শখের বশে নয়, নিজের অস্তিত্ব ও সম্মান রাখতেই আমি উদ্যোক্তা
দেশের অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তারা বড় ভূমিকা রাখছেন বর্তমানে। বিশেষ করে অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের সপ্রতিভ বিচরণ ও সফলতা আমাদের মনে আশা জাগায়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নারী উদ্যোক্তাদের সংগ্রাম, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, ত্যাগ ও আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো তুলে ধরতে চায়। এই গল্পগুলোই আরো হাজার নারীকে উজ্জীবিত করবে, পথ দেখাবে। আজ রইলো সোনিয়া পারভীন শুচি’র গল্প।।
মুক্তভাবে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেও যেমন মুক্ত বাতাসের প্রয়োজন তেমনি মুক্তভাবে বাঁচতেও নিজের আত্মসম্মান, আত্মনির্ভরশীলতার দরকার। কোন শখের বশে কিংবা সময় কাটানোর জন্য নয়, নিজের অস্তিত্ব,আত্মসম্মান টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যেতেই আমি সোনিয়া পারভীন শুচি ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করি আমার শুচিস কালেকশনের। দীর্ঘ ছয় বছরের যাত্রায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি, সবার ভালোবাসা, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সততার গুণে শুচিস কালেকশন অনলাইন সেক্টরে নিজের দৃঢ় অবস্থান দাঁড় করিয়েছে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
আমি ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে মাষ্টার্স করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি শুরু করি। ২০০৯ সালে বিয়ের পর আর চাকুরি করা হয়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে স্বামী, সন্তান, সংসারের বেড়াজালে অবহেলা-অবমাননায় জীবন হয়ে ওঠে অনুভুতিহীন, অস্তিত্বহীন। তারপর একটা সময় গিয়ে মনে হয় এভাবে আর না। কিছু একটা করতেই হবে। নিজস্ব আর্থিক স্বচ্ছলতা ছাড়া যে কোনো মূল্যায়ন হয় না তা হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছি। ছেলেকে অন্যের কাছে রেখে চাকুরি করারও সুযোগ ছিল না আর সবসময় স্বাধীনভাবে নিজের মত করে কিছু করার সুপ্ত বাসনা ছিল সবসময়।
তাই বেছে নিলাম অনলাইন বুটিকস ব্যবসাকে। সন্তান, সংসার সামলিয়ে ঘরে বসেই কাজ করা যাবে। প্রথমে খালা শাশুড়ির বুটিকস থেকে থ্রিপিস ও রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি এনে একটু একটু করে ব্যবসা শুরু করতে থাকি সীমিত পরিসরে কারণ তখনও অনলাইন ব্যবসা এতটা জনপ্রিয় ছিলনা। বছর ঘুরতে একটু ফলোয়ার বাড়তে থাকে, ভাবলাম নিজের দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করি। শুরু করি প্রি অর্ডার বেস টাই ডাইয়ের শাড়ি, থ্রিপিস, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার তৈরির কাজ। তখন এগুলোর কারিগর কিংবা সোর্স পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ছিল। ঢাকার বাইরে একজনকে পেলাম যিনি আমার পছন্দমত ডিজাইনে কাজ করে দেবে। কিন্তু যতটা সহজ মনে হয়েছিল, কাজটা ততটাই কঠিন ছিল। প্রথম প্রথম ভাল সাড়া পেলেও পরবর্তীতে কারিগরের অবহেলা, নিম্নমানের কাপড়, সময়মত কাজ না দেওয়ায় অর্ডার আসা কমতে থাকে, আমিও তখন এতটা হতাশ হয়ে পড়ি যে ভেবেছিলাম কাজ বন্ধ করে দেব, আর হবে না। ওপরওয়ালার রহমত এবং আর আমার নিয়তিই বোধ হয় চায়নি আমি থেমে যাই।
