November 2, 2024
নারীবাদ আলোচনাসাহিত্যফিচার ৩

গর্ভনিরোধক নেবার অধিকার: নারীবাদের আরেক সফল অধ্যায়

নারীবাদ: বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব-১২

শারমিন শামস্।। বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে কোনো কোনো আমেরিকান নারীবাদীও গর্ভনিরোধক পিল বা অন্য সামগ্রীগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। গর্ভনিরোধকে নারী স্বাধীনতার উপায় তো দূরের কথা, তারা ভাবতেন এতে সব  নারী দীর্ঘদিন সেক্সুয়ালি অ্যাকটিভ রাখবে, আর যার ফলাফল হিসেবে এটি পুরুষের জন্য বিয়ের বাইরেও যৌনস্বেচ্ছাচারিতার পথ খুলে দেবে। এই নারীবাদীদের মধ্যে ছিলেন শার্লট পারকিনস, গিলমান ও লুসি স্টোন এবং অ্যাংলো আমেরিকান এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল।

গোঁড়ার দিকে নারীবাদীরা মনে করলেন, নারীর উচিত পরিবারের আকার ছোট রাখা, তবে সেটি করতে হবে অন্যভাবে। যেমন স্বামীর যৌনচাহিদাকে পূরণের আহ্বান অস্বীকার করা, কারণ এটি করার অধিকার নারীর আছে। পুরুষকে যৌনতা থেকে বিরত রাখার ডাক দিলেন কেউ কেউ, তাদের একজন ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাক্টিভিস্ট জোসেফিন বাটলার, যিনি ১৮৬০ সালের যৌনবাহিত রোগ নিয়ে প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলেন। যে আইন যৌনবাহিত রোগের পুরো দায় চাপিয়েছিল যৌনকর্মীদের ওপর এবং ব্রিটেনের ভিক্টোরিয়ান আদর্শ ধরে রাখতে শাস্তি দিচ্ছিল তাদের।

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ থাস ম্যালথাসের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত চিন্তা প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান ম্যালথাস লিগ গঠিত হয় ১৮৭৭ সালে, প্রতিষ্ঠানটি পরিবারগুলোর সদস্যসংখ্যা সংকুচিত রাখতে কন্ট্রাসেপশান বিষয়ে কাজ করছিল। দারিদ্র ও অতি জনসংখ্যার চাপ নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে অনেক র‌্যাডিক্যাল নারীবাদী তাদের সমর্থণ দেন। অন্যদিকে কিছু সমাজতান্ত্রিক তাদের বিপক্ষে থাকেন এই বিশ্বাসে যে, এর ফলে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ সংখ্যায় কমতে থাকবে, যখন অন্যদিকে বুর্জোয়ারা সংখ্যায় দ্বিগুন হতে শুরু করবে।

১৮৭৩ সালে আমেরিকায় Comstock Act গর্ভনিরোধকে বেআইনী ঘোষণা করে, যার ফলে জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। অন্যদিকে ব্রিটেনে জন্মনিরোধ নিয়ে একটি লেখা প্রকাশের জন্য বিচারের মুখোমুখি হন অ্যানি বেসান্ত ও চার্লস ব্র্যাডলাফ। লেখাটির নাম ছিল ফ্রুটস অব ফিলোসফি।

উনবিংশ শতাব্দিতে গর্ভনিরোধকে বিপজ্জনক হিসেবেই দেখা হত, বিশেষ করে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ এবং সমাজের একটি বড় অংশই এটিকে খারাপ চোখে দেখতেন এই কারণে যে তাদের ধারণা ছিল এর ফলে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে যাবে।

গর্ভনিরোধক পিল নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছুতো কম। তা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এ সম্পর্কে জানার এবং পিল কেনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো, পিলগুলো বিক্রি হতো ‘feminine hygiene’ এর নামে। শ্রমিক শ্রেণির নারীর সামর্থ্য ছিল না জন্মনিরোধক কেনার। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধের উপায় ছিল কিছু হাঁতুড়ে এবং গেঁয়ো পদ্ধতি, যা একদম বেআইনী। কিছু নারী তাও সেইসব পথেই যেতেন বাধ্য হয়ে। আর যারা তা করতেন না, তাদের সারা বছর দেখা যেত হয় গর্ভবতী অবস্থায় আছেন বা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। সব সংসারেই ১০/১২টা করে সন্তান থাকতো।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপ ও আমেরিকা দুই দিকেই সেক্সুয়ালিটি ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টদের চিন্তায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে এবং এটি হয়ে ওঠে নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই ফেমিনিস্টদের অনেকেই ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের এবং হেভলক এলিয়াস ও এডওয়ার্ড কার্পেন্টারের মত ব্রিটিশ সেক্স রিফর্মারদের লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। আমেরিকায় এ আন্দোলনে ছিলেন নারীবাদী ক্রিস্টাল ইস্টম্যান ও এডা রাও এবং অ্যানার্কিস্ট এমা গোল্ডম্যান। তারা যৌনতায় নারীর স্বাধীনতার কথা বললেন, শ্রমিক নারীদের গর্ভনিরোধে সাহায্য করতে শুরু করলেন।

গর্ভনিরোধ ইস্যুতে আমেরিকান নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট মার্গারেট স্যাংগারের কথা বলতেই হয়। স্যাংগার নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার সাথে জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের যে সংযোগ রয়েছে, সেটি ধরতে পেরেছিলেন। স্যাংগারের মা মারা যান তার ১৮তম গর্ভধারণের সময়। এই ঘটনাটা স্যাংগারকে ভাবিয়েছিল। পেশায় স্যাংগার ছিলেন নার্স আর কর্মী ছিলেন নিউ ইয়র্ক সোশ্যালিস্ট পার্টির।

