মিহিদানা
সায়মা আরজু।। শীলা ঘর হতে বের হতে যাবে ছাতাটা নিচ্ছে, মা বলল, “ফেরার সময় লাড্ডু নিয়ে আসিস তো, মিহিদানার লাডডু । মিশু খেতে চেয়েছে।” মিশু শীলাদের ভাড়াটিয়ার তিন বছর বয়সী মেয়ে। দিনের বেশিরভাগ সময় মা’র সঙ্গে কাটায়। মাঝে মধ্যেই মা ওর জন্য এটা ওটা আনতে বলে। শীলা কিছু বলেনা, এনে দেয়। আসলে শীলা এখন মা যা যা চায় প্রায় সব কিছুই করতে দেয়, বাবা বেঁচে থাকতে মা’র ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলো কেমন ঘুমিয়েই ছিল। আর শীলারও জীবন! সেই সকাল দশটায় গিয়ে দোকানের ঝাপ খোলে আর রাতে ঝাপ বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা, কখনও দশটা। বাবা মারা যাবার পর থেকে এটাই রুটিন। তাও দোকানটা চালু আর নিজেদের ছিল, নইলে কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াতাম, ভাবে শীলা!
বাবা মারা যাবার সময় শীলা বিএ পড়ে। তিন মাস পরে পরীক্ষা। কিন্তু হঠাৎ করে মা আর সংসারের ভার মাথায় এসে পড়ায় বুঝতে পারছিল না কী করবে? পড়াশুনাও লাটে উঠল। অবধারিতভাবে রেজাল্ট খারাপ হল আর এই দোকানদারি ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। শীলা খুব ভাল ছাত্র কখনই ছিল না তবে একেবারে ফেল করে যাবে এমনও নয়। তা ঐ টেনেটুনে পাশ মার্কস নিয়ে গ্রাজুয়েশন পার করল আর কি! বাবা যখন জীবিত ছিলেন এটা একটা মুদির দোকান ছিল, সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রসাধনী, মশলাপাতি। কিন্তু শীলার জন্য মুদির দোকান চালানো ঝক্কি মনে হল। সে তার সুবিধার জন্যই এটাকে দুই ভাগে সাজালো। একপাশে হালকা স্ন্যাকস, চা আর মনোহরি আর অন্যপাশে দর্জি। তার ক্রেতারাও বেশিরভাগ মহিলা আর স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারা। মা কিছু হাতের কাজ জানেন, বাচ্চাদের জামার ঝুলে ক্রশের ঝালর, বড়দের ব্লাউজের ক্রশের ডিজাইন করা হাতার অর্ডার থাকলে মা করে দেয়। শীলার সাথে আরেকটা মেয়ে আছে, কাজের খুব চাপ থাকলে এসে সেলাই করে দেয় ঘণ্টা মজুরির বদলে। আর স্ন্যাকসের পাশটা দেখাশুনা করে চৌদ্দ-পনের বছরের একটি ছেলে, বজলু। বজলু আগে শীলাদের বাসায় মায়ের সাহায্যকারী ছিল, এখন দোকানেই সময় দেয়।
প্রচন্ড গরম পড়েছে ক’দিন ধরে। রাস্তাঘাটও অনেকটা ফাঁকা। কেউ বিশেষ দরকার না হলে বের হচ্ছেনা। শীলার হাতেও কাজ কম। দুপুরের পর একটা বাচ্চার হালকা নীল রংয়ের নিমায় টিপ বোতাম লগাচ্ছিল শীলা। মনে হল কয়েকটা লাল রঙের ফুল উঠিয়ে দেয়। বাচ্চাটি তার চেনা। তাদের পাড়ার কলি আপার মেয়ে শাপলা। আগ পাছ চিন্তা না করেই লেজিডেজি, বোতাম আর ডাল ফোঁড় দিয়ে কয়েকটা ফুল উঠিয়ে ফেলল। এরপর নিমাটি ডিসপ্লেতে ঝুলিয়ে দিল। একটু পরেই শাপলা আর তার মা এলো। ফুল ডিজাইন দেখে শাপলা যতটা খুশি হলো, তার মা ততটাই অখুশি হলেন। শীলাও নিজের কাজে এতক্ষণ বেশ তৃপ্ত ছিল কিন্তু হঠাৎ নিজের ছেলেমানুষিতে তার ভীষনই লজ্জা লাগতে শুরু করলো। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল, কী দরকার ছিল ফুল উঠানোর! কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না ঠিক কী কারণে কলি আপা বিরক্ত হয়েছেন। কলি আপাই পারলেন কথাটা, ‘‘শীলা তোমার টাকার দরকার জানি , কিন্তু অর্ডার নেয়ার সময় অন্তত জিজ্ঞেস করতে আমি কোনো ডিজাইন চাই কিনা! অন্য সময় হলে আমি এ কাপড় ডেলিভারি নিতামই না, নেহাৎ মেয়েটা পছন্দ করল।”।
