September 20, 2024
কলামফিচার ৩

শব্দের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত মন, চুপ করে থাকবেন না

নাফিসা শামা প্রভা।। নারী নির্যাতন বা গৃহনির্যাতন শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এগুলো পড়ার সাথে সাথে কী রকম ছবি চোখে ভেসে ওঠে বলুন তো? বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে প্রথমেই মনে চলে আসবে একটাই চিত্র- একজন পুরুষ একজন মহিলাকে আঘাত করছে; সে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা দিয়ে কিংবা পুরুষের বলিষ্ঠ দুটো হাতই তো যথেষ্ট কোন মেয়েকে ‘সোজা রাস্তায়’ আনার জন্য। শারীরিক নির্যাতনের অনেক ঘটনা আমরা প্রতিনিয়তই পত্র-পত্রিকায় পড়ে থাকি, আমাদের আশেপাশের পরিচিত মানুষের কাছেও অনেক সময় শুনতে পাই। এই নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, আইন প্রণয়ন সব হচ্ছে- ধীরে ধীরে নারীরা তাদের নির্যাতনের কথা মুখ ফুটে বলছে প্রকাশ্যে। তবে শারীরিক নির্যাতনই কি একমাত্র নির্যাতন?

আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুব সুকৌশলে বপন করা আছে নারীবিদ্বেষের বীজ। বিভিন্ন রূপে আমরা সেটার আত্মপ্রকাশ দেখি। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি গালিগালাজ, নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর শব্দ-বাক্য একজন নারীর মনে কতটা খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে তা পরিমাপ করার কোন মানদণ্ড তো আমাদের কাছে নেই। শরীরের আঘাত আপনিই শরীরে প্রমাণ রেখে যায়, কিন্তু শব্দের ত্রিশূলে ক্ষতবিক্ষত মনে সুদূরবিস্তৃত প্রভাব প্রমাণ রাখলেও তা অদৃশ্য হওয়ার কারণে আমরা একে উপেক্ষা করে ভুল করি। দুটো উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কতটা ব্যাপক আর প্রাচীন এই অদ্ভুত নারীবিদ্বেষের চর্চা।

‘হলুদ জব্দ শিলে, আর বউ জব্দ কিলে’

এই অতি প্রাচীন প্রবচনটির উৎপত্তি ঘাটতে গিয়ে কোন সঠিক উৎস পেলাম না, তবে আমি এইটুকু আঁচ করতে পারি যে গ্রামে-গঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর একজন নারীকে কি করে বজ্রমুষ্ঠিতে রেখে সকল সেবা আদায় করে নেওয়া যায় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই বাক্যটি। কিন্তু উৎপত্তি যেখানেই হোক না করে, এই ধ্যান-ধারণা আজকের এই আধুনিক সমাজেও যদি কোন পুরুষের মুখে শোনেন যে কিনা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী– আপনার কি খটকা লাগবে না? মানুষ তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে নিজের ধ্যান-ধারণা গড়ে তোলে, তারপর সেখান থেকেই সে শেখে কী করে সেসব চিন্তা-চেতনার মধ্যে কোন বিষয়টি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি কোনভাবেই মেনে নেওয়ার নয় তার মধ্যে বিভেদ করতে হয়। একটি ছেলে যদি এমন পরিবারে বড় হয় যেখানে সে দেখে আসে তার বাবা কারণে-অকারণে তার মায়ের গায়ে হাত তোলে, কিংবা অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করে, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় সে এই ধারণা পোষণ করে বড় হয় যে- এরকম করেই হয়তো বা একজন নারীর সাথে আচরণ করা উচিত! শুনতে খুব অদ্ভুত লাগলেও মানুষের চিন্তা-চেতনার শুরু তার বাবা-মা, পরিবারের কাছ থেকেই। কিন্তু এরপর সেই ছেলে বড় হয়ে লেখাপড়া করে, আর পাঁচজনের সঙ্গে মিশে পার্থক্য করতে পারে যে এতদিন যা সে স্বাভাবিক সাধারণ আচরণ ভেবে এসেছে সেগুলো আসলে সাধারণ তো না বটেই, বরঞ্চ সোজাসাপ্টা নির্যাতন। তখন তার মধ্যে পরিবর্তন আসাটা বাঞ্ছনীয়। সকলের ক্ষেত্রেই যে এই একই রীতি ফলবে তা আশা করাটা যেমন দুরাশা, তেমনি বাস্তবও আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে।

