ধর্ষণ বিষয়ে দুই হুমায়ু(য়ূ)ন
মেহেদী হাসান।। হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) প্রাবন্ধিক আর হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) ঔপন্যাসিক। দু’জনেই একাধিক মাধ্যমে কাজ করেছেন। তবে আজাদ প্রধানত প্রবন্ধ আর আহমেদ প্রধানত উপন্যাসেই শিল্প-সিদ্ধি পেয়েছেন। একই বিষয় অর্থাৎ ধর্ষণ বিষয়ে দুজনই তাঁদের স্ব স্ব মাধ্যমে কাজ করেছেন। ধর্ষণ বিষয়ে আজাদ প্রবন্ধ লিখেছেন, আর আহমেদ উপন্যাস। আজাদের প্রবন্ধের নাম ‘ধর্ষণ’ আর আহমেদের উপন্যাসের নাম ‘প্রিয়তমেষু’। প্রায় সমবয়সী এ দু’জন মশহুর সাহিত্যিকের ধর্ষণ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় নেবো বর্তমান আলোচনায়।
আজাদের প্রবন্ধটা শুরু হয় সিদ্ধান্তমূলক বাক্যে: ‘‘নারীর ওপর পুরুষের বল প্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ, যাতে পুরুষ নারীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়।” এরপর যে দুটো বাক্য লেখেন আজাদ তাতেও সিদ্ধান্তই থাকে এবং ধর্ষণের কারণে নারীর শারীরিক সংকটের সাথে যুক্ত হয় মানসিক দিকটাও, যেমন: ‘ পুরুষ সুবিধার জন্যে বা আক্রোশবশত নারীকে খুন করতে পারে- মাঝেমাঝেই করে; কিন্তু খুনের থেকেও মর্মান্তিক ধর্ষণ, কেননা খুন নারীটিকে কলঙ্কিত করে না। ধর্ষণ একান্ত পুরুষের কর্ম; নারীর পক্ষে পুরুষকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। পুরুষের দেহ সংগঠন এমন যে পুরুষ সম্মত আর শক্ত না হলে নারী তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক পাতাতে পারে না; কিন্তু উত্তেজিত পুরুষ যে কোনো সময় নারীকে তার শিকারে পরিণত করতে পারে।”
আজাদ এ সংজ্ঞায় মানব-সম্পর্কে ধর্ষণের প্রধানত শারীরিক দিক এবং কিছুটা (কলঙ্ক) মানসিক দিক তুলে ধরেন। আজাদের এ সংজ্ঞাটা হেটারোসেক্সুয়ালিটি বা বিষমকামী যৌনসম্পর্কের পরিচয় বহন করে। আমাদের অপরাধ আইনের ৩৭৭ ধারায় বলা হচ্ছে: “প্রকৃতি-বিরুদ্ধ অপরাধ: কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষ, নারী বা পশু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌনসঙ্গম করে, তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হবে যা দশ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে, এবং এর সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক জরিমানাও দিতে হবে।”
এখানে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ অপরাধের কথা বলা হয়েছে, আজাদ ও আহমেদ দু’জনের কেউই এ বিষয়ে বলেননি। দু’জনেই বলেছেন সে সম্পর্কের কথা যা নারী-পুরুষের মধ্যে ঘটে এবং এভাবে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ ‘ধর্ষণ’ প্রবন্ধে এটার বাইরে যৌন-সম্পর্কের যে চর্চা আছে আজাদ সে বিষয়ে কিছু বলেন নি। আহমেদও ‘প্রিয়তমেষু’ উপন্যাসে যে কয়েকটি যৌন সম্পর্ক দেখান যেমন, নিশাত-জহির, নিশাত-ইয়াকুব, পুষ্প-রকিব, পুষ্প-মিজান সব কটি বিষমকামিতার। এগুলোর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। অর্থাৎ এগুলো আমাদের ৩৭৭ ধারাকে লঙ্ঘন করে না। প্রকৃতি-বিরুদ্ধ অপরাধ বা আনন্যাচারাল সম্পর্কের বিষয়ে দু’জনেরই কোনো বক্তব্য নেই। এতে আমার আলোচনা টেনে নিতে বরং সুবিধা হয়েছে। বাস্তবে যে চর্চা কম বেশি আছে সমাজে নিষেধাজ্ঞা (Taboo) আর আইনে নিবারিত থাকায় আমাদের জন্যও এসব বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকা সুবিধাজনক বই কি!
