মুজিব: স্থপতির মৃত্যু
হাসান মোরশেদ।।আগস্ট ২৫,১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর ‘The Time’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন। এতে মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়-
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার উপর ক্রমশ বিরক্ত হয়ে নিজের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীকরনের সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী- ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, এ বছরের জুন মাসে ।
এ সিদ্ধান্তগ্রহণে হয়তো তাকে প্রভাবিত করেছিল ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশ।
অর্থনীতির অচল অবস্থা এবং অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় এবং গত জানুয়ারি মাসে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে তিনি আরও বেশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হন ।
এ পরিবর্তন কাউকে বিস্মিত এবং প্রায় সবাইকে ব্যথিত করে। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান সবার কাছে পরিচিত ছিলেন যুক্তিবাদী, গণতান্ত্রিক এবং অবশ্যই একজন সৎ ও সাহসী মানুষ হিসাবে।
তাঁর নেতৃত্বকে অযোগ্য অভিযুক্ত করে গত সপ্তাহে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী এক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। যাকে তাঁর দেশের মানুষ ভালোবেসে ‘বঙ্গবন্ধু’ ডাকতো, যার নেতৃত্বে মাত্র চার বছর আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে- তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তাঁরই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের এক সহকর্মী।
যদি ও অভ্যুত্থানের পর পর বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সংবাদ সংগ্রহে বাধা দেয়া হয়, তবু প্রাপ্ত সংবাদ থেকে অনুমান করা যায় এ অভ্যুত্থান বেশ রক্তাক্ত। শেখ মুজিবের সাথে তাঁর দুই ভাগনে এবং প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী নিহত হওয়ার কথা শোনা গেছে। এছাড়া সারা দেশে মুজিবের ২০০ অনুসারীকে হত্যা করার খবরও পাওয়া গেছে ।
সপ্তাহশেষে অভ্যুত্থানকারীরা এক ঘোষণায় জানিয়েছে যে, নিহত নেতাকে ‘যথাযোগ্য মর্যাদা’য় তাঁর গ্রামের বাড়িতে কবর দেয়া হয়েছে। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে এ ছাড়া আর কোন সরকারি ভাষ্য জানা যায়নি।
পিপলস রিপাবলিক থেকে ইসলামিক রিপাবলিক বাংলাদেশ
ভোরবেলা শেখ মুজিবকে হত্যা করার পরপরই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম এবং চরিত্র বদলে দেয়া হয়। অভ্যুত্থানকারীদের নেতা ডালিম নামের একজন মেজর রেডিওতে ঘোষণা করেন যে- এখন থেকে দেশের নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’, ‘পিপলস রিপাবলিক’ নয়। খন্দকার মোশতাক আহমদকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়, যিনি মুজিব মন্ত্রীসভার বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া ডালিম সামরিক আইন জারি ও সারাদেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য ২৪ ঘণ্টা কারফিউ ঘোষণা দেন। সেই সাথে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন- ‘নতুন সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র, আন্দোলন ও প্রচারণা অত্যন্ত কঠোর হাতে দমন করা হবে’। তার এ ঘোষণার সময় ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান মোতায়েন ছিল।
পরে আরেক রেডিও সম্প্রচারে নতুন রাষ্ট্রপতি জাতিকে আস্বস্ত করেন যে, দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও একনায়কতন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করতেই এ পরিবর্তন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সমালোচনা করে বলেন যে তার সরকার দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর খন্দকার মোশতাক তার ১৬ সদস্যের কেবিনেট ঘোষণা করেন। আশ্চর্যজনকভাবে নতুন কেবিনেটের প্রায় সকলে, সেই কথিত ‘ব্যর্থ সরকার’ এরই প্রাক্তন সদস্য ।
কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করিয়ে দেন যে, ৭১-এ প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বপালনকালে খন্দকার মোশতাক, মুজিবের প্রতি অনুগত ছিলেন না এবং তার ভূমিকা ছিলো সন্দেহজনক। স্বাধীনতার পর অভিযোগ ওঠে যে, যুদ্ধচলাকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমেরিকার ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক ছিলেন মোশতাক।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে, মুজিব সদ্যস্বাধীন দেশের অতিগুরুত্বপূর্ন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেন এবং তরুণ ডঃ কামালকে স্থলাভিষিক্ত করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় ডঃ কামাল বেলগ্রেডে অবস্থান করছিলেন।
সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী খন্দকারকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ চর বলেও সন্দেহ করেন। পাকিস্তানের ভুট্টো সরকারই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে এই নতুন সরকারকে।
