নারী, পুরুষ এবং সংসার
আঞ্জুমান রোজী।। জন্মের পর থেকেই বড় হতে হতে শিশু কন্যাকে পুতুল পুতুল খেলা দিয়ে তার মননে গেঁথে দেয়া হয় এক ঘর সংসারের স্বপ্ন; যা সে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে যত্নে আগলে রাখবে। নারী তখন সেবকে রূপান্তরিত হতে থাকে। আর অনেক নারীও সেভাবে নিজেকে তৈরি করে সংসারধর্ম পালনে ব্রতী হয়।
নারী মানেই যে সেবক এমন একটা ধারণা যুগ যুগ ধরে প্রথা হিসেবে মেনে চলা হলেও, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এটা কি নারীর প্রাকৃতিক গুণ? নারী যেন সেবা দিতেই ভালোবাসে! ঠিক এভাবে চলতে চলতে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে নারীমাত্রই নিজের এক টুকরো পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে। বিশেষ করে বাঙালি মেয়েরা আজও নিজের প্রিয় পুরুষ, নিজের ঘর, সন্তান, পরিবারকে ঘিরেই সুখ খুঁজে নেয়। বিয়ে ব্যাপারটা আজও বাঙালি সমাজে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নারীরও অসংখ্য স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে এই বিয়ে এবং নিজ সংসারকে ঘিরে।
নিজ ঘর সংসারকে অনেক নারী প্রার্থনালয় মনে করে। আমি নিজেও ঠিক সেভাবে আমার সংসারকে মূল্যায়ন করে আসছি। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, প্যাগোডায় যেভাবে পূজা অর্চনা দিয়ে প্রার্থনা করে ভক্তি-শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায় নিবেদিত থাকে, ঠিক সেভাবেই অনেক নারী নিজ ঘর সংসারকেও শুদ্ধ সুন্দর করে সাজিয়ে প্রার্থনার মতো যত্ন করে রাখে। সংসারের প্রতিটি বিষয় থাকে তার নখদর্পনে যা সে যত্নের আদিখ্যেতায় আগলে রাখে। এমনকি নারীটি যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায় তাকেও নিজ অস্তিত্বের অংশ মনে করে দেখভাল করে। মনের মাধুরী দিয়ে ঘর সাজানো, রান্না করে তা পরিবেশন করানো, কার কখন কী প্রয়োজন সেই দিকে বিশেষ নজর রেখে পুরো পরিবারকে এক প্রার্থনালয় বানিয়ে ফেলে। যেখানে তার ভূমিকা থাকে দূর্গাদেবীর মতো। সেখানে তার ধ্যান জ্ঞান চিন্তা-চেতনার সবরকম প্রতিফলন ঘটে। এতেই অনেক নারী সুখ খুঁজে নেয়। সংসারধর্মে নিজেকে নিবেদন করে অনেক নারী জীবনকে উৎসর্গও করে দেয়।
সব কিছুই যখন সুন্দর সাজানো গোছানো পরিপাটি করে রক্ষণাবেক্ষণ চলছে তখনই কোনো এক অনভিপ্রেত কারণে সংসারে অশান্তি কিংবা ফাটল ধরতে শুরু করে। এই ফাটল ধরানোর কাজে পুরুষ সঙ্গীটির ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। নারীর কারণে সংসারে যতটা না অশান্তি হয় তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পুরুষের কারণে। যুগ যুগ ধরে তাই সাক্ষী দিয়ে আসছে। বিশেষ করে পুরুষের অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ার কারণেই এমন অশোভন অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়। মন ভাংলে মসজিদ মন্দিরও ভেঙ্গে যায়। এমন একটা কথা আছে যে, মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা সমান কথা। প্রার্থনায় মন আর বসে না। তখন তার রক্ষণাবেক্ষণেও মন সাড়া দেয় না।পুরুষ সঙ্গীটি যদি নারীর মনের অবস্থা বুঝতো তাহলে সেভাবেই নারীর সঙ্গে সংসারধর্ম পালন করতো। কারণ সংসার একটি প্রতিষ্ঠান যেখান সুস্থভাবে জীবনযাপনের সব রকমের ব্যবস্থাপত্র অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আছে যা যত্ন করেই লালন করতে হয়। আর তার রক্ষণাবেক্ষণ অনেকটাই এক নারীর হাতে বর্তায়।