আহমেদের উপন্যাসে ধর্ষণ আছে দুটি। নিশাত-ইয়াকুব আর পুষ্প-মিজানের সম্পর্ক দুটো নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। আহমেদের অত্যন্ত পরিশীলিত সতর্ক-সংযমী আর ইঙ্গিতময় ভাষায় দেওয়া বর্ণনায় আমরা দুটো ধর্ষণের কেবল সংবাদ পাই। ইয়াকুব কর্তৃক নিশাতকে ধর্ষণ বিষয়ে আহমেদ বলছেন-
“নিশাত খুব কাঁদছে। জহির অবাক হয়ে বলল, তুমি এত কাঁদছো কেন? মামলাতো জিতে গেলে। একটা লোককে সারাজীবনের জন্য জেলে পাঠিয়ে দিলে। আজকে তো তোমার আনন্দ করার দিন। ব্যাপারটা কি বলতো? ব্যাপারটা নিশাত বলতে পারল না। কারণ বলার মত নয়। একই ঘটনা তার জীবনেও ঘটেছিল। সে তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বড় দুলাভাই এক দুপুর বেলা তার ঘরে ঢুকে পড়লেন। কি লজ্জা, কি অপমান, কাকে সে বলবে? মীরু আপাকে? মাকে, বাবাকে? কাউকে সে বলতে পারে নি। আজো পারবে না। তবে আজ সে মুক্তি পেয়েছে। মনের একটি বিরাট দরজা এতদিন বন্ধ ছিল। আজ খুলে গেছে। আজ সে কাঁদছে আলোর স্পর্শে।”
আহমেদের ধর্ষণ দৃশ্য বর্ণনায় আলোর ব্যবহার জনপ্রিয় (populist) ধারার ‘ইচ্ছামতো চিন্তা’র (wishful thinking) ফলে হয়েছে কি না সে প্রশ্নে আমরা যাবো না। বাস্তবে কতজন নারী বিচার চায়, আর কতজন নারী বিচার পায় সে তথ্য আমাদের হাতে নেই। ঔপন্যাসিক নানাভাবে সে প্রশ্ন সামনে এনেছেন। এড়িয়ে যান নি। তবু এই পুরুষতান্ত্রিক গড়নের জগৎ-সংসারে এমন দৃশ্য ভালো লাগে! আহমেদ এ দৃশ্যই আমাদের দেখান। আমরা বরং উপন্যাসের প্রথম ধর্ষণটার দিকে মনোযোগ দেই। এ উদ্ধৃতিটা আমি একটু বড় করে নেবো:
“পুষ্প কাঁপা গলায় বলল, দরজা বন্ধ করছেন কেন?
: কেন বন্ধ করছি বুঝতে পারছ না?