শীলার মনে হল সে যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছি লজ্জায়। কলি আপার চোখে করুণার ছায়া। কলি আপা আবার বললেন, ‘‘বাড়তি চার্জ কত ধরেছ বল।”
শীলা কোনমতে কান্না গিলে বলল, ‘‘আমি কোনো বাড়তি চার্জের কথা ভেবে ডিজাইনটা করি নাই আপা, আপনি বিলের কাগজে যা লেখা আছে তাই দেন।”
কলি আপা বলল, ‘‘সত্যি বলছ? বাঁচালে ভাই, এমন একটা কাজের দাম জানো কত? কম করে হলেও তিনশ টাকা। আমার পক্ষে বাসায় পড়ার একটা জামার জন্য এত টাকা খরচ করা সম্ভব না। বুঝতেই পারছ, কিছু মনে করোনা।”
এরপর টাকাটা কাউন্টারে রেখে মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় শাপলা তার ফোঁকলা দাঁত বের করে থ্যাঙ্কু আন্টি বলে যেই হাসলো, কলি আপার উপরে শীলার যত রাগ হয়েছিল তা কর্পূরের মত উবে গেল।
শীলা ফোনের দিকে তাকায়, সাড়ে চারটা বাজে, এতক্ষনে নিশ্চয়ই পাভেলের ইন্টারভিউটা হয়ে গেছে, একটা ফোন করা দরকার। পাভেল আর শীলারা এক পাড়াতেই থাকে। শীলার থেকে তিন ক্লাস উপরে পড়তো বলে সবসময় বড়ভাই টাইপ শাসনে রাখতো। কিন্তু সেই শাসনগুলো পানি হয়ে ভালোবাসার রূপ যে কখন নিয়েছে সেটা তাদের দুজনের কেউই বলতে পারেনা।
হাতের টুকটাক কাজগুলো সেরে কী মনে ক’রে বজলুকে কাছের মার্কেটে পাঠালো দুই গজ হালকা টিয়া রংয়ের ভয়েল কাপড়ের জন্য। বজলু ফিরে আসতে আসতে আরো ও দু-তিনজন কাস্টমার বিদায় করল। শীলা যেখানে বসে সেখান থেকে আকাশটা দেখা যায়। এমন নীল আকাশ অনেকদিন চোখে পড়েনি। শীলার ভাবনায় ছেদ পড়ল। এক দম্পতি ঢুকেছে দোকানে। বউটি অন্তঃসত্ত্বা, শেষের দিকের সময়, এরা এসেছে ম্যাক্সি বানাবে। টেবিলের উপর থেকে লোকটি মাপের ফিতা নিয়ে নিজেই মাপ দিতে চাইলে শীলা জিজ্ঞেস করে, ‘‘ভাই কি দর্জি?’’
– না
– তাহলে আমাকে দেখতে দেন
শীলা বুঝলো কথাটা লোকটার পছন্দ হয় নাই। একটু জোর করেই লোকটার হাত থেকে ফিতাটা নিয়ে নেয়। এবার হল অন্য বিপত্তি। বউটাকে কোন কথাই বলতে দিচ্ছেনা লোকটা। একে তো প্রচণ্ড গরম, মাত্র মে মাস চলছে, তার মানে এমন গরম পড়বে আরো কয়েক মাস। তা তিনি হাতা দিতে বললেন কবজি অবদি, গলার মাপ পাঁচ ইঞ্চি, লম্বা পায়ের গোড়ালি ছাড়িয়ে ফ্লোর পর্যন্ত। বউটার অসহায় চাহনি দেখে খুব বিরক্ত লাগল শীলার। বললো পাঁচ ইঞ্চি গলা দিয়ে মাথা ঢুকবে না, বুকে বোতাম দিতে হবে। বউটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মনে মনে হাসলো, হায়রে, নিজের আরাম হয় এমন একটা কাপড় পরারও স্বাধীনতা নেই!
বজলু এসে কাউন্টারে টিয়া রঙা কাপড়টা রাখল। কাপড়টা পেয়েই শীলার হাতটা নিশপিশ করতে লাগল। কাঁচির ধারে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একটা ছোট ফ্রকের ডিজাইন বের হয়ে গেল। দ্রুত হাতে সেলাই ম্যাশিনের বুকে চালাতে লাগল জামাটা। আধা ঘন্টায় ফ্রকটা তৈরি। এবার ফ্রকটার বুকের কাছে ফুল তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। শীলা ভাবে, ইস্ আমার যদি একটা মেয়ে থাকতো তাহলে এই জামাটা তার হত। নিশ্চয়ই খুব খুশি হত জামাটা পরে! আচ্ছা, কী নাম থাকতো ওর! একটু ভাবনায় পড়ে গেল শীলা, তার মনে এখন মিহিদানা ছাড়া আর কোনো শব্দই আসছেনা। ভাবল ওর নাম মিহিদানাই হোক। চোখের সামনে সে যেন দেখতে পেল টিয়ারঙের জামাটা পড়ে মিহিদানার ছোটাছুটি করছে।
“শীলা আপা, কেমন আছেন?” বলে ফারজানা নামে শীলার এক পরিচিত কাষ্টমার দোকানে ঢুকলো।
– ভাল আপা, আপনি কেমন আছেন?
