নারী নেতৃত্বের গোপন অস্ত্র: আইকিউ না ইকিউ? [পর্ব – ০২]
ক্যামেলিয়া আলম।। এবারে আরেক গল্প দিয়ে শুরু করি। কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করা এক ব্যাক্তি মনস্থির করলো চাকরি সে ছেড়ে দেবে। রিজাইন লেটার নিয়ে গেল অফিস অ্যাডমিনের কাছে। অ্যাডমিন চিফ দে’খে কারণ জানতে চাইলো তার চাকরি ছাড়ার। সে জানালো, এ অফিসের পরিবেশে সে খাপ খাওয়াতে আর পারছে না, প্রত্যেকে প্রত্যেকের পেছনে কন্সপিরেসিতে ব্যস্ত থাকে। আর শুধু তাই না, এখানে আড়ালে মেয়েদের নিয়ে খুব বাজে আলোচনা চলে। কাজেই এমন এক নোংরা পরিবেশে মন মেজাজ ঠিক রেখে কাজ করা একেবারেই অসম্ভব।
চিফ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলো। এরপর বললো, ঠিক আছে, আমি রিজাইন লেটার টেবিলের উপর রাখছি। তা গ্রহণ করার আগে শেষ এক নির্দেশনা পালন করা যায়? উনি রাজি হলেন। তখন চিফ বললেন, আপনি আপনার ডেস্কে গিয়ে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে পুরো অফিস তিনবার ঘুরে আসেন, খেয়াল রাখতে হবে পানি যেন মেঝেতে না পড়ে। এরপর আমি আপনার লেটার একসেপ্ট করছি। ব্যাক্তিটি খানিক অবাক হয়ে ডেস্কে গেলেন, আর নির্দেশমতো পানি ভরা গ্লাস নিয়ে অফিস তিনবার ঘুরে এসে চিফকে জানালেন কাজটি সমাধা করেছেন যথাযথভাবে। এসেই তাড়া দিলেন রিজাইন লেটার একসেপ্ট করার। চিফ শান্ত স্বরে বললেন, যাবেন, ভালো কথা। এর আগে আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান। পানিতে ভরা গ্লাস নিয়ে সারা অফিস ঘোরা নিয়ে কে কে আপনাকে কটাক্ষ করেছে, হেসেছে আর কানাকানি করেছে। কর্মকর্তাটি একটু চিন্তা করে বললেন, খেয়াল করিনি। চিফ আবার প্রশ্ন করলেন, সারা অফিসই তো ঘুরলেন। এবার কাকে কাকে দেখলেন কন্সপিরেসিতে ব্যস্ত। অধস্তন ব্যাক্তিটি কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, আমি খেয়াল রাখছিলাম পানি যাতে পড়ে না যায়, তাই শুনিনি কে কী বলছিল। এবার চিফ তাকে বললেন, আপনি যদি কোন বিষয়ে আপনার ফোকাস দেন তাহলে যা যা অভিযোগ করলেন তা আপনাকে কাজের মনোযোগ নষ্ট করতে পারতো?
