়ত্তে না পাওয়ার যে জটিল যন্ত্রণা তা থেকেই পৃথিবী ধ্বংসের সূত্র তৈরি হয়েছে, অন্তত ইতিহাস ঘেটে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতেই পারি। জোসির এক্স বয়ফ্রেন্ড যে তাকে এতো নিচে নামিয়ে নানা ভোগান্তির ভেতর দিয়ে জোসির জীবনকে একটি ফুটবলের মতো চালিয়ে নিয়ে বেড়ালো তা কেবলই তাকে ভোগ করতে না পারার ক্রোধ থেকে উৎসারিত।
১৯৭৫ সালে লরি জনসন নামের এক সুন্দরী নারীর জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে মুভিটা করা। এমন সত্য ঘটনা বিপুল পরিমাণে এই ২০২০ সালেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর সর্বত্রই। অনেক দেশেই এসবের হরেদরে বিচার হচ্ছে। আমাদেরও হচ্ছে। তবে বিচার পুরুষতন্ত্রের পক্ষে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি তা। করছি না কিছুই। করব কেন? আমরাই তো এই পুরুষতান্ত্রিক’ভাষা’র ধারক বাহক প্রতিপালক।
অন্যের জীবন অন্যেরই, তাকে অন্যভাবেই দেখা উচিৎ। অন্যের বাস্তবতাও অন্যরকম হয়, তাকে নিজের অনায়ত্ত ভাষার মধ্যে ফেলে দিয়ে দুর্বিপাক ঘটানোর কোন মানে হয় না। জোর করে কিছুই হয় না, না অন্যকে নিজের মতো আয়ত্ত করা, না অন্যের জীবনে ঢুকে যাওয়া।
জোসি মামলায় জিতে গিয়েছিল কারখানার অন্য নারীশ্রমিকদের সাক্ষ্যের জন্যে। জোসির মতোই দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাদের সবাইকে একই বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
জোসি জিতে গিয়েছিল। এখানে এই সব জিত হয় না। ধর্ষিত মরে গেলেও তাকে নিয়ে গালগল্প তৈরি হতে থাকে। মৃত্যুর পর সে যেন আবার নিত্য নতুনভাবে জন্মাতে থাকে। একটি ধর্ষকামী ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তিই এই গালগপ্পোময় সমাজ তৈরি করে, শাসন করে, নীতি নির্ধারণ করে। এই মনোভাবনার মানুষের ভেতরে নারীরাও থাকে, না হলে এমন একটা চল শুধু শুধুই প্রতিষ্ঠা পায় না।
যাকে ধর্ষণ করা যায় না, পরবর্তীকালে সেই চরিত্রহীনা; নিজে আড়ষ্ট থেকে যার মতো উচ্ছল, প্রাণবান, চটপটে হওয়া যায় না, সেই চরিত্রহীনা। নিজের পছন্দ মতো কথা, কাজ না হলেও চরিত্র খারাপ হয়ে যায়। বায়োলজিক্যাল ধর্ষণ শুধু নয়, কথার ধর্ষণেও মানুষ আত্মাহুতি দেয় প্রতিনিয়ত।
কর্ণফুলি-১৩’র লঞ্চ ষ্টাফদের যৌন হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে মেঘনা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল বাংলাদেশের হাতিয়ার ১৬ বছর বয়সী আর একজন জোসি। মেয়েটিকে উদ্ধার না করেই লঞ্চটি ঢাকায় চলে আসে। মাছ ধরার ট্রলারের মাঝিরা পরে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। কথা হলো, মেয়েটি কি আসলে উদ্ধার পেয়েছে? জীবন নিয়ে একটি সামাজিক বিচারবিহীন দেশের এক দলা মাটি হয়ে বেঁচে থেকে কী হয় আসলে? যার যা মন চায় তাই করতে পারে। রাষ্ট্র কিছুই বলবে না, মানুষ কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না, কোনো তদন্ত হবে না, হতে গেলেও ওই নারীকে এমন হেনস্তার শিকার হতে হবে যেন এসবের জন্য সে নিজেই দায়ী।
তো এমন মৃত্যু মার্কা জীবন বয়ে নিয়ে আর কতদূর যাওয়া যায়?
এদেশে জোসিদেরকে মরতেই হয় যে কোনোভাবে। মেঘনা নদী আশ্রয় দিলেও এখন ওই মেয়েটির পারিপার্শ্বিক সমাজ ওকে অনবরত বাক-ধর্ষণ করবে। ও যদি আত্মাহুতিও দেয় তারপরও তার ত্রুটি অন্বেষণ করে তাকে ঘৃণা সহযোগে মনে রাখবে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের টুকরো টুকরো নিকৃষ্ট মাটির দলারা। তনুকে দেখেছি আমরা, ভুলেও গিয়েছি তার একাধিক সিম কেন ছিল সেই কুটতর্কের কথা। ফাহিমাদের মতো ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠে আবার ভাটিতে চলে যায়।
এখন তো করোনা কাল, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির এই দেশে কিভাবে শেষমেষ এখনও ধর্ষকামী দৃষ্টির জয় হয়, সেটাই ভাবি!
নিউজিল্যান্ডের নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা নিকি ক্যারোর এই ‘নর্থ কান্ট্রি’ সিনেমাটার শুরুটা হয়েছিল জোসিকে একজন নারী উকিলের জেরা করা দিয়ে। কিন্তু আমাদের এই ‘ন্যারো ভূখণ্ডে’ জোসিদের জেরা করা হয় রাস্তায়, পথে ঘাটে, আত্মীয়ের আড্ডায়, স্কুল, কলেজ এবং সংশ্লিষ্ট সবখানে। না, কোন আদালতে বিধি মোতাবেক জেরা চলে না। এবং অধিকাংশ মামলাই ধুলো জমতে জমতে আবার মেঘনায় ঝাঁপ দেয়া শুরু করে।
একজন নারী শিশুকে ধর্ষিত হতে দেখে যে রাষ্ট্রের কণ্ঠে কোন আওয়াজ থাকে না, চোখে দৃষ্টি থাকে না, সে রাষ্ট্রকে ‘মা, মা’ বলে আদিখ্যেতা দেখানোটাও নারীর প্রতি চরম প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]