কিন্তু মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভারতের প্রতিক্রিয়া সবাইকে স্তম্ভিত ও মর্মাহত করেছে।
একজন সরকারি মুখপাত্র কেবল একটা বিবৃতি দিয়েছেন: ‘তাঁকে আমরা আমাদের সময়ের অত্যন্ত সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে গণ্য করি।’
নিহত মুজিবের ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও জাদুকরী। তাঁর প্রাণচাঞ্চল্য উদ্যমী করে তুলতো সবাইকে। তার আবেগময় ভাষণে লক্ষ লক্ষ জনতা উদ্বেলিত হতো।
একজন বিশ্লেষক বলেন: ‘‘আমি গান্ধী, জিন্নাহ ও নেহেরুর রাজনীতি এবং জনসম্পৃক্ততা দেখেছি। কিন্তু মুজিব লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে যে প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারতেন, এর কোন তুলনা হয়না। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবিত করার ক্ষমতা, তা অন্য কোনো নেতার কখনোই ছিলোনা।’’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে মুজিব যখন প্রথম কারাবন্দী হন, তখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের কারাগারে তাঁর কেটেছে অন্তত দশ বছর । মজা করে তাই বলতেন, ‘‘কারাগার তো আমার দ্বিতীয় বাড়ি।’’
১৯৪৯ এ তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৭০ এ পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে দলের জন্য নিরঙ্কুশ বিজয় ছিনিয়ে আনেন। সংবিধান অনুযায়ী তাঁর সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানীরা নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করে। ফলে খুব দ্রুত পাকিস্তানের দু’অংশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
এ সময় মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘‘তোমাদের হাতে অস্ত্র আছে, তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারো। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা তোমরা আটকে রাখতে পারবে না।”
এরপর সামরিক একনায়ক ইয়াহিয়া খান তাকে বন্দি করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। আর পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় সামরিক আগ্রাসন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করে ৩০ লক্ষ বাঙালি, এক কোটি শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। পরে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ৯ মাসের মাথায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। পরাজিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবর্তনে ইয়াহিয়া খান গৃহবন্দি হন আর শেখ মুজিব মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে।
৭২ এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুজিব ফিরে এলে দেশবাসী এক অনন্য সম্বর্ধনার মাধ্যমে তাঁকে বরণ করে নেয়। ইতিহাসে এর আগে আর বোধ হয় কোনো নেতা এতো বিশাল সম্বর্ধনায় সিক্ত হননি। সম্বর্ধনার সাথে সাথে মুজিব এমন এক রাষ্ট্রের দায়িত্ব পান, যে রাষ্ট্রের কেবল একটা কাঠামোই অবশিষ্ট ছিল, এর বেশি আর কিছু নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি, সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ।
প্রশাসন বলে কিছু নেই, শিল্পকারখানাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, সমুদ্র ও বিমান বন্দরগুলো ব্যবহার অনুপযোগী, রেললাইন উপড়ে গেছে, দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী ও দক্ষ পেশাজীবীদের প্রায় সকলে নিহত।
অর্থনীতির তলানি বলতে যা কিছু ছিল তাও ৭৩ এর খরা ও ৭৪’র বন্যায় শেষ হয়ে যায়।
তাঁর প্রশংসনীয় উদ্যোগ
স্বাধীনতার পরের তিন বছরে ৬০০০ এরও বেশি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। সহিংসতা সারাদেশব্যপী ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা তৈরি হলে মুজিব রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। চরমবাম ও চরম ডানপন্থী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করা হয়, পত্রিকাগুলোকে নিয়ে আসা হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়।
এ উদ্যোগগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে গৃহীত হলেও অনেকেই সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন। সমালোচকদের উদ্দেশ্যে মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেন, ‘‘ভুলে যেওনা আমি মাত্র তিন বছর সময় পেয়েছি। এই সময়ের মধ্যে তোমরা কোনো দৈব পরিবর্তন আশা করতে পারোনা।”
যদিও শেষ সময়ে তিনি নিজেই হতাশ ও বিরক্ত হয়ে কোনো দৈব পরিবর্তন ঘটানোর জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন।
সন্দেহাতীতভাবেই মুজিবের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুজিব একটা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে ‘সোনার বাংলা’র উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে মুজিব সেই ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নকে তাঁর দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন।
হাসান মোরশেদ: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক 1971 Archive