: মিজানভাই, আমি আপনার পায়ে পড়ছি।
: তুমি শুধু ভয় পাচ্ছ। কেউ কিচ্ছু জানবে না। আমিতো কাউকে কিছু বলবই না। তুমিও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। লোকলজ্জা বড় কঠিন জিনিস।
পুষ্প চিৎকার করে উঠতে চাইল। ছুটে যেতে পারল না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন। এই লোকটি তার গায়ে হাত দিচ্ছে কেন? এ কে? আমি চিৎকার করতে চাই। আমাকে চিৎকার করতে দাও। এই লোক আমাকে চিৎকার করতে দিচ্ছে না। মুখ চেপে ধরে আছে। আম্মা, আম্মা আমাকে বাঁচান আম্মা। আমি মরে যাচ্ছি।
পুষ্প জ্ঞান হারাল। মিজান তাকে শুইয়ে দিয়ে নিশি্চন্ত মনে সিগারেট ধরাল। আয়নায় মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না। সিগারেটটা ধীরে সুস্থে শেষ করা যেতে পারে।
আয়নায় পুষ্পকে দেখা যাচ্ছে। অচেতন অর্ধনগ্ন একটি রূপবতী তরুণী হাত পা এলিয়ে পড়ে আছে। শংখের মত সাদা। বুক নিশ্বাসের সঙ্গে উঠানামা করছে। অপূর্ব দৃশ্য। মিজান মুগ্ধ হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটি সরাসরি দেখার চেয়ে আয়নায় দেখতে বেশী ভাল লাগছে।
মিজান সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে শোবার ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিল। যদিও তার কোন প্রয়োজন ছিল না। পুষ্প অচেতন অবস্থায় বিড় বিড় করে তার মাকে ডাকছে।”
আহমেদের এ বিবরণে পুষ্পের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। আজাদের সংজ্ঞার সঙ্গে এর কোনো বৈপরীত্য নেই। কোনো দ্বৈরথ নেই। আহমেদ নিষ্ঠুরতার ছবিটা আঁকেন ঠাণ্ডা মাথার একটা ধর্ষকের কথায়, তাঁর প্রযুক্ত দৃষ্টিকোণে। সিগারেট ধরানোর কায়দায়, আয়নায় ছবি দেখার দৃশ্যে। এ বর্ণনা সরল, কিন্তু আমাদের এক গভীর বেদনায় নিমজ্জিত করে। এর সামাজিক মনস্তত্ত্বের ছবিটা আমরা পাবো পরে, বিচার প্রক্রিয়ার দৃশ্যমান কার্যক্রমে।
দুটো ধর্ষণ দৃশ্যে একটা ঘটনা সাধারণভাবে চোখে ধরা পড়ে। তা হলো নিশাত ও পুষ্প দু’জনের কেউই চিৎকার করতে পারছে না। পরেও আমরা দেখি, পুষ্পকে মামলা তুলে নেবার জন্যে মিজান চাপ দিতে এসে ভয় দেখায়, ‘চিৎকার করো দেখি’ বলে শাসায় কিন্তু পুষ্প তখনো চিৎকার করতে পারে না। আর নিশাত তো বিষয়টা চেপেই গেছে। তা পুষ্পকে আমরা দেখবো সাহস করে দাঁড়াতে। কিন্তু পাশে কাউকে পাচ্ছে না। এমনকি স্বামীকেও না, যে স্বামীর আদর পেতে সে উদগ্রীব থাকে। একজনের সে সহানুভূতি পায়, তারই মতো ধর্ষণের শিকার নিশাত।
ধর্ষণকালে চিৎকার করে জানান না দেওয়ার কারণ কী? পুষ্প যখন দৃঢ়ভাবে বিচার চাইবার মতো মানসিকতায় পৌঁছায় তখনো সে চিৎকার করতে পারে না কেন? মানুষের ধরণ বিচিত্র। পুষ্পের ধরণে এক রকম অসহায় সরলতা আছে। তার দারিদ্রের মধ্যে বড় হওয়া, অনেকগুলো বোনের মধ্যে বাঁচার অবহেলা আর কোনো রকমে দশম শ্রেণিতে থাকার সময় বিয়ে দিয়ে পিতার দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা- এমন একটা মেয়ে যখন স্বামীর ধনী বন্ধুর দ্বারা আক্রান্ত হয়, চিৎকার করা সম্ভব হয় না। আসলে সবাই একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। সব মানুষের ব্যক্তিত্বের গড়ন এক রকম নয়।
