December 23, 2024
অনুবাদসাহিত্যকবিতাফিচার ৩

ফাওজিয়া আবু খালিদের কবিতা

সমসাময়িক আরব কবি ফাওজিয়া আবু খালিদ। ১৯৫৫ সালে তাঁর জন্ম রিয়াদে। ১১ সন্তানের এক উচ্চবিত্ত বেদুঈন পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, সমাজতাত্ত্বিক।  কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজত্ত্বের প্রফেসর ফাওজিয়া তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক ও নারীবাদী ভাবনার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে আধুনিক হিসেবে স্বীকৃত। ব্যতিক্রমীভাবেই ১৯৫০ ও  ১৯৬০-এর দশকে মাত্র আঠার বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিয়ের রাতে যতক্ষণ না তারা তোমাকে অপহরণ করছে সে অবধি?’ ( ১৯৭৪)। তাঁর কবিতায় উদযাপিত হয়েছে সউদি নারীদের শক্তিমত্তা, প্রজ্ঞা এবং সক্ষমতা। আর এজন্য আরব নারীদের আধুনিক কবিকণ্ঠ ফাওজিয়া। আরব উপদ্বীপ, মরুভূমি আর মরুদ্যান, জমজম কূপ আর হুরি ইত্যাদি ঐতিহ্যিক ইসলামি প্রতীক তাঁর মুসলিম পরিচিতির উল্লেখযোগ্য স্মারক হিসেবে কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য ফাওজিয়া আবু খালিদের পাঁচটি কবিতার অনুবাদ করেছেন মুজিব রাহমান।।

 

মায়ের উত্তরাধিকার

মা,

উত্তরাধিকার হিসেবে আমার বিয়ের  জন্য কোনো কণ্ঠহার তুমি রেখে যাওনি

কিন্তু একটি গ্রীবা রেখে গিয়েছো যেটি গিলোটিন ছাড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে

আমার মুখাবয়বের জন্য ফুলতোলা কোন ঘোমটা রেখে যাওনি

কিন্তু রেখে গেছো শ্যেনদৃষ্টি যা আমাদের পুরুষদের কটিবন্ধে থাকা ছোরার মতো চকচক করছে।

একটি খেজুর গাছ রোপণের সুপরিসর এক খণ্ড জমি রেখে যাওনি

কিন্তু রেখে গেছো ‘উর্বর অর্ধচন্দ্রাকার’ এক আদিম ফল:

আমার জরায়ু।

আমাদের পাড়ার সব সন্তানের সঙ্গে তুমি আমাকে শুতে দাও যাতে আমার যাতনা জন্ম দিতে পারে নূতন বিদ্রোহীদের।

তোমার ইচ্ছেপত্রের পুটলিতে

আমি ভেবেছিলাম খুঁজে পেতে পারি বেহেশতের বাগান থেকে একটি বীজ যা আমি বপন করতে পারি ঋতু পরিত্যক্ত আমার হৃদয়-জমিতে

পরিবর্তে আমার কাছে রেখে গেলে এক খাপখোলা তলোয়ার

যার ফলায় খোদিত আছে এক রহস্য শিশুর নাম

আমার প্রতিটি রন্ধ্র

প্রতিটি ফাটল

খুলে গেলো:

একটি খাপ।

তলোয়ারটি আমি সজোরে বসিয়ে দিলাম আমার হৃৎপিণ্ডে কিন্তু বক্ষপ্রাচীর এটিকে রোধ করতে পারেনি

আমি এটিকে সজোরে ফুসফুসে বসিয়ে দিলাম

কিন্তু ফুসফুস সেটিকে পুষিয়ে নিতে পারেনি

আমি এটিকে সবেগে আমার কটিতে বসিয়ে দিলাম

কিন্তু কটিদেশ তার জন্যে ছিল অপরিসর

সরকারি অবকাশের  সাজসজ্জা খসিয়ে

এটি একটি দীর্ঘায়ত সড়কে পরিণত হলো

পিচ বসানো পথ আসন্ন ভোজ মৌসুমের কথা ঘোষণা করছিলো।

মা,

আজ,তারা এসেছিল তোমার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার বাজেয়াপ্ত করার জন্য।

তারা শিশুদের অঙ্গুলাঙ্কের মানে উদ্ধার করতে পারেনি

তারা সে পথ মাড়াতে পারেনি যেটি ছড়িয়ে পড়েছিল আমার হৃদয়ের ধমনী এবং দেহতন্ত্রীর মাঝে

যা শিশুদের খাবার যোগায় প্রতিটি মাতৃগর্ভে।

তারা পাড়ার সন্তানদের পাকড়াও করেছিল জেরা করার জন্য

তারা শিশুদের দৃষ্টির সারল্যকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি।

তারা আমার পকেট তল্লাশী করলো

আমাকে বিবস্ত্র করলো

আমার চামড়া ছাড়িয়ে নিলো

কিন্তু চকচকে রেশম যা আমার বুকের যুগল পারাবতকে সযত্ন আগলে রাখে তারা সেখানে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলো।