গল্পটি আমাদের এক ধরনের আইডিওলজি নিয়ে চিন্তা করালেও আমার বলার উদ্দেশ্য ভিন্ন। বলার বিষয়, নির্বাহী’র ভূমিকা। এই ছোট গল্পে বসের চরিত্রায়ণে তাকে যৌক্তিক, সহানুভূতিশীল আর বুদ্ধিদৃপ্ত মনে হয়নি? এই গুণগুলিই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। যা কেবল নির্বাহী না, একজন মানুষ হিসেবে মানসিকতার নিয়ন্ত্রণ সমাজের প্রতি স্তরে সফলতা এনে দেয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে নারীর মাঝে এই গুণাবলী থাকার কারণেই তারা প্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে, ব্যবসা বাণিজ্যে সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরুষের মাঝে এই গুণগুলো নাই তা কিন্তু না, তবে অধিকাংশের মাঝে যতটা লাউডনেস থাকে, অ্যারোগেন্ট হবার প্রবণতা থাকে তার সিকিভাগ থাকে সততা, সমস্যার কারণ বুঝে সমাধানের চেষ্টা, মানুষের বৈচিত্র্যকে অ্যাকসেপ্ট করার ক্ষমতা।
আশাবাদ, পজিটিভ কমিটমেন্ট, নিজের অনুভূতির পাশাপাশি অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, মনোযোগী হওয়া, অন্যের সাথে দ্বন্দ্ব হলে তার কারণ বের করে সমাধানে এগিয়ে আসা, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা সবাই অর্জন করতে পারে না। তারাই পারে যারা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট। আর আমাদের প্রচলিত মানসিকতায় সাধারণত আমরা কর্তৃত্ব বলতে ভাবি, উচ্চস্বর, হাউকাউ আর অস্বচ্ছ আচরণ, কোন কাজ করাতে অধস্তনকে বাধ্য করালেও শ্রদ্ধার কর্মপরিবেশ আর থাকে না। নমনীয় ব্যক্তিটি নির্বাহী হলে সেখানকার কর্মকুশলতা বাড়ে অনেক বেশি। এ এখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয় না, রীতিমতো গবেষণায় প্রমাণিত।
সংখ্যায় খুব কম থেকেও নারী নেতৃত্বের সফলতার কারণ খুঁজতে গিয়ে খুব গুরুত্বের সাথে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা এবার একটু বলি।
আমরা সফলতার হিসাব কষতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রগামী মানুষ হিসেবে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান নেয়া কর্তৃত্বপরায়ণ পুরুষের দিকে তাকাই। অথচ সেই পুরুষটির মতো হতে গিয়ে একজন নারী পুরুষতন্ত্রের বাহনে পরিণত হচ্ছে, না বুঝেই। আমরা এটুকু নিশ্চয়ই এখন বুঝি যে, পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ এক কথা না। ফলে অ্যাগ্রেসিভনেসকে, অ্যারোগেন্ট পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে যতই আদর্শ ভাবি না কেন তা যে কোন যাত্রার এক অস্থায়ী অবস্থান।
নারীরা সাধারণত বেড়ে ওঠে প্রতিকূলতার মাঝ দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই আমরা সাধারণত মেয়ে বাচ্চাটিকে জীবনে টিকে থাকতে শেখাই সহানুভূতি আর সহনশীলতা। অন্যের আবেগ বুঝে মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়া, ধরে রাখাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে শেখাই। আর ছেলে বাচ্চাকে শেখাই কী করে সে স্পোর্টসি হতে পারে অর্থাৎ লাউড, চঞ্চল, ইগোইটিক আর শেখাই কী করে অন্যের উপর কর্তৃত্ব করে সমাজে তার আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে। ফলে ছেলেদের প্রায়ই প্রকৃতিবিরুদ্ধ হয়ে তাদের আবেগ প্রকাশ করতে বাধা দেই। এতে মানুষের সুকুমার বৃত্তি নষ্টই কেবল হয় না, ধীরে ধীরে তার প্রাকৃতিক মনোবৃত্তিকে অবদমন করতে করতে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
কাজেই একজন ভালো বাবা মা হতে চাইলে বা বাচ্চাকে সফল হিসেবে দেখতে চাইলে, তাকে অনুভূতি, স্ট্রেস, আনন্দ, বেদনাকে সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করতে শেখালে তারই কেবল উপকার না, একটা সমাজেও মানসিক চাপের পরিমাণ কমে সমাজ হয় পারস্পরিক বোধের, পরমতসহিষ্ণুতার। আর নারীরা ঠিক এই কারণেই পাবলিক আর প্রাইভেট (পরিবার) সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