বিষয়টা অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। এ ধরণের সম্পর্ক যদি পরস্পরের সম্মতিতেও হয়, চূড়ান্ত বিচারে আমরা দেখবো প্রকাশিত হলে সমস্ত সামাজিক দায়টা নারীকে বহন করতে হয়। আজাদ যেটাকে কলঙ্ক বলেছেন। ঘৃণা-লজ্জা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ- সামগ্রিক দায় নারীর ওপর বর্তায়। ফলে একটা ভয় পূর্ব থেকে নারীর মনে জেগে থাকে। কোলেট ডাউলিংয়ের (জ. ১৯৩৮ ) ‘সিন্ডারেলা কমপ্লেক্স’ দিয়ে কিছুটা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। কোলেট বলছেন, সমাজ নারীকে এমনভাবে তৈরি করে সে এক ধরণের স্বাধীনতার ভয়ে ভোগে। সেই রূপকথার গল্পের সিন্ডারেলার মতো। সে রূপসী, আকর্ষণীয়া, ভদ্র, সহমর্মী, দয়ালু, পরিশ্রমী, পরাধীন এবং নরম। কেবল অন্যের ওপর তার মুক্তি নিহিত। তার নিজের অবস্থার পরিবর্তন সে নিজে করতে পারে না। এটা করার জন্যে রাজপুত্রের মতো কারোর ওপর নির্ভরতা দরকার হয়। পুষ্প-নিশাত এদের সবার ভেতরে এক একটা সিন্ডারেলা বাস করে। যখন এরা সিন্ডারেলাকে বের করে দিতে পারে নিজের ভেতর থেকে তখন এদের মুক্তি সম্ভব হয়। এটা আমরা দেখবো ‘প্রিয়তমাষু’র দুজনের স্বাধীন চিন্তা করার শক্তিতে, যখন সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এরা দু’জন বিচারের জন্য সাহস করে দাঁড়ায়।
দুই
আজাদ ধর্ষণের একটা ইতিহাস নির্মাণ করতে চেষ্টা করেন, পারেন না। আজাদ বলেন, “মানবসমাজ ধর্ষণের ইতিহাস লিখে রাখার দরকার বোধ করেনি; কিন্তু প্রাচীন পুরাণ ও উপাখ্যানে যে-বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় প্রাচীনেরা ধর্ষণকে ধর্মে ও দর্শনে পরিণত করেছিলো।” আজাদ পুরাণ থেকে নানা উদাহরণও দেন। আর বর্তমান বাংলাদেশের ধর্ষণের যে ছবি তুলে ধরেন তা মর্মান্তিক! আমরা এটুকু উদাহরণ দিতে চাই, “বাংলাদেশে এককভাবে ধর্ষণ করা হয়, দলগতভাবে ধর্ষণ করা হয়; এবং ধর্ষণের পর ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়। এখানে পিতা ধর্ষণ করে কন্যাকে (কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এক পিতা ধর্ষণ করে তার কন্যাকে), জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়িকে, সহপাঠী ধর্ষণ করে সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে কার্যালয়ের মেথরানিকে, গৃহশিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, ইমাম ধর্ষণ করে আমপারা পড়তে আসা কিশোরীকে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধূকে, দেবর ধর্ষণ করে ভাবীকে; এবং দেশ জুড়ে চলছে অসংখ্য অসম্পর্কিত ধর্ষণ।”
আজাদ কোনো সামাজিক ক্ষেত্র-জরিপ করেন না। তিনি কেবল এ প্রবন্ধের রচনাকালে দেশের নানা জায়গায় ঘটে যাওয়া ধর্ষণের বিবরণ তুলে ধরেন। তাই এ প্রবন্ধকে সাবজেকটিভ প্রবন্ধ বলা যায় না। বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণে আজাদ নানা রকমের ধর্ষণের প্রমাণ হাজির করেন। দেখা যাচ্ছে, তাঁর দৃষ্টান্তে পুলিশ ধর্ষণে অন্যতম সক্রিয় উপাদান হয়ে ওঠে। এসব দৃষ্টান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বাদ যায় না। আজাদ অসহায় বোধ করেন হয়তো। তাই সুজান গ্রিফিনকে উদ্ধৃত করেন, “আমি কখনোই ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারি নি।” তারপর বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রতিটি নারী এখন সুজান গ্রিফিন।”
আজাদ বলেন, “ধর্ষিত নারী আণবিক বোমাগ্রস্ত নগরী, যার কিছুই আগের মতো থাকে না। …. ধর্ষিত অধিকাংশ নারীই ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে না, কেননা সমাজ অনেকটা ধর্ষণকারীর পক্ষে। … ধর্ষিত নারী কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারতো বিচার বিভাগের কাছ থেকে; কিন্তু বিচার বিভাগ যা পুরুষেরই সৃষ্টি তাকে নিয়ে অনেকটা খেলায় মেতে ওঠে।”
আজাদের এ মন্তব্যের আলোকে আমরা আহমেদের উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত বিচার প্রক্রিয়ার একটা অংশ উদ্ধার করবো:
: আপনি আসামীকে চেনেন?