আবার সুযোগ পেলাম নিজের মত করে কাজ করার। খুঁজে পেলাম হ্যান্ডলুম, উন্নতমানের দেশীয় শাড়ি, কাপড় তৈরির তাঁতিকে, সেই সাথে পেলাম ন্যাচারাল ডাইয়ের একজন দক্ষ কারিগরকে। শুরু হল আমার শুচিশ কালেকশনের নতুন যাত্রা। তখন আসলে ভেজ ডাই বা ন্যাচারাল ডাই ততটা জনপ্রিয় ছিল না। কেমিক্যাল ডাইয়েরগুলো ভেজ ডাই বলে কম দামে বাজারে বিক্রি হত। তাই প্রথমে ভেজিটেবল ডাইকে অনলাইন পেজে জনপ্রিয় করে তুলতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। যেহেতু অনলাইনে, তাই মানুষের আস্থা পেতে সময় লেগেছে, মানুষকে বোঝাতে সময় লেগেছে অরিজিনাল ন্যাচারাল ডাই কোনটা আর কোনটা কম দামে বিক্রিত কেমিক্যাল ডাই। তবে এবার আর প্রি অর্ডার বেস কাজ করিনি, নিজের জমানো সামান্য পুঁজি দিয়ে প্রথমে ৫টা শাড়ি এবং ১০টা থ্রিপিস দিয়ে স্টক করে শুরু করলাম ন্যাচারাল ডাইয়ের কাজ। নিজে সব তদারকি করে কারিগরকে দিয়ে শাড়ি থ্রিপিস তৈরি করতে থাকলাম। ভালো মানের কাপড় ব্যবহার করেছি সাথে রঙয়ের নিশ্চয়তা। একটু ভিন্নতা রাখার চেষ্টা করেছি সবসময় তাই দিন দিন চাহিদা বেড়েই গেছে। চাহিদা বাড়ায় আমিও আমার কাজের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। নরসিংদী মিল থেকে থান কাপড় অর্ডার করে তারপর সেগুলো থ্রিপিসের জন্য ডাই করা হত। তবে ড্রেসে ওড়নাটা ঠাকুর গাঁওয়ের তাঁতীকে দিয়ে তৈরি করে নিতে হত ১০০-১৫০ পিস, সুতি শাড়ির ক্ষেত্রেও তাই। দেখতে দেখতে ৫টা থেকে প্রতিমাসে ১০০-২০০ শাড়ি এবং ৩০০ এর মত থ্রিপিস গড়ে প্রতি মাসে তৈরি করা হত। কাপড়ের গুনগত মান নিয়ে কোনো রকম আপোস করি নি।
ন্যাচারাল ডাই সাধারণত ১০০% কটনে, সিল্কে করা হয়, ন্যাচারাল রঙগুলো ছিল সীমিত কিছু রঙয়ে। তাই রংয়ে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছি রঙ্গিন কাপড়ে ন্যাচারাল ডাই করে। এতে করে কাস্টমার রঙিন কিছু, ভিন্ন কিছুর স্বাদ পেয়েছে, সেই সাথে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং দিন দিন আগ্রহ বেড়েছে ডাইয়ের কাপড়ের প্রতি। আমাদের এখানে শাড়ি পাওয়া যাবে হ্যান্ডলুম কোড়া কটন, হাফ সিল্ক,জয়শ্রী সিল্ক এবং সফট সিল্কের, যার মুল্য ২২০০ থেকে ৮৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর থ্রিপিস কোড়া কটন, সুতি ভয়েল কাপড়, জয়শ্রী সিল্কে পাওয়া যাবে যার মুল্য ১৬০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।
ক্রেতার চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে ন্যাচারাল ডাইয়ের পাশাপাশি আমরা মোমবাটিক, ব্লকের থ্রিপিস নিয়েও কাজ করছি। তবে এগুলো নিজেরা প্রোডাকশনে না গিয়ে সরবরাহকারীর মাধ্যমে সংগ্রহ করি। আমরা ঢাকার ভেতরে ক্যাশ অন ডেলিভারি করি এবং ঢাকার বাইরে সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে পণ্য কাস্টমারদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বর্তমানে অনলাইন বাজারে অনেক প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্ধী রয়েছে। এই হাজার হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারাটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আনকমন ডিজাইন, মানসম্মত পণ্য, দাম, ক্রেতার প্রতি ভালো মনোভাব ও ব্যবহার এক্ষেত্রে অনেকাংশে সাহায্য করে অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা রাখতে।
সবশেষে বলতে চাই, ব কাজেই বাধা আছে, সেই সাথে আছে ঝুঁকি, তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে পেছনেই পড়ে থাকতে হবে। মেয়ে বলে নিজেকে কখনো দুর্বল না ভেবে নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, মনোবল, সততা থাকলে যেকোন অসাধ্য সাধন করা যায়। আমার এই দীর্ঘ পথ চলায় আমার পরিবার আমাকে সবসময় সহযোগীতা করে এসেছে। ফলে কঠিন কঠিন সমস্যাগুলো পার করে আসতে পেরেছি সহজেই।