[কবিতাটি কবির  “উর্বর অর্ধচন্দ্রাকৃতি স্থানের নারী” শীর্ষক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত এবং  কামাল বোলাটা সম্পাদিত ‘আরব নারীদের লেখা আধুনিক কবিতা’-গ্রন্থ হতে সংগৃহীত]

 

ছোট্ট দুই বালিকা

(আমার মা, কবি নূর, তাঁর উদ্দেশে

যার পঙক্তিমালা আমি আত্মসাৎ করি)

আমি তার পোষাকের পাড়ে ঝুলে থাকি

অনড় ঘুড়ির সুতোয় এক শিশুর মতোন

কাঠবাদাম গাছে একটি কাঠবেড়ালির মতো আমি তার বিনুনি বেয়ে উঠি

শেষ বিকেলে আমরা এক জগৎ থেকে আরেক জগতে

লাফিয়ে বেড়াই

আমরা বাতাসে খেলে বেড়াই

চড়ুই পাখির মতো যা দরোজা খুলে দিয়েছিল খাঁচার দিকে

সে আমাকে শেখায়

ফুলের নাম

বর্ষা ঋতু

আমাদের দেশকে ভালোবাসা

আমি তাকে শেখাই

অবাধ্যতা এবং অনিষ্টাচরণ…

একটি আপেল এবং অসংখ্য স্বপ্ন আমরা ভাগাভাগি করি

মরুভূমির বুকে আমরা আঁকি জিজ্ঞাসাভরা এক জান্নাত

আমরা পরস্পরের দিকে ছিটিয়ে দেই মরীচিকা জল

সঙ্গে থাকে এক ধাবমান হরিণী।

[নাথালি হ্যানড্যাল সম্পাদিত ‘আরব নারীদের কবিতা’]

 

উল্কি লেখা

তোমার গোত্রের বর্শায় আমি লিখিনা

কারণ এসব ভোঁতা

কিন্তু আমি লিখি আমার নখ দ্বারা

সীমানাহীন শব্দাবলী

বোন,

তোমার জাফরিকাটা জানালায়

সূর্যের রশ্মিতে বুনে তুমি উৎকীর্ণ করেছো

ভালোবাসা-গীত।

তুমি আমাকে বলতে

গোত্রের সব ঐতিহ্য ও ব্যবস্থাপত্র

গ্রহণ করেছো জীবন্ত সমাহিত হওয়ার

হাত থেকে রক্ষা পেতে।

তোমার ত্বকের ওপর

দু’এক ইঞ্চি চমৎকার উল্কি

এক অন্তহীন বাঁকারাত এঁকে দেবে

তোমার দেহে।

এ গোত্রকে তোমার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার বিষয়টি আমাকে তীব্র যাতনা দেয়

তোমার কলেজের আসনে তোমার দাদিমার মতো

যে ভাবতো সে  বাড়িতে জেতা এক লটারির টিকেট।

বিশের কোঠায় এক নারী

বসে আছে কোনো এক তাঁবুর সামনে

ঢিলে জামা আর অবগুণ্ঠনে ঢাকা

চরকার টাকু হাতে কিন্তু বুনছে না।

তোমার মুখে জোব্বার কথা শুনে

গোত্রের মানুষটি তোমার জন্যে তা কিনেছিল।

তুমি আভিজাত্য নিয়ে গর্ববোধ করছো

সব বাপকা ব্যাটা, উওরসূরীরা

একথা শুনেছে।

তোমার কণ্ঠে আরব সর্দারের কণ্ঠ তোমাকে রদ করে দিয়েছে।

বোন

আমার রাজ্য গবাদি পশুর যৌতুক দাবি করে না

এভাবে গোত্র আমাকে পরিত্যাগ করে

তুমিই তাদের বৈধ সন্তান

আর আমি তো এক অস্বীকারকারী

অকৃষ্ট কুমারী ভূমির তুমি সামন্ত প্রভু

আর আমি সামন্ত প্রভু রক্তাক্ত অগ্নি ঋতুর

কতোটা সময় ধরে তারা তোমাকে ধর্ষণ  করতে

থাকবে তোমার বাসর রাত্রিতে?


আকাঙ্ক্ষার দূরত্ব

যখন তুমি বেড়াতে যাও

এবং একটি অক্ষরের মাধ্যমে আমি

তোমার পেছনে একটানা লেগে থাকতে

পারি না।

কারণ, তোমার এবং আমার মাঝে দূরত্ব

‘ও’ ধ্বনির চেয়েও হ্রস্ব।

সুতরাং শব্দাবলী অকিঞ্চিৎকর

আমার আকাঙ্ক্ষার দূরত্বের চেয়ে।

 

প্রজাপতি

যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে

আমার কোন শোকগাথার দরকার পড়েনি

কারণ তুমি আমার হৃদয়ে এক ঝাঁক প্রজাপতি এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছিলে যাদের পথরেখা

আমি একজন বেদুইনের মতো অনুসরণ করি

যে জানে কতোটা নিখুঁতভাবে পদচিহ্ন ধরে

খুঁজে পাওয়া যায় তার পালিয়ে বেড়ানো মাদি ঘোড়াটিকে।