আরেকটি উদাহরণ দিই।

‘পুরুষ জেদে হয় বাদশা, নারী জেদে হয় বেশ্যা।’

আমি জানি না আপনারা এই প্রবচনটির সাথে পরিচিত কিনা, তবে আমি মোটেও এ ধরণের অদ্ভুত, রীতিমত ‘সৃজনশীল’ প্রবাদের সাথে পরিচিত ছিলাম না কয়েক বছর আগেও। পুরুষের পৌরুষ প্রকাশ করার কী পন্থা! আর নারীরা মুখ গুঁজে পড়ে থেকে জীবন নির্বাহ করলেই ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ হবে, তা না করলে বেশ্যা হওয়া কেউই ঠেকাতে পারবে না সে তো সোজা বলেই দিচ্ছে।

উপরের দুটি প্রবচনের মতো আরও অনেক প্রবচন যে আমাদের এই বাংলা সমাজেই আছে তা বলা বাহুল্য। তবু কথার ছলে, হাসি-ঠাট্টার মতো করে এই কথাগুলো পরিস্থিতির রকমফেরে হালকা মনে হতেও পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীকে, শুধুমাত্র নারীকেই লক্ষ্য করে যেসব অশ্রাব্য গালি-গালাজের অস্তিত্ব আছে সেগুলো কোনদিন হালকাভাবে নেওয়া যায় না তো বটেই, বরঞ্চ এর থেকে বিশ্রী অপমান আর হয় না।

এখন কথা হচ্ছে, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কিংবা একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে যদি এই ভাষা ব্যবহার করে কথা বলে, সে হোক কথার তোড়ে কিংবা মেজাজ খারাপের কোন এক মুহূর্তে- শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে এর প্রভাব কোন অংশেই কম হয় না। আর ক্রমাগত একটা মানুষ যদি তার সঙ্গীর কাছ থেকে এ ধরণের মৌখিক নির্যাতনের (Verbal Aggression) শিকার হয় তার কুপ্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী, ধীরে ধীরে তার আত্মবিশ্বাস থেকে শুরু করে আত্মসম্মানে এক বিরাট দগদগে ঘা সৃষ্টি করে যায়। দীর্ঘদিন ধরে কাউকে ক্রমাগত অপমান, অবমাননা, কুৎসিত গালিগালাজ, হুমকি ইত্যাদির ফলে দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে, যা শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় উঠে আসে, শারীরিক নির্যাতনের মতো এ ধরণের মানসিক নির্যাতন একজনের মস্তিষ্ক ও আচরণে বিরাট ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রেখে যেতে পারে। দীর্ঘদিন এ ধরণের অবমাননাকর আচরণের শিকার হলে তা থেকে এইসব মানসিক সমস্যা ধীরে ধীরে দেখা দিতে পারে-

বিষণ্ণতা
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (Post-Traumatic Stress Disorder/ PTSD)
মনোযোগে ত্রুটি
ক্ষণে ক্ষণে মনের ভাব পরিবর্তন
দুঃস্বপ্ন
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা-বেদনা
নিদ্রাহীনতা
সামাজিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হওয়া
নিঃসঙ্গতা