– এইতো
শীলা বিরক্ত হল। ভাল আছি এ কথাটা বলতে মানুষের এত কষ্ট কেন সে বুঝে পায়না।
– এই শাড়িটার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ লাগবে
– কোন কালার নিবেন?
শীলা তাক থেকে দুই তিনটা কাপড়ের থান বের করে কাউন্টারে রাখে। ফারজানা আপা বেশ কয়েকবার গায়ে কাপড় ফেলে দেখে নিচ্ছে, শীলা অপেক্ষা করে। ফারজানা আপা ফোন বের করে তার স্বামীকে ফোন দেয়, ফোন লাউড স্পিকারে থাকে।
– ঐ শাড়িটার ব্লাউজ কোনটা নিব?
– ডান দিকেরটা । কিন্তু ডিজাইন কী হবে?
– কিছু বলবে?
– আগের নীলটার মত না। আরও একটু ডিপ কাট আর চিকন স্লিভ
– আচ্ছা
“ব্লাউজের ডিজাইনও ভাইয়া বলে দেয়, খুব খেয়াল করে আপনার, না?” শীলা ফলস হাসি মুখে ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করে।
– তা একটু বেশিই করে
শীলা একটু অবাক চোখে তাকায়। ফারজানা আপা বলে, ‘‘আমার এইসব কাপড় পরতে ভাল লাগেনা। এটা মফস্বল, সবাই তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কী করব! আমি তো আর চাকরি বাকরি কিছু করিনা, যা বলে শুনতে হয় , না হলে চড় থাপ্পড়। আমার দাদার বাবা পীর ছিলেন, মনে মনে আল্লাহর কাছে কত মাফ চাই!
শীলা কাজ শেষ করে বিলের কাগজ ফারজানা আপাকে এগিয়ে দেয়, মুখে কিছু বলে না কিন্তু তার মনটা ব্যাথাতুর হয়।
এরই মধ্যে মেরী আপা আর তার মেয়ে লামিয়া দোকানে ঢোকে। মেরী আপা লামিয়াকে কাপড় পছন্দ করতে বলে। লামিয়া একটা হালকা মিন্ট কালারের উপরে সাদা ডট প্রিন্টের কাপড় পছন্দ করে। শীলা মেরী আপাকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আপা এটা দেব?”
– ও যেটা চায় সেটাই দাও
– ডিজাইন?
– সেটাও লামিয়া ঠিক করুক
– আপা আপনি পছন্দ করবেন না?
খানিকটা অবাক হয়েই শীলা জিজ্ঞেস করে।
– না, ও নিজের পছন্দ নিজে বুঝে নিক।
মিষ্টি করে হাসলেন মেরী আপা। বললেন, ‘‘শোনো আমাদের মা-বাবা বা বড়রা আমাদের উপর অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন যেগুলা আমরা পছন্দ করতাম না। এই ধর, আমার খুব কমলা রংয়ের জামা পড়তে ইচ্ছা হত কিন্তু আমার জন্য আমার মা সবসময় সাদা বা হালকা গোলাপী রংয়ের কাপড় কিনতেন। আমার বন্ধুরা কত ডিজাইনের জামা পরত কিন্তু মা আমার জামা সব সময় ঘরে তৈরি করতেন। মা বলতেন দর্জির কাছে জামা বানালে মানুষ খারাপ ভাববে। ঘরের ভিতরে থাকতে থাকতে পৃথিবী সম্পর্কে এক অদ্ভুত ধারনা তৈরি হয়েছিল তার। এতে যে খুব টাকা বাঁচত তা কিন্তু না, তবে আমার মন খারাপ হত, আমি আমার শৈশবটাকে এভাবে হারালাম। আর কী হল জানো, আমার নিজের মতামত দেবার অভ্যাসটা হল না। আমি চাই আমার মেয়ে স্বাধীন হোক। যাই করুক নিজের ইচ্ছা মত করুক, শুধু ভুল হলে ধরিয়ে দেব।
মেরী আপার কথায় হারিয়ে গেল শীলা। তার মনে হতে লাগল মিহিদানাও এরকম স্বাধীন হবে। আজ আর ভাল লাগছেনা শীলার। সন্ধ্যা সন্ধ্যায়ই দোকান বন্ধ করে দেয়। দোকান বন্ধ করার আগে মিহিদানার জন্য বানানো জামাটায় পরম মমতায় হাত বুলায়, মনে মনে ভাবে যত আবেগ দিয়েই তৈরি হোক, মিহিদানা না পরতে চাইলে এ জামাটাও পরতে কখনো বাধ্য করবে না সে মিহিদানাকে। তারপর একটা প্যাকেটে নিয়ে যত্ন করে জামাটা তুলে রাখে।
রাস্তার পা বাড়াতেই শীলার মনে পড়ে মা লাড্ডু নিতে বলেছে, মিহিদানার লাড্ডু।