: জ্বি। আমার স্বামীর বন্ধু।
: কি রকম বন্ধু। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কি?
: জ্বি।
: আপনার স্বামী দু’বার আসামীর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েছেন এটা কি আপনি জানেন?
: জ্বি না।
করিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি অবজেকশন দিতে চাচ্ছিলেন কিন্তু না দিয়ে বসে পড়লেন। তিনি বলতে চাচ্ছিলেন অর্থ সাহায্য যে করা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। করিম সাহেব তা বললেন না। কারণ মিশ্র বাবু অতি ধুরন্ধর লোক, বিনা প্রমাণে এই প্রসঙ্গ কোর্টে তুলবেন না।
: অর্থ সাহায্য ছাড়াও আপনারা বিভিন্ন সময়ে আসামীর কাছ থেকে নানান সাহায্য নিয়েছেন। আসামী আপনাদের জন্য বাড়ি ঠিক করে দিয়েছিলেন, তাই না?
: জ্বি।
: স্বামীর অনুপস্থিতিতে উনি যে আপনার বাসায় আসতেন আপনার স্বামী কি তা জানতেন?
: জ্বি, জানতেন।
: তিনি এটাকে কিছু মনে করেন নি তাই না?
: জ্বি।
: তিনি ইচ্ছে করে আপনাদের এ মেলামেশার সুযোগ দিচ্ছিলেন।
: জ্বি না।
: আপনার একটা ছোট ছেলে আছে পল্টু তার নাম তাই না?
: জ্বি।
: ঘটনার দিন পল্টু কোথায় ছিলো?
: নিশাত আপর বাসায়।
: আমি যদি বলি আপনি স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে যৌনমিলনের সুবিধার কারণে আপনার ছেলেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তাহলে আপনি কি বলবেন?
পুষ্প হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিশ্রবাবু বিজয়ীর দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তাঁর দীর্ঘ জেরার মূল উদ্দেশ্যেই ছিল মেয়েটিকে কাঁদিয়ে দেয়া। নিশাত বিড় বিড় করে বলল, লোকটা এসব কি বলছে? এত নোংরা কথা সে কি করে বলছে? জহির তার দিকে তাকিয়ে বলল, আরও হয়তো কত কি বলবে? মনে হচ্ছে এটা মাত্র শুরু। তবলার ঠুক ঠাক।
পুষ্পর কান্না তখনো থামে নি। সে ফুঁপিয়ে উঠছে এর মধ্যেই আবেগশূন্য গলায় মিশ্রবাবু তাঁর ডিফেন্স করলেন, এই মামলায় দীর্ঘ ক্রস এগজামিনেশন বা প্রচুর সাক্ষ্য প্রমাণের কোন প্রয়োজন দেখছি না। ডাক্তারের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টই যথেষ্ট মনে করি। সেখানে বলা হয়েছে কোন সিমেন পাওয়া যায় নি। ধর্ষণের সময় ভিকটিম সাধারণত প্রবল বাধা দেয় সে কারণে তার শরীরে নানান ক্ষত থাকে তাও নেই। মামলা ডিসমিসের জন্য এই যথেষ্ট।
এ উদ্ধৃতিটা দীর্ঘ হলো। না হয়ে উপায়ও নেই। আমরা মিশ্রবাবুর ডিফেন্সে যে বয়ান পাই আর পাঠক গল্পটা পড়তে পড়তে যে বয়ানটা জানে দুটো ভিন্ন বাস্তবতার কথা বলে। আজাদ উকিলের এ আচরণ সম্পর্কে বলেন, “এতো উকিলের কাজ। আর উকিলের কাজ উকিল করবেই। ধর্ষিত নারী তাকে পয়সা দেয় নি, দিয়েছে ধর্ষণকারী; তাই সে সীমা পেরিয়ে গিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করবে মক্কেলকে।” কিন্তু বিচারককে আজাদ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান যেন।