এখানেও শেষ নয়, এসব সমস্যা থেকে উৎপত্তি হতে পারে আরও বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগের– যদি না সময়োপযুক্তভাবে ও যথাযথভাবে মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা যায়। অনেক উন্নত দেশেও মৌখিক বা মানসিক নির্যাতনকে লক্ষ্য করে পরিচালনা করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই বিষয়ে মানুষের তেমন সচেতনতা নেই বললেই চলে। আর আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক ও নানান দিক থেকে অসচেতন সমাজে যে এই অদৃশ্য নির্যাতন আলোচ্য বিষয় খুব কম সময়েই হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই বিষয়ে চুপ করে থাকলে, চোখে দেখা যায় না বলে একে নির্যাতন বলে অস্বীকার করলে এর ফলাফল দিন দিন হবে আরও ভয়াবহ।

যদি আপনার সঙ্গী উপরোক্ত উপায়ে আপনাকে মৌখিক বা মানসিক নির্যাতন করে থাকে তবে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করুন। শুধুমাত্র স্বভাবের দোষ কিংবা ঐ প্রবাদটির মতো ‘পুরুষ মানুষর জেদ থাকা ভালো’ এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে নিজের মানসিক আত্মহত্যার কারণ নিজেই হবেন না। যদি দীর্ঘদিন এ জাতীয় আচার-আচরণ ক্রমাগত চলতেই থাকে, তবে ধরে নেবেন এই ব্যক্তি কোন না কোন ভাবে নারীদের অসম্মান করাটা, তাদের দাবিয়ে রাখাকে সমর্থন করে– এমন মানুষের সংস্পর্শে কেন থাকবেন আপনি?

একজন ব্যক্তিকে যেমন শারীরিক রোগের চিকিৎসা করাতে হয়, ঠিক তেমনই তার মনের যত্ন নেওয়াটাও কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে আপনার কাছের বন্ধুর কাছে নিজের কথা খুলে বলুন। বিষণ্ণতা বা অন্যান্য উপসর্গগুলো দেখা দিলে প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসকের সাথে দেখা করুন এবং চিকিৎসা নিন। এই পরিস্থিতিতে নিজেকে অত্যন্ত অসহায় মনে হতে পারে, লজ্জায় ও নিজের আত্মসম্মানের জলাঞ্জলির কথা ভেবে আরও নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করতে পারে – কিন্তু মনে রাখবেন, নিজেকে বিষণ্ণতার কালো গহ্বরে ঠেলে দেওয়ার জন্য তা খারাপ বৈ ভালো কোন ফল এনে দেবে না।

মনে হতে পারে, সমীক্ষা কিংবা পিটিএসডি-এর মতো গালভরা শব্দ লিখে একটা লেখা লিখে ফেলা খুব সহজ কাজ, বাস্তব জীবনে এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে বোঝা যায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করা কতটা কঠিন! আমি আপনার সাথে একমত। কিন্তু এই লেখাটা কোনো ইংরেজি প্রবন্ধের অনুবাদ নয়; উপরের প্রত্যেকটা কথা আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা, আমি এই ধরনের মৌখিক-মানসিক নির্যাতনের ভেতর দিয়ে বহুদিন গেছি এবং এখনও পর্যন্ত নিজের একাধিক মানসিক সমস্যা মোকাবেলা করে চলেছি। অকপটে স্বীকার এইজন্য করলাম কেননা আমি কোন সমীক্ষা বা পরিসংখ্যান পড়ে নয়, বাস্তবিক অর্থেই জানি কতটা ভয়াবহ দাগ ফেলতে পারে এ জাতীয় কুৎসিত আচরণ। তাই এরকম নির্যাতনের শিকার যদি কেউ হয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করুন কেননা মৌনতা সম্মতির লক্ষণ, আর এক্ষেত্রে সম্মতি অন্যায়ের প্রশ্রয়েরই নামান্তর।

শব্দের ত্রিশূলে মন ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত ঠিকই হয় কিন্তু তা দেখা যায় না বলে আমরা সেটাকে থোড়াই গুরুত্ব দিই। মনের অস্তিত্বকে যদি অস্বীকার না করে থাকেন, তবে মানসিক নির্যাতনকে অবহেলা কেন করবেন?

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]