September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আলাইনা আর আমার শৈশবে পার্থক্য নেই, তাই প্রতিবাদ করবোই

তাইমুন পিয়া।। মানুষ কবে মানুষ হয়েছে তা নিয়ে বহু গবেষণা হাজার বছর ধরে। একথা নিশ্চিত পৃথিবীর যেখানেই অবস্থান করুক বাংলাদেশিরা সকলে এখনো মানুষ হতে পারেনি। নির্দিষ্ট এই শ্রেণিকে মানুষ বলতে পারবেন না আপনিও। তাদের কাজ ঠিক মানুষের মতো না। অন্যে কি পরলো, কি খেলো, কি করলো তার দিকে তাকিয়ে থাকা। এবং কীভাবে অন্যের হৃদপিণ্ডটা আঁচড়ে খামচে রক্তাক্ত করবে সেই নেশায় আসক্ত সবসময়। ফেসবুক কমেন্টগুলো খেয়াল করলেই ধরা পড়ে বিষয়টি। মানুষ বলবেন এই শ্রেণিকে?

সাকিব আল হাসানের শিশুকন্যার ছবিতে যেসব কমেন্ট করেছে এই নির্দিষ্ট শ্রেণি, নারী পুরুষ উভয়ই, তা দেখে শিউরে উঠবেন আপনিও, ঘৃণায় যার গা গুলাবে যে কোনো মানুষের।

সাকিব কন্যা আলাইনা’র হাতে কোনো সিগারেট ছিলো না, তার পোশাক বা স্বভাব নিয়েও বলার সুযোগ নেই। তাই ফুলের মতো পবিত্র শিশুটির পেছনে লাগা হলো অত্যন্ত কুৎসিত কিছু মন্তব্য নিয়ে। একটি ফুলের বাগানকে পাট ক্ষেত দেখতে পেলো কিছু অমানুষ। অবশ্যই অমানুষ, যাদের চোখে, মনে, আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থে কেবল একই বাসনা কাজ করে – ধর্ষণ।

ছবির মন্তব্য নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, ভদ্রসমাজ শাস্তির দাবি তুলেছেন ওই ইতরদের জন্য। যদিও ফেসবুকে ফেক আইডির অভাব নেই। কে কোথায় বসে কোন আইডি চালাচ্ছে তা উদ্ধার অনেক সময় জটিল কাজ। তবুও শাস্তির দাবি তোলার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষকে।

আজকের লেখার কারণ শুধু আলাইনা নয়। বিবেক নামক হারাতে বসা বস্তুর নিকট হাতড়ে বেড়ানো আমার কিছু কথা। আলাইনা’র বয়সে, আমি তখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। তখনকার একটা স্মৃতি চাড়া দিলো যে দুদিন ধরে চুপ থাকবো ভেবেও আর পারলাম না। সেই সময় আর এই সময়ের কোনো তফাত আমি দেখতে পাচ্ছিনা। মানুষ বলে সময়ের সাথে মানুষের উন্নতি হয়। কোথায় উন্নতি! এখনো মানুষ অন্ধকারের কীট হয়েই বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের ফেসবুক পেইজে নিয়মিত হাহা দেয়া কিছু লোক আছেন যারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন বা করেছেন। অবাক হই মানুষকে অপমান করার ক্ষুদ্রতম সুযোগ তারা ছাড়তে নারাজ, ডিগ্রিধারী কীট এরা।