হে গ্রুপের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, উচ্চ পর্যায়ে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স অধিকাংশই দেখা যায় নারী নির্বাহীদের মাঝে। পুরুষ নির্বাহীর মাঝে থাকে অধস্তনদের যে কোন কাজে অংশগ্রহণ করাবার চেয়েও নির্দেশনা মানাবার চেষ্টা। অন্যের আবেগ, সুবিধা অসুবিধা বুঝতে পারার চেয়ে এক শ্রেণির সু্বিধাভোগী তৈরি করার অভ্যস্ততা। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় চলতে থাকে নন স্টপ কন্সপিরেসি। আর সংগঠনটির কর্মীর কাজের ফোকাসের চেয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার ফোকাসেই মনোযোগী হতে হয়। কাজেই যে সব নারীরা এখনও সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পুরুষতন্ত্রের এই ফাঁদে পা বাড়াচ্ছেন, তাদের এখনই সরে আসা উচিৎ, যদি একজন সফল নির্বাহী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান।
অনেকে ভাবেন নারীরা প্রাকৃতিকভাবেই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট। হে গ্রুপের গবেষণায়, এই তথ্যকে পুরোই অস্বীকার করা হয়েছে। দেখা গেছে সফলতার শীর্ষে অবস্হান নেয়া সেলিব্রিটি আর উদ্যোক্তা যত পুরুষ দেখা যায় তারা প্রত্যেকেই ই কিউ ( ইমোশনাল কোশেন্ট) সম্পন্ন। টেবিলের অন্য প্রান্তের মানুষটিকে বোঝার সক্ষমতার উপর নির্ভর করে কতটা ভালো নির্বাহী আপনি হবেন।
এখানে আরেকটি বিষয় জানাও সেই সাথে প্রয়োজন। নারীরা অনুভূতিপ্রবণ হয় পুরুষের তূলনায় বেশি। নিউরোসায়েন্সিটদের মতে, ইনসুলা বলে এক হরমোন আছে, যা পুরো শরীরে অনুভূতির সিগনাল পাঠায়। যখন আমরা কারও প্রতি সহানুভূতিশীল হই, আমাদের মস্তিষ্ক সেই ব্যাক্তির অনুভূতি কপি করে, ইনসুলা তখন তা রিড করে সেই প্যাটার্ন পাঠায় ব্রেনে, আর তখন ওই ব্যাক্তির অনুভূতির এক চিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাই।
এই কারণটিই নারী পুরুষকে আলাদা করে দেয়। যখন কোন ব্যাক্তি আপসেট হয়, নারীর মস্তিষ্ক তার অনুভূতির প্যাটার্ন পেয়ে যায়, পুরুষটিও পায়। তবে নারীটি অন্যের অনুভূতির এই প্যাটার্ন জেনে তার আবেগ উপশম করার চেষ্টা ক’রে সমাধানের দিকে এগিয়ে যায়, আর পুরুষটি অনুভূতিটি বুঝে মনোযোগ সরিয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
কাজেই যখন নারীটি দোষারোপ করে পুরুষটি তার অনূভূতির মূল্য দেয় না, এর পেছনে বেশিরভাগ কারণ ব্রেনের কাজ তাদের আলাদা। পুরুষটি অনুভূতিটি বুঝে তা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে দ্রুত রিলিফ করায় অধিক মনোযোগী থাকে। ফলে তারা শান্ত হয়ে যায় দ্রুত, যখন অন্য প্রান্তের মানুষটি থাকে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। নারীরা তখন প্রবণতার কারণেই অন্যকে বুঝিয়ে, সহযোগিতা করে তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করে।
একটা কথা মনে রাখা জরুরি যে, এই দুই ধরনের প্রবণতাই ভালো। আর প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কোন বিষয়ের স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য সমস্যার মূলকে উৎপাটন করা জরুরি। চাপ সহ্য করার ক্ষমতা, পারস্পরিক আস্থা, মধ্যস্থতা, প্রভাবিত করা, কর্মস্থলে রাজনীতি বুঝে চলা আর যে কোন ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টাই সফলতার স্থায়ী সমাধান। আর এই গুণাবলীর চর্চা করেই নারীরা আজ সফলদের তালিকায় নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে।
[চলবে]
প্রথম পর্ব: নারী নেতৃত্বের গোপন অস্ত্র: আইকিউ না ইকিউ? [পর্ব – ০১]