বাইক শুধু পুরুষের যান নয়
কায়সুল খান।। যশোরের মেয়ে ফারহানা আফরোজ। বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতোকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। গত ১৩ আগস্ট তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। সেদিন তিনি স্থানীয় একটি বিউটি পার্লার থেকে সেজে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মটর সাইকেলযোগে হৈ হুল্লোর করে শহর প্রদক্ষিন শেষে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেন।
একজন মেয়ে মটর বাইক চালাচ্ছেন এটা বাংলাদেশের সমাজে কিছুটা বিরল ঘটনা। সাধারণত এখানে মেয়েরা স্কুটি বা এই জাতীয় বাহন চালিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের সমাজে মনে করা হয় মটর বাইক পুরুষের বাহন। অনেকের ধারণা পুরুষের শৌর্যবীর্যের প্রতীক হল মটর সাইকেল একজন নারী যখন সেই মটর সাইকেল চালিয়েছেন তখন তা আমাদের পুরুষ সমাজের সম্মানের উপর আঘাত হেনেছে! ফারহানার বাইক চালিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার ভিডিও ও ছবি সামাজিক মাধ্যম, পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে অল্প কিছু ইতিবাচক মন্তব্যের পাশে শত শত নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে।
শুধু ফারাহানা নন, এর আগে এভ্রিল নামে আরও একজন নারীকে আমরা বাইক চালাতে দেখেছি। নিজের প্রয়োজনে তিনি নিত্য দিন বাইক চালান। তার ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরণের নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখেছি। এই নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের অধিকাংশেরই মত হল একজন নারী হয়ে ফারাহানা বাইক চালিয়ে ধর্মীয় বিধিবিধান অমান্য করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে যায় না এমন আচরণ করেছেন। একজন নারীর কাছ থেকে এ ধরণের আচরণ বাংলাদেশের তথাকথিত ধর্মভীরু সমাজ আশা করে না! তাই তারা ফারহানার এই বাইক চালিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আসার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না।
অনলাইন থেকে ফারহানার ফটো ও ভিডিও নিয়ে নানা মত দিয়ে বেশ কিছু ভিডিও আপলোড হয়েছে ফেইসবুক ও ইউটিউবে। পাশাপাশি ফেইসবুকে এসেছে শতশত পোস্ট। কুশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত এক শ্রেণির হাতে আজ মোবাইল ও কম্পিউটার চলে আসার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সভ্যতা-ভব্যতার প্রতি সম্মান না রেখেই তারা বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করছে এবং সেখানে নির্বোধের মত মন্তব্য করছে আরেক শ্রেণির মানুষ। ফারহানাকে নিয়ে তৈরি ভিডিও ও পোস্টও এর ব্যতিক্রম নয়। এমন কি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনের ফেইসবুক পোস্ট কিংবা বিবিসি বাংলার ভিডিও প্রতিবেদনের নিচেও শত শত নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে।
নেতিবাচক মন্তব্যের মধ্যে কতগুলো ভীষণ আপত্তিকর এবং অপরাধও বটে। পুরুষের যান বাইক চালানোর অপরাধে বেশ কয়েকজন ফারাহানাকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। তাদের মতে যেহেতু ফারহানা বাইক চালিয়েছেন তাই তার চরিত্র উন্নত নয়। একজন অনুন্নত চরিত্রের নারীকে ধর্ষণ করা যায় বলেই তাদের মত।
আরেক শ্রেণির লোকের মত হল ফারহানার এই বাইক চালানো সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে! তার দেখাদেখি শত শত মেয়ে বাইক চালানো শুরু করলে কী হবে? এমন বাইক রাইডার মেয়েদের তারা বিয়ে করতে পারবে না। কি অদ্ভূত চিন্তাধারা আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর!