ধর্ষণের মামলাগুলো এভাবেই সত্য/মিথ্যার পথে চলে না। বরং ফ্রেডারিখ নিটশে (১৮৪৪-১৯০০) কথিত ক্ষমতার শক্তিতে চলে। নিটশে বলেন, ‘‘সকল কিছু নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যাখ্যার ওপর, একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেয়া ব্যাখ্যা ব্যবহৃত ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, সত্যের ওপর নয়।’’ তাই পাঠকের জানা আর আদালতের বিচার-বাস্তবতা দুটোর বৈপরীত্য আমাদের হতাশ করে, কিন্তু আমরা অবাক হই না। আহমেদ পদে পদে পাঠককে সত্যের মুখোমুখি করেন। তারা জানতে থাকে ধর্ষিতা শরীরকে পাক-নাপাকের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলে। ফলে ধর্ষণের পর বার বার গোসল করতে থাকে। তার শরীর থেকে ধর্ষণের প্রমাণ লুপ্ত হয়। পুলিশ বেশিরভাগ এসব মামলায় সংবেদনশীল নয়, পুষ্পের ওসি দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করে বলে ডিআইজির বকা খায়। বদলিও হয়ে যায়। আর সামাজিক গ্লানির বিষয় ভিন্নভাবে মোকাবিলা করতে চান আহমেদ। পুষ্প ও রকিবকে চা-বাগানের নির্জনতায় পাঠিয়ে দিয়ে।
তিন
ধর্ষণ প্রসঙ্গে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আজাদ ইউরোপের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। যেমন, ‘পলিটিকাল রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটা গোয়েন্দা রিপোর্ট উল্লেখ করেন যেখানে সার্জেন্ট উপদেশ দিচ্ছে : “মনে রাখতে হবে যে শিশুদের বেলা ছাড়া বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্ত্রাস ব্যতীত ধর্ষণ অসম্ভব, তাই তার শরীরে সন্ত্রাসের চিহ্ন থাকবেই।” বিলেতের এক বিচারকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন আজাদ: “আপনার দুপা চেপে রাখবেন।” এক লেখিকা বিচারকের উত্তরে বলেন, “ধর্ষিত হওয়ার সময় দুপা চেপে রাখার কথা মনে থাকে না।” ১৯৮২ সালে বিলাতের এক বিচারককে উদ্ধার করছেন আজাদ: “যে-নারীরা না বলে তারা সব সময় না বোঝায় না। … বল প্রয়োগ ছাড়া ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়; তাই তার শরীরে চিহ্ন থাকবেই।”
এসব মনোভাব ইউরোপের বাস্তবতায় প্রকাশিত হলেও এর একটা সার্বজনীন চরিত্র আছে। সমাজের পুরুষতান্ত্রিক এ মনোভাবের কারণে নিশাত তার ধর্ষণের ঘটনা চেপে গেছে আর পুষ্প নিশাত ছাড়া কারো সহযোগিতা পায় নি, দুজনের কেউই আক্রান্ত হবার সময় চিৎকার করে উঠতে পারে নি। আজাদ তাই স্পষ্ট করে বলেন, “নারীবাদীরা ধর্ষণ সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন: প্রথমটি হচ্ছে ধর্ষণ শুধু ধর্ষণকারীর আলোকে বোঝা সম্ভব নয়, বুঝতে হবে পুরুষের সমগ্র মূল্যবোধের আলোকে; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ধর্ষণ যতোটা অবদমিত কামের প্রকাশ তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ নারী বিদ্বেষের।” আহমেদ উকিল এস এ করিমের মধ্য দিয়ে জানান ধর্ষণ সম্পর্কে আরেক মনোভাব : “এটা ক্ষুদ্র ব্যাপার