প্রত্যেক নারী স্বপ্ন দেখে এমন এক জীবনসঙ্গীর, যে সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে, সম্মান করবে, ভালোবাসবে আর যাকে চোখ বুঁজে বিশ্বাস করা যাবে। সেই মানসিকতা নিয়ে একটি নারী তার সংসারকে মসজিদ, মন্দিরের মতো উপসানালয় বানিয়ে ফেলে। কিন্তু পুরুষ তার স্বভাবজাত অনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে অনেক সুখের সংসার ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। অনেক নারী মুখ বুজে এসব সহ্য করে সংসারধর্ম পালন করলেও সেখানে নারীর কোনো মন থাকে না। যদিও পুরুষের তাতে কিচ্ছুই যায় আসে না। কারণ তারা ধরেই নেয় পুরুষের সবরকম অত্যাচার সহ্য করেই নারীকে সংসার করতে হবে, এছাড়া নারীটির কোনো গতি নেই। আবার পুরুষটি সংসার ঠিক রাখার জন্য স্ত্রীর কাছে সব রকম মিথ্যাচারও করে যায়। সেই মিথ্যাচারে সংসারের ভিত কাঁপতে কাঁপতে একসময় তা ভেঙ্গেও যায়।
সব স্বপ্ন নিয়ে নারীটি যখন সংসার শুরু করে তখন তার সারাজীবনের সাধনার রসদ সেই সংসারে ঢেলে দেয়। নিজের পরম আশ্রয়ের কথা ভেবে যত্নে সেই জায়গাটিকে পূজনীয় করে তোলে। এভাবে বছরের পর বছর ঘুরতেই যখন স্বামীকে দেখে গৃহকর্মীর সঙ্গে সঙ্গমরত কিংবা অন্য নারীতে তার আসক্তি রয়েছে এমন কোনো প্রমাণ বা অফিস/ ব্যবসার কথা বলে অন্য নারী নিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে ফূর্তি করে ফিরে আসে শুদ্ধভাব নিয়ে, তখন সেই স্ত্রী নারীটির মন-মানসিকতা কী হতে পারে? হ্যাঁ, ইতিহাসে এমন ঘটনাই অনেক। পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা এভাবেই যুগের পর যুগ ঘটে আসছে। তবে আজকের পৃথিবীতে নারী তার মনের ঠিকানা জানে। সে জানে সে কী চায় এবং কিভাবে জীবন পেতে চায়। তাই যখনই এসব মনভাঙ্গার ঘটনা ঘটে তখন আর মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকে না। মসজিদ , মন্দিরের মতো সংসার ভাঙ্গতেও এতটুকুও বুক কাঁপে না। গভীর ধ্যানের, ভালোবাসার জায়গা যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন মানুষ হেথা নয় অন্য কোথাও চলে যাবার পথ খোঁজে।
কবি হেলাল হাফিজের ভাষায় বলে যাই,
‘‘নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল!
নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা!”
তারপরেও বলবো, নারীর কাছে যা প্রার্থনার, তাই ধ্যানের। তাই সে পাওয়ার আকুতি নিয়ে জীবন গড়ে, স্বপ্ন দেখে। নারীর মনের আকুতি যতদিন না পুরুষ বুঝবে ততদিন অস্থির সময়ের মধ্যেই দিন কাটাতে হবে। মন যে এক দেবালয়। তাকে প্রত্যাখান করা এতো সহজ নয়!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]