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল মন্তব্যকারীদের অনেকেই ফারহানার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অভিভাবক হিসেবে ফারহানার বাবা-মায়ের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছে। কেন তারা তাদের মেয়েকে বাইক চালানোর অনুমতি দিয়েছেন সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। অথচ ফারহানার বাইক চালানো কোন অপরাধ নয়। এটা তার দক্ষতা, এটা তার বিশেষ যোগ্যতা। বাংলাদেশের সমাজ এতটাই অসভ্য হয়েছে যে একজন নারীর দক্ষতাকেও আজ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। সামাজিকভাবে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে।
যদিও ফারহানার পরিবার তার এই বাইক চালানো নিয়ে কোন আপত্তি করে নি। এমন কি ফারহানার শ্বশুর তার বৌমা’র বাইক চালানোর দক্ষতায় খুশি হয়ে তাকে বাইক উপহার দেবেন বলে জানিয়েছেন। পত্রপত্রিকা মারফত আমরা এই তথ্য জেনেছি। কিন্তু এত কিছুর পরও আমাদের ধর্মকাতর সমাজ ফারহানা ও তার পরিবারকে রেহাই দিচ্ছে না।
“প্রবল সব বাধা অগ্রাহ্য করে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। …এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে।” আজ থেকে বহু বছর আগে এই কথা বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বলে গিয়েছেন। বোধ করি তার বক্তব্য মিছে নয়। বাংলার তথাকথিত মুসলিমদের মতে ফারহানা বাইক চালিয়ে ধর্মের আদেশ অমান্য করেছেন। ধর্ম নারীকে বন্দিত্ব দিতে চায়। পুরুষের দাসে পরিণত করতে চায়। ধর্ম কখনো চায় নি নারীর বিশেষ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হোক। ফলে ধর্মের দোহাই দিয়ে খুব সহজে নারীকে পদানত করা যায়। বাংলাদেশের কুশিক্ষিত সমাজেও একই ঘটনা ঘটছে। হাতে মোবাইল ফোন আর বাসায় কম্পিউটার থাকার লাখ লাখ কুশিক্ষিত মানুষ এখানে ফারহানার মত সাহসী নারীদের পদানত করতে ধর্মকে ঢাল বানাতে চাইছে। কিন্তু সাহসী নারী ফারহানা কিংবা এভ্রিলের সামনে নিজেদের ব্যর্থতায় গালি দিচ্ছে তাদেরকে।
একজন নারী স্বনির্ভরভাবে চলাচল করছেন। আয় উপার্জন করছেন এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। মানুষ হিসেবে প্রত্যেক নারীর অধিকার আছে স্বনির্ভর হওয়ার। ফারহানা নিজে ঢাকা শহরে স্কুটি জাতীয় যান চালিয়ে কাজে যেতেন বলে জানিয়েছেন। বাইক চালানোর দক্ষতাও তার দীর্ঘদিনের। একজন নারীর এই অগ্রযাত্রাকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখি। এই চিত্র আমাদের নারী সমাজের সাহসী হয়ে ওঠার নিদর্শন। তাদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠা ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে ভেঙে ফেলতে চাওয়ার অভিপ্রায় মাত্র। আমাদের উচিত ফারহানার মত সাহসী মেয়েদের সমর্থন দেওয়া। তাদের অগ্রযাত্রায় সহযাত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করা।
যদিও মানুষ হিসেবে একজন মেয়ে বাইক চালাচ্ছেন এটা বিশেষ কোন ব্যাপার হতে পারে না। দক্ষতা অনুযায়ী একজন মেয়ে বাইক বা গাড়ি যা খুশি চালাতে পারেন। যোগ্যতা থাকলে চালাতে পারেন প্লেন কিংবা মহাকাশযান। তবুও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারী আইন মেনে নিত্য প্রয়োজনে বাইক চালাচ্ছেন এটা খুব ইতিবাচক ঘটনা। একই সাথে এই ঘটনা পুরুষতন্ত্রের উপর আঘাতও। বাইক মাত্রই পুরুষের যান এই মিথকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টারত ফারহানাদের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা। ভালোবাসা নিরন্তর।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]