আমার সাথে এমন হলে আমি কী করবো?
সাদিয়া মেহজাবিন।। সময় নদীর স্রোতের মত প্রবাহিত হচ্ছে আর রেখে যাচ্ছে পলি মাটি রূপে কিছু স্মৃতি। সময়ের চক্রে সে স্মৃতি বেদনা, হাসি, ভয় , লজ্জা, সুখ মিশ্রিত। তবে সাম্প্রতিক এমন কিছু বিষয় আছে তা নিয়ে মাতামাতি হলেও মানুষ ভেদে বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন। যেমন ধর্ষণ একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠছে আমাদের কাছে। প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু যারা এসব নিয়ে মাতামাতি করছেন, প্রতিবাদ করছেন ছাড়াও এক শ্রেণি আছে যারা মানসিকভাবে আরো কষ্ট পাচ্ছেন। তারা কাউকে বলছেন না কিন্তু তারা এসব নিয়ে মানসিক রোগে ভুগছেন। কেবল মানসিক সমস্যা নয় সে সাথে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক সমস্যা। মা বাবা পরিবার কিংবা নিজেরাও সবসময় একটা আতঙ্কের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা এমন নয় যে ধর্ষণ হলে তা সামাজিক ভাবে জানানোর প্রয়োজন নেই। বিষয়টা মূলত সকলের সেই শ্রেণিকে নিয়েও ভাবার যারা এসব দেখে আতংকে আছে এবং মানসিক ভাবে ভীত।
একজন শিশুকে অবশ্যই আমরা সচেতন হতে সেক্স এজুকেশন, খারাপ স্পর্শ, ধর্ষণ এসব সম্পর্কে বলবো, তবে তা যেন তার ভীতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়ে সচেতনতা দরকার। কেবল শিশু নয়, যেকোনো বয়সের নারীর যেন মানসিক সমস্যা না হয় তাও বিবেচ্য এখানে। আমার এই ঘটনা বলার ইচ্ছা থাকতো না যদি আমার মত অনেকেও না ভুগতেন।
টানা কিছু সপ্তাহ ধরেই আমি স্বপ্নে দেখছি আমাকে কেউ ধর্ষণ করতে চাচ্ছেন। খুব সম্ভবত আমার ঘুমের নিয়মের কারণেই আমি রাত জেগে থাকি এবং সকালে ঘুমাই। প্রায় এখন প্রতিদিন দেখি স্বপ্নে আমাকে কেউ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাবু করতে চাচ্ছে। আমি নানা ভাবে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্বপ্নে স্পষ্ট চেহারা দেখার ফলে আমি আরো ভীত হয়ে যাই এবং স্বপ্নে দেখি আমি নিজে যেহেতু চাচ্ছি না তাও জোর করা হচ্ছে তখন ছুটে চলে আসতেও পারছি না।
আমি ঘুমের মধ্যেই খুব ভয় পাই, ঘামতে থাকি, দেখি আমি প্রতিবাদ করতে পারছি না, শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, প্রতিবাদ করতে না পারায় আমার স্বপ্নে আমি নিজেকেই তিরস্কার করতে থাকি। ঘুম থেকে উঠেই বুঝে যাই এসব মিথ্যে তবে ভয় সারাদিন ধরেই লেগে থাকে। বিষয়টা তখন আমাকে আরো বেদনা দেয় যখন সারাদিন চেহারাগুলো আমি মনে করতে পারি। আমার পরিচিত মুখ। তবে তাদের কেউ কখনোই আমার সাথে খারাপ আচরণ করেনি বরং তাদের দ্বারা এমন সম্ভব আমার ভাবতেই খারাপ লাগে এবং মানতেও পারি না। তবে তাদের দেখছি কেন তা আমার কাছে মূখ্য নয়। আমি ভীত থাকি এবং মানসিক সমস্যায় পড়ে যাই।
আমরা সকলেই জানি স্বপ্নে তাই দেখি যা নিয়ে আমরা বেশি ভাবি কিংবা ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করি। সঠিক কারণ না জানলেও আমি জানি এসব বিষয় নিয়ে আমার অতি ভাবনার ফসল এমন স্বপ্ন। তবে আমি কেন কাউকে এসব তুচ্ছ বিষয় জানাবো? কিন্তু প্রশ্ন, কেন নয়? আমার মত অনেকেই এমন স্বপ্ন না দেখলেও এসব ঘটনা দেখে দেখে আতঙ্কে আছে। মা বাবাও সারাক্ষণ ভয়ে থাকেন এবং শিশু থেকে বৃদ্ধা সকলের উপর আইন আরোপ করে দেন। বেশি খারাপ তখনই লাগে যখন দেখি অনেকেই বিচার পাচ্ছেন না। অনেক মানুষকে হেয় হতে হয়। তখন মনে হয় আমার সাথে এমন হলে আমি কী করবো? বিচার পাওয়া দূরে থাক যদি লোকে আমাকে আঙ্গুল দেয়? এখন আমাদের সমাজ যা অন্যদের সাথে করছে ঠিক তেমন।
মানসিকভাবে এসব প্যাড়া দেয় যেমন, তেমন ভীত করে তোলে। কিন্তু এর মানে এই না যে এসব বিষয় নিয়ে জনসম্মুখে আওয়াজ তোলা বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করলেই বরং অচিরে আমরা অনেকে শিকার হব এমন হায়নাদের। কিন্তু কেউ কি আমাদের কথা ভাবেন? কীভাবে এই মানসিক সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়, সে বিষয়ে ভাবেন?
আমি আমার জেলায় কোথাও এমন সেন্টার দেখিনি যেখানে ধর্ষণ পরবর্তী অন্য যাদের এসব বিষয় নিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার সম্ভাবনা আছে তাদের নিয়ে কিছু ভাবতে। আমরা শিশু থেকে সবাইকে এসব বিষয়ে সচেতন করব, খবর জানাবো, প্রতিবাদ করব, বিচার না পাওয়ার অব্দি লড়ে যাব, কিন্তু বিচার দ্রুত করা প্রয়োজন যেন প্রত্যেক মা বাবা ভাবেন তার শিশু নিরাপদে থাকার সম্ভাবনা আছে অথবা বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেসব ঘটনা খুব আলোচনায় আসছে কেবল সেগুলোর বিচার হলেই হবে না, যেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি সেখানে যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকে তারও যেন বিচার হয়। যারা মুক্তমনে চলা ফেরা করে তারাও যেন আশা রাখে এ দেশেও ন্যায়বিচার সম্ভব।
মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে। তাই সকলের কথা ভেবে ধর্ষণের বিচার অন্তত দ্রুত করা উচিত যেন এসব প্রতিদিন দেখে দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ না হয়ে পড়ে কেউ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]