স্যাংগার যখন গ্রিনিচ ভিলেজে বাস করতেন, তখন দ্য উওম্যান রেবেল নামে একটি পত্রিকা চালাতেন এবং সেখানে লিখতেন। সেখানেই ১৯১৪ সালে প্রথম ‘birth control’ কথাটি আনলেন। ভোটাধিকার আন্দোলনের নেতা আরেক ফেমিনিস্ট ব্রিটেনের মেরি স্টপসকে নিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন শুরু করলেন তিনি, Comstock Law’কে চ্যালেঞ্জ করে লিখতে শুরু করলেন, যে আইন জন্মনিয়ন্ত্রণকে অনৈতিক ও বেআইনী করে রেখেছিল। তিনি নারীর যৌনতা ও গর্ভনিরোধের অধিকার নিয়ে লিখতে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, সেইসব বক্ততৃা শুনতে আসতেন কর্মজীবী মেয়েরা। ১৯১৫ সালে স্যাংগার ইংল্যান্ডে যান, সেখানে তখন গর্ভনিরোধ আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয় অ্যাক্টিভিস্ট স্টেলা ব্রাউন, এলিস ভিকি, মেরি স্টপসের। নারীবাদ নিয়ে তাদের মধ্যে নিজেদের চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান হয়। তারা একমত হন যে নারীর নিজের শরীরের উপর সবার আগে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। স্যাংগার নিয়ন্ত্রণ কথাটির ওপর জোর দেন। নারীর গর্ভনিরোধের অধিকার বিষয়ে মেরি স্টপসের চিন্তা সামান্য আলাদা ছিল। তিনি মনে করতেন, যৌনতা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ এবং তাতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নারীর চাই যৌনশিক্ষা ও গর্ভনিরোধকের অধিকার। মেরি স্টপস তার বই ‘Married Love’ এর জন্য বিখ্যাত, তিনি বইটি লেখেন ১৯১৮ সালে। এই বইতে তিনি যৌনমিলন ও যৌনতার আনন্দ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন।

চিকিৎসা পেশায় জড়িত ব্যক্তিরা মেরির এই বইটিকে মিথ্যা, ভুল ইত্যাদি বলে তুমুল আক্রমণ করে। তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলছেন বলে তাকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এসব সত্ত্বেও প্রকাশের প্রথম বছরেই Married Love এর পঞ্চম সংস্করণ বেরিয়ে যায় এবং মেরি স্টপস হাজার হাজার নারী ও পুরুষের কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চিঠি পেতে থাকেন, যারা তার কাছে নানান পরামর্শও প্রার্থণা করেন।

এদিকে মার্গারেট স্যাংগার ১৯১৬ সালে ব্রুকলিনে একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্লিনিক খোলেন। তিনি কন্ট্রাসেপটিভ হিসেবে dutch cap বা diaphragm এর প্রচার শুরু করেন, যেটা তিনি ইউরোপ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। মাত্র নয়দিন চালানোর পরই ক্লিনিকটিতে রেইড হয়, স্যাংগার, তার বোন ও ক্লিনিক স্টাফকে গ্রেফতার করে ত্রিশ দিনের জন্য জেলে পাঠানো হয় Comstock Law ভঙ্গের অভিযোগে। এতে শাপে বর হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলন আমেরিকা জুড়ে জনসাধারণের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে বড় বিজয় আসে ১৯১৮ সালে, নিউ ইয়র্ক আদালত চিকিৎসকদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী প্রেসক্রাইব করার অনুমতি দেয়।

১৯২১ সালে স্যাংগার প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকান বার্থ কন্ট্রোল লিগ। এরপর প্রথম ওয়ার্ল্ড পপুলেশন কনফারেন্স আয়োজন করতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান। আর ১৯৫৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হন।

এদিকে ১৯২১ সালে মেরি স্টপস লন্ডনে প্রথম স্থায়ী গর্ভনিরোধক ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে নারীদের পরামর্শ দেয়া হত এবং দেখিয়ে দেয়া হত কীভাবে ডায়াফ্রাম ব্যবহার করতে হবে। আমেরিকা ও ইংল্যান্ড- দুই জায়গাতেই জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন একটা অবস্থান গড়ে নিতে শুরু করলো, এটি তখন আর শুধু নারীবাদী ইস্যু নয়, লোকের কাছে হয়ে উঠলো নারীকল্যানের বিষয়ও।

কিন্তু এর বিরোধিতাও চলতে থাকে। শুধু ক্যাথলিক চার্চই নয়, অন্তত ১৯৩০ সাল পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রগুলোকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহারের পরামর্শ দেবার আদেশ দেবার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দেন।

১৯৬৫ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত বিবাহিত দম্পতিদের গর্ভনিরোধক ব্যবহারের অধিকার দেয়। পরে ১৯৭২ সালে এই অধিকার অবিবাহিতদেরও দেয়া হয়।

আর ১৯৭০ সালে ইউকে’তে উইমেনস লিবারেশন মুভমেন্ট Free abortion and contraception on demand আন্দোলন শুরু করে।

জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে যে নারীবাদীরা আন্দোলন করে গেছেন, মার্গারেট স্যাংগার ও মেরি স্টপসের নাম এদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তারা নারীর জীবন বদলে দিয়েছেন। প্রজনন স্বাস্থ্যে নারীর অধিকার নিয়ে নারীবাদের দ্বিতীয় ওয়েভে যে আন্দোলন আবার ১৯৬০ সালে গড়ে ওঠে, তার পথটি তাঁরাই তৈরি করে দিয়ে গেছেন।

[চলবে]