গ্রামের বাড়িতে মেলায় গিয়েছিলাম অন্যান্য ভাইবোনের দলের সঙ্গে। নিয়ে গিয়েছিলো কাকা। তিনি সামনে থেকে দলের সবাইকে তার পেছনে চলতে হুকুম দিচ্ছিলেন। সেই সময় পেছন থেকে কেউ বিশাল থাবা বসায় আমার বুকে। ছোট্ট বুক, তখন স্তন তো দূর, হাড়ের উপর শুধু চামড়া। ব্যথা আর আতংকে পিছনে ফিরে দেখি সবাই আমার মাথার অনেক উপর দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে। ভিড়ে থামার কোন উপায় ছিলো না। কাকাকে ডেকে বলতে পারিনি। অনেক খেলনাপাতি কিনে দিলেন, হাড়ি, কড়াই, খুন্তি, বটি ঘোড়া, মাথা দুলানো বুড়ো। কিন্তু আমার মন আর ভালো হয়নি। দই মিষ্টির দোকানে নিয়ে সবাইকে বসিয়ে খাওয়ালেন। হাসছে খাচ্ছে সবাই। আমি বারবার আতংকে কেবল পিছনে দেখি। বাড়ি ফিরে আম্মাকে বলার পর ভুলেও গেছিলাম সেই ভয়। কিন্তু আম্মা আব্বার ভয় আর কাটেনি। তাদের সঙ্গ ছাড়া বাইরে যাবার অনুমতি ছিলো না আর কখনো। তাতেও খুব উন্নতি কি হয়েছিল? গাউছিয়া চাঁদনি চকে ভিড়ের ভেতর ইচ্ছাকৃত থাবা এড়ানো সহজ কাজ ছিলো না। বরং আম্মা বলতো চুপ করে থাকো, কিংবা বলতো আর নেয়া যাবে না ভিড়ে। বাণিজ্য মেলায় নিয়ে গেলে কোনো স্টলে যেতে দিতো না। মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটিয়ে নিতো। অদ্ভুত শৈশব কৈশোর আমাদের সমাজের শিশুদের। ছেলে মেয়ে কারোই নিস্তার নেই বিকারগ্রস্তদের থাবা থেকে। সেই থাবা এখন অনলাইনে প্রবেশ করেছে।

সাকিব কন্যা আলাইনার এখন কিছুই বোঝার বয়স হয়নি। একসময় সে-ও বড় হবে। এই ঈর্ষামূলক আচরণগুলো কেন করে কীটেরা তা নিয়ে ভাবলাম। যেহেতু মেয়েটি বোঝে না তাহলে এই খামচিগুলো তারা কাকে দিচ্ছে? সাকিব এবং তার স্ত্রী’কে। সাকিবের স্ত্রী পর্দা করেন না, হিজাব করেন না তা নিয়ে বাজে আলোচনা কম হয়নি এই মাধ্যমে। তাসকিনের স্ত্রী, তামীমের স্ত্রী সকলেই এখন হিজাবধারী। হিজাব যার যার স্বাধীনতা। যার ইচ্ছে সে পরবে, যার ইচ্ছে না তাকে কটুকথায় আঘাত করে শান্তি না পেলে তার সন্তানদের আঘাত করতেও দ্বিধা বোধ করেনা এক দল। তাদের সাথে তাল মিলায় আরেক দল। দলে দলে তারা ভারি হতে থাকে। আমরা সাধারণ মানুষেরা হারিয়ে যেতে থাকি তাদের কুশ্রী চেহারার আঁধারে।

যদিও শিশির কিছুক্ষণ আগে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন, তিনি এসবকে গ্রাহ্য করেন না জানিয়ে। তার পোস্ট বেশ হতাশাজনক আমাদের জন্য, যারা এখনও প্রতিবাদে বাঁচি। সাকিবের স্ত্রী আমেরিকার নাগরিক, সাকিব আন্তর্জাতিক ব্যাক্তিত্ব, তাদের কন্যার এই দেশে আর কখনো পা না রাখলেও চলবে কিন্তু আমার কন্যা, আমাদের কন্যাদের বাঁচাতে হলে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদেরই।

শিশুদের প্রতি সামান্যতম অন্যায় যেখানে যে প্রান্তেই হোক রুখে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন। এটা পৃথিবীর দাবি আপনার কাছে, আপনি মানুষ। অমানুষদের মুখ ও মুখোশ ছিঁড়ে দিন।

প্রতিটি শৈশব হোক আলোয় ভরা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]