হযরত আয়েশা, নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রী ও ফারহানা আফরোজ
আলী আদনান।। ৬৫৬ সালে হযরত আয়েশা (রা) উটের পিঠে বসে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইতিহাসে যা উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত। স্বয়ং মুহাম্মদ (স) এর স্ত্রী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাই নয়; বরং তৎকালীন খেলাফায়ে রাশেদীন আমলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার সিদ্ধান্ত ও সমর্থন খুব গুরুত্ব পেত। তিনি যখন সেনাপতির ভূমিকায় তখন তিনি শুধুই সেনাপতি। ইতিহাস ওনাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নারী বা পুরুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে না। শুধু সেনাপতি হিসেবেই মূল্যায়ন করে।
অগ্নিকন্যা প্রীতিলতার ভূমিকা আমরা সবাই জানি। আজ থেকে একশ বছর আগে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য তিনি আত্মাহুতি দিয়েছেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার খুব সাধারণ একটি গ্রাম থেকে প্রীতিলতা উঠে এসেছিলেন। সেই সময়ে, যে সময়ে পুরুষরাও পড়াশোনায় আগ্রহী হয়নি তখন প্রীতিলতা পড়তে গিয়েছিলেন কলকাতায়। প্রাতস্মরণীয় প্রীতিলতাকে যখন আমরা স্মরণ করি তখন নারী বা পুরুষ হিসেবে করিনা। স্বাধীনতাকামী একজন বিপ্লবী হিসেবেই করি।
ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। নতুন প্রজন্ম হাতের মুঠোয় প্রযুক্তির সকল সুবিধা পাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই তারা ইতিহাসের অলিগলি ঘুরে সে সম্পর্কে জানতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। নারী অস্ত্র ধরেছে, নারী সেবা দিয়েছে, নারী সম্ভ্রম দিয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীকে মূল্যায়ন করতে পারিনি সেটা আমাদের ব্যর্থতা। তাই বলে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যায়নি, যাবেও না।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেত্রী নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুই নেত্রীর রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে আমাদের অনেকের মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু আন্দোলন দুই নেত্রীর নিয়ন্ত্রনে ছিল সেটা অস্বীকার করতে পারি না।
জওহরলাল নেহেরুর যোগ্য উত্তরাধিকার যেমন ইন্দিরা গান্ধী তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরাধিকার তার মেয়ে শেখ হাসিনা। রাজনৈতিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী থেকে শেখ হাসিনা, যেভাবেই মূল্যায়ন করি না কেন- ইতিহাস তাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মূল্যায়ন করবে। নারী হিসেবে নয়।
নাচোলের রানী ইলা মিত্র, নারী জাগরনের অগ্রদূতখ্যাত বেগম রোকেয়া, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা জাহানারা ইমাম, বাংলা সাহিত্যকে অনেকখানি এগিয়ে দেওয়া সুফিয়া কামালের নাম বাংলাদেশের ইতিহাস সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের যেমন দেবী চৌধুরানী আছে তেমনি আছে তারামন বিবি, রমা চৌধুরী।
এতক্ষন এত উদাহরন দেওয়া তাদের উদ্দেশ্যে যারা সাম্প্রতিক সময়ে একজন নারীকে গায়ে হলুদ উপলক্ষে বাইক চালাতে দেখে খুব অস্থির হয়ে উঠেছেন। স্বভাবগতভাবে আমরা অস্থির জাতি। কখন কেন অস্থির হই এটার ব্যাখ্যা অনেক সময় আমাদের কাছে স্পষ্ট না। আবার সেই অস্থিরতা বেশিক্ষন ধরেও রাখতে পারি না।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফারহানা আফরোজের ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর যারা ক্ষেপে উঠেছেন তাদের যুক্তি হলো, ধর্ম শেষ, সংস্কৃতি শেষ, রীতিনীতি প্রথা শেষ। তাদের উদ্দেশ্যে বলা, হযরত আয়েশা (রা) যখন উষ্ট্রের পিঠে চড়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন তখন যেহেতু ধর্ম শেষ হয়নি সেহেতু আজকের দিনে আমাদের লেডি বাইকার ফারহানা আফরোজ বাইক শো করলেও ইসলাম শেষ হবে না।
যারা বলছেন, বাঙালি নারী হিসেবে ফারহানা আফরোজ এমন কাজ করায় প্রথা, রীতিনীতি সব শেষ হয়ে গেল তাদের জন্যই প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, দেবী চৌধুরানী, জাহানারা ইমাম, বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের প্রসঙ্গ টানলাম। এদের কারো সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার দরকার নেই। অর্থাৎ প্রথা, রীতি নীতি সম্পর্কে যারা দোহাই দিচ্ছেন তারা তাদের যুক্তির পক্ষে কতোটুকু অটল তা নিয়ে আমি সন্দিহান। বা কথাটা এভাবেও বলা যায়, তাদের বক্তব্য নিতান্তই বায়বীয়। তাদের যুক্তি হাস্যকর।
একটু ভিন্ন দিকে আসি। ফারহানা আফরোজ বাইক শো’টি করেছেন তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে। দেশীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক দাবিদার অনেকেই দাবি করছেন, এতে বাঙালি সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে এই লেখার মাধ্যমে প্রশ্ন রেখে গেলাম, বাঙালি সংস্কৃতি বলতে তারা কী বুঝেন?