মনে করি। একটা লোককে মারধোর করে আপনি তার একটা হাত ভেঙে ফেললেন এতে আপনার শাস্তি হবে ছয় মাসের কারাবাস অথচ রেপের ক্ষেত্রে একটি মহিলা তার চেয়েও কম শারীরিক যাতনা বোধ করবে কিন্তু সেখানে শাস্তি হবে যাবজ্জীবন। এটা আন ফেয়ার।” উকিলের এ কথায় ধর্ষণের শারীরিক ক্লেশের ন্যূনতার প্রসঙ্গ এসেছে, নিশাত মর্মাহত হয়েছে বিষয়টি শুনে। বাস্তবে এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত অনেক গভীর। বরং এ বিষয়ে আজাদের উক্তি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক: “নৃতাত্তিকরা মনে করেন, নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক পার্থক্যের পেছনে প্রাকৃতিক যে-ভিত্তিই থাকুক না কেন, নারী আর পুরুষ, কাম আর সন্তান উৎপাদন সাংস্কৃতিক ব্যাপার। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধর্ষণের ব্যাপার দেখে এ-মতটিকেই মেনে নিতে হয়।” আর এভাবে আজাদ চরম সিদ্ধান্ত দেন এভাবে: “ধর্ষণ প্রবণ সমাজে পৌরুষ বলতে বোঝানো হয় হিংস্রতা আর কঠোরতা। বাংলাদেশ এমনই এক সমাজ।”
আজাদের এ প্রবন্ধে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে ধর্ষণের জৈবতাত্ত্বিক দিকটি। পুরুষ ও নারী প্যানোর্পার (এক ধরনের মাছি) যৌনমিলনের আচরণ ব্যাখ্যা করে দেখা গেছে মিলনের জন্য পুরুষটি নারীটিকে খাবার দেয়, এতে পারস্পরিক সম্মতি তৈরি হয় কিন্তু যে প্যানোর্পা খাবার দিতে ব্যর্থ হয় তার প্রতি নারী অনাগ্রহী হলে সে বলপ্রয়োগ করে। আজাদ অবশ্য এ ক্ষেত্রে বলেন, মানুষ সাংস্কৃতিক জীব। তাকে প্যানোর্পার আচরণ দিয়ে পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় না। আজাদের এ সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর। আজাদ অনেক প্রাগ্রসর ভাবনার পরিচয় দেন এখানে। নারী-পুরুষ পরিচয়কে শরীরের একটি অঙ্গ দিয়ে আলাদা করায় জুডিথ বাটলারের (জ. ১৯৫৬) আপত্তি। বাটলার মনে করেন, শরীরের একটা অঙ্গ দিয়ে যে লৈঙ্গিক পরিচয় নির্ধারিত হয় নারী বা পুরুষ হিসেবে, এটা ঠিক নয়। এটা আসলে সাংস্কৃতিক নির্মাণ। যেই মাত্র একটা লিঙ্গের কারণে একজন পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয়, অথবা নারী তখনই সে আসলে একটা ভূমিকা পেয়ে যায়। বাটলার লৈঙ্গিক পরিচয়কে জৈবতাত্ত্বিক মনে করেন না। তিনি বরং একে সাংস্কৃতিক নির্মাণ বলেন। এ ক্ষেত্রে জেন্ডারের সাংস্কৃতিক নির্মাণের ধারণা মার খেয়ে যায়। এর বিপরীতে জৈব পরিচয় সাংস্কৃতিক নির্মাণে পর্যবসিত হয়। জৈব পরিচয় অস্বীকৃত হয়। আজাদও এতে জোর দেন। নারীর এ সাংস্কৃতিক নির্মাণ কতোটা সংকট তৈরি করে সেটা আমরা দেখবো আহমেদের উপন্যাসের শুরুতে। পল্টু একা একা নিশাতের বাড়িতে প্রবেশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যে তার মা পুষ্প ছুটে আসে। ছেলেকে নিয়ে চলে যাবার পর কেতাবি ঢঙের নিশাতের স্বামী জহির বলে, “ভদ্রমহিলা বেশ অসাবধান। ব্লাউজের বোতাম খোলা ছিল, তুমি লক্ষ্য করেছ?