সময়ের চাকা ঘোরার সাথে সাথে মানুষের চালচলন, আচরন, রীতিনীতি, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস সবই পরিবর্তিত হয়। এক ভাষার প্রভাব যেমন অন্য ভাষায় পড়ে, একেক অঞ্চলের সংস্কৃতির প্রভাবও অন্য অঞ্চলে পড়ে। আমরা এখন যে ভাষায় কথা বলি বা লিখি- সে ভাষাতেও অন্যভাষার প্রভাব স্পষ্ট।
ভরতচন্দ্রের ভাষা আর বঙ্কিমের ভাষা একরকম নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে ভাষায় লিখেছেন, হুমায়ুন আহমেদ তার ধারে পাশেও যাননি। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকে যে ভাষায় সংলাপ উচ্চারিত হতো, এখনকার নাট্যকাররা সে ভাষা প্রয়োগ করছেন না। আগামীতে আরো পরিবর্তন হবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ সংস্কৃতি স্থির নয়। আজ ফারহানা আফরোজকে হঠাৎ করে গায়ে হলুদ উপলক্ষে বাইকে দেখে আপনি বিষয়টা নিতে পারছেন না। হঠাৎ কোন কিছুর জন্যই আমাদের মানসিকতা প্রস্তুত থাকে না। কিন্তু সময় সেটাকে স্বাভাবিক করে নেয়।
আজ থেকে ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে এদেশে গায়ে হলুদের ধরন ছিল এক রকম। সময়ের ব্যবধানে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নিত্য নতুন ধারণা যোগ হয়েছে। অন্য অনেক কিছুর মতো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন সবই হয়েছে আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেও এসেছে। বিয়ে, জন্মদিন, গায়ে হলুদসহ এরকম অনুষ্ঠানে কী রকম পরিবর্তন হয়েছে তা নিশ্চয়ই নিজের চোখে আমরা দেখেছি।
শুধু আমাদের দেশে নয়; যুগে যুগে কালে কালে মানুষ নতুনকে মেনে নিতে না পারে না, এর উদাহরন অনেক। মুহাম্মদ (সা) যখন একেশ্বরবাদের ঘোষণা দিলেন তখন সমাজ খেপে গেল। কারণ তারা নতুনকে মানতে প্রস্তুত ছিল না। আব্রাহাম লিংকন ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে বিল পাশ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণটাই হারাল। সূর্য ঘোরে নাকি পৃথিবী ঘোরে এ তর্ক করতে গিয়ে যুগে যুগে কালে কালে অনেককে হেনস্থা হতে হয়েছে।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তৎকালীন সমাজে কম লাঞ্ছনার শিকার হননি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহের কথা বললেন, তার সমাজ তাকে কম কষ্ট দেয়নি।
কন্যা সন্তান এখন জীবন্ত দাফন হয়না। ক্রীতদাস প্রথাও নেই। সতীদাহ নেই। বিধবা বিবাহ চালু হয়েছে। একসময় সতীদাহকে ধর্ম মনে করা হতো। বিধবা বিয়ে না হওয়াকেই ধর্ম মনে করা হতো। রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আগের প্রজন্মের মানুষ তাদের দাবির সাথে অভ্যস্ত না হলেও নতুন পৃথিবী তাদেরকেই ( রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) ধারণ করেছে। জয় নতুনেরই হয়েছে।
আমরা যারা কথায় কথায় জাত গেল, ধর্ম গেল, প্রথা গেল, সংস্কৃতি গেল বলে চিৎকার করি- দিনশেষে তাদেরকে পরাজয় মানতে হয়। জয় হয় নতুনের। যুগের পর যুগ, কালের পর কাল তাই হয়ে এসেছে।
এখন যেভাবে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয় বিশ বছর পর সেভাবে হবে না। নতুন নতুন ধারণার জন্ম হবে, পুরাতন পদ্ধতি বিদায় নেবে। এখন যারা বাইক শো দেখে অস্থির হয়ে উঠেছেন, সেদিন আপনাদের ছেলে মেয়েরা হয়তো বাইক শো করাটাকেই স্বাভাবিক মনে করবে। আজ যেটা অস্বাভাবিক, কাল সেটাই স্বাভাবিক হবে। এক সময় মেয়েদের স্কুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন না যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। অর্থাৎ আমাদের রীতিনীতি, প্রথা, সামাজিকতা, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।
ছোট্ট একটা প্রশ্ন রেখে লেখাটা শেষ করব। ‘‘সন্তান জন্ম দিতে সাইকেলে করে হাসপাতালে নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রী’’ এমন একটি খবর দিন দশেক আগে ফেসবুকে অনেককে শেয়ার করতে ও বাহবা দিতে দেখেছিলাম। নিউজিল্যান্ডের নারীবিষয়ক মন্ত্রী যখন নিজে সাইকেল চালিয়ে হাসপাতালে হাজির হন তখন আপনারা বাহবা দেন। আর বাঙালি নারী ফারহানা আফরোজ মোটর সাইকেল চালালেই যত দোষ! ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এমনই হয়! তবে ফারহানা আফরোজ একটি নতুন পথ দেখাল। তিনি অনেকের জন্য উদাহরন হবেন যা হয়তো সময়ের ব্যবধানে প্রমাণিত হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]