: এত কিছু থাকতে তোমার চোখ গিয়ে পড়ল ঐখানে? আয়নার ভেতর দিয়ে এতসব দেখে ফেললে?
: তোমার কি ধারণা আমি অন্যায় করে ফেলেছি?
নিশাত জবাব দিল না। তার একটু মন খারাপ হয়েছে। জহির ব্লাউজের এ প্রসঙ্গ না তুললেও পারত। শালীনতার একটা ব্যাপার আছে জহিরের কি তা মনে থাকে না।”
এখানে নারীর জন্যে পোশাকের নির্ধারিত ব্যাপারটা আছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিপত্তি। পোশাকের সাংস্কৃতিক নির্মাণ থেকে সরে এলে যাকে আমরা বলতে পারি বিদ্রোহমূলক চর্চা ( discursive practice); একটা সংকট তৈরি করে। পুষ্প সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী তার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সমাজ আরও জরুরিভাবে চায়। এটা কেবল নারীর জন্যে শর্তযোগ্য হয়ে পড়ছে। জহির যা দেখে পুলকিত হয়, নিশাত তা শুনে বেদনার্ত হয়। সাংস্কৃতিক নির্মাণের ফলে বিদ্রোহমূলকচর্চা সমাজের জন্য অসহনীয়।
চার
আমরা লক্ষ্য করেছি দুই হুমায়ু(য়ূ)ন-ই যৌনতার ধারণায় প্রথাগত; সমাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নন। কিন্তু দু’জনই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন তাঁদের স্ব স্ব মাধ্যমে ধর্ষণের মতো একটি বিকৃত শারীরিক-মানসিক-সামাজিক সর্বোপরি সাংস্কৃতিক পীড়নের বাস্তবতা উপলদ্ধিতে। আজাদ বা আহমেদ দু’জনের কেউই চূড়ান্ত বিবেচনায় আমূলনারীবাদী নন। আজাদ নারীবাদ নিয়ে একাধিক কাজ করেছেন। বাংলা ভাষার জন্যে সেসব কাজ অতুলীয় দুষ্টান্ত হয়ে আছে। এগুলো তাঁর অ্যাকাডেমিক কাজ। ব্যক্তিগত জীবনে কতোটা প্রয়োগ করেছেন আমরা জানি না। কিন্তু এ প্রবন্ধে তিনি বিস্ময়কর সব কথা বলেছেন। যেমন বলেছিলেন, ‘নারী’ গ্রন্থে। হুমায়ুন আহমেদ এদিক থেকে আরও প্রথাগত। ভাবনায় আরও বেশি সমাজানুগত। মোহাম্মদ আজম তাই যথার্থ বলেন, “হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে প্রেম নারীধর্মী এবং তা আবশ্যিকভাবে কামসংশ্লিষ্টতামুক্ত। ঢাকার কথাসাহিত্যের একটা বড় অংশজুড়ে পুরুষপক্ষই প্রধানত প্রেমের প্রস্তাবক। আর প্রথম থেকে শরীরসংশ্লিষ্টতা এর প্রধান আকর্ষণ। বিপরীতে হুমায়ূনের নারীরা কেবল গল্প করেই পার করে দিয়েছে বহু বাসররাত।” এর ভেতর থেকেই দেখতে হবে নিশাত আর পুষ্পের ধর্ষণকাণ্ডে তাদের প্রতিক্রিয়া।
মেহেদী হাসান: গবেষক ও প্রাবন্ধিক