পৌরুষ দেখাতে বা যৌনকাতর হয়ে আত্মসম্মান খোয়াবেন না
মেহেরুন নূর রহমান।। আমি যখন কোন যৌন হয়রানী, ইভ টিজিং যৌন উৎপীড়নে ঘটনা পড়ি, শুনি তখন একটা কথা আমাকে ভাবায় সেটা হলো এইসব উত্যক্তকারীদের আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদাবোধ এত কম কেন? এতো লজ্জাহীন কেন এরা? এমনিতে তো মেইল ইগোর যন্ত্রণায় বাঁচা দায়। কিছু বলার জো নেই, এদের আত্মসন্মানে ঘা লাগে। তাহলে কোন মেয়ে/নারী যখন না বলে বা বিরক্ত হয় তাদের যৌন উস্কানিমূলক কথা বা আচরণে তখন কেন তারা অপমানিতবোধ করে না? বরং নির্লজ্জের মত ওই মেয়ের পিছনে পড়ে যায়। ছলেবলে, ভয়ভীতি দেখিয়ে বা ক্ষমতার দাপটে সেই মেয়েকে পেতে চায়।
অনলাইন বা অফলাইনে এইসব যৌন উত্যক্তকারী এবং যৌন নিপীড়কেরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই ফসল। এরা মেয়েদের কাছ থেকে ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত না। প্রয়োজনে মেয়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ছলে-বলে-কৌশলে তাদের উপর প্রভুত্ব করতে। মেয়েদের অপছন্দ, বিরক্তি বা ঘৃণা এদের কাছে ধর্তব্যের বিষয় না।
আমার মা একটা কথা বলতেন, সেটা হলো “যে বলে তুই তার কাছে না যাই বচ্ছর দুই।” মানে হল- তুমি আমাকে অপমান করছো সুতরাং তোমার সাথে কোন সম্পর্ক নাই। আমি এই লেখায় প্রেমের বা ভালোবাসার কথা বলছি না। আপনি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছেন, তাকে প্রপোজ করবেন, প্রত্যাখ্যাত হলে আত্মসন্মান বিসর্জন দিয়ে আপনি আরো কয়েকবার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক, তবে আপনার চেষ্টাগুলি হতে হবে শালীন। মনে রাখা জরুরি, প্রেমের ক্ষেত্রেও আপনি কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হলে যখন বুঝতে পারবেন মেয়েটা আপনার প্রতি আগ্রহী নয় তখন আপনাকে থামতে হবে।
এই লেখাতে মূলত আমি অনলাইন বা অফলাইনের সেইসব উত্যক্তকারী পুরুষদের কথা বলতে চাচ্ছি যারা কোন মেয়েকে পছন্দই করে শারীরিকভাবে কাছে আসার জন্য। তাদের কোন মেয়েকে ভালোলাগার মূল উপজীব্যই হচ্ছে যৌনতা। তারা একটি মেয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে তাকে কোন একসময় বিছানায় নিতে পারবে এই আশায়।
একজন একটি লেখার কমেন্টে বলেছেন যে প্রকৃতি ছেলেদেরকে সেক্স অবসেসড করে তৈরি করেছে। একটি মেয়েকে দেখে তাদের যৌন কামনা জাগবে এবং নানাভাবে তারা মেয়েটিকে যৌনতার জন্য রাজি করাতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে লজ্জার কিছু নাই। যেন এইভাবে ঘরে, বাইরে, অনলাইনে, মেয়েদের উত্যক্ত করা স্বভাবিক একটা ঘটনা। কমেন্টটি পড়ে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। এসব কমেন্ট পড়লে মনে হয় আমরা জঙ্গলে আছি। পুরুষরা সব মাংসাশী প্রাণী, তাদের সামনে চলমান খাদ্য হচ্ছে মেয়েরা। যখন ইচ্ছা হবে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে সে খাদ্যের উপর ন্যায়/অন্যায়, ভালো/মন্দ কোনকিছু বিবেচনা না করে।
আরে ভাই, আপনি মানুষ, আপনার মাথায় একটা মগজ আছে, আপনার ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা আছে, আপনার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মত ক্ষমতা আছে, অবশ্য যদি আপনি সেটা প্রয়োগ করতে চান আর কি।
এই কমেন্টের একটা দিক আমি সাপোর্ট করি সেটা হলো কাউকে আপনার ভালো লাগতে পারে এবং তার প্রতি আপনি যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারেন এটা স্বাভাবিক। এখন কথা হচ্ছে এই এই আকর্ষণবোধটাকে আপনি কীভাবে ম্যানেজ করবেন।
ধরুন আপনার একটি মেয়েকে ভালো লেগেছে এবং আপনি তার সাথে ইন্টিমেট সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছেন। এখন এই যে আপনি তাকে কামনা করছেন সেটা আপনি মেয়েটিকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কথায়, ব্যবহারে এবং কাজে। আপনি যদি দেখেন আপনার আচরণে বা কথায় মেয়েটি আগ্রহ দেখাচ্ছে না, বরং বিরক্তি প্রকাশ করছে বা আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে এসব সে পছন্দ করছে না, তাহলে তখন কিন্তু আপনাকে থামতে হবে। কিন্তু আপনি থামছেন না। কেন? আপনার লজ্জা হয় না? মেয়েটি না বলার পরও কেন তার পিছনে লেগে থাকবেন? কেন তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকবেন বা জোর করতে থাকবেন? এত কম কেন আপনার আত্মসন্মানজ্ঞান? কোন মেয়ে যদি আপনার ডাকে সাড়াও দেয় এবং আপনারা দুজন মিলিত হবার উদ্দেশ্যে কোথায় দেখা করার পর শেষ মুহূর্তে যদি মেয়েটি আপনাকে ‘না’ বলে, তাহলেও কিন্তু আপনি জোর করতে পারে না। অপমানিত হতে পারেন, রাগ করতে পারেন, কিন্তু আপনার যদি আত্মমর্যাদাবোধ থাকে, আপনি যদি মানুষ হন তাহলে জোর বা আঘাত করতে পারেন না।
আমি মাঝে মাঝে নিজেকে দিয়ে এসব ভাবি। ধরা যাক আমার কাউকে ভালো লেগেছে, আমি তাকে শারীরিকভাবে কামনা করছি (আঁতকে ওঠার কিছু নাই। মেয়েদেরও যৌন চাহিদা আছে এবং মেয়েরাও যৌনতা উপভোগ করে)। আমি যদি ডেসপারেট হই তাহলে তাকে কথায়, আচরণে এটা বোঝানোর চেষ্টা করবো। সে যদি বিরক্তি প্রকাশ করে তাহলে সত্যি আমি খুব আপমানিত বোধ করবো। তার সামনে আসতেই আমার মানে লাগবে। এখন ধরা যাক সেই পুরুষটিও আমার ডাকে সাড়া দিলো এবং দুজনের সিদ্ধান্তে আমরা নিরিবিলি কোথাও দেখা করলাম। সব ঠিক চলছে, শেষ মুহূর্তে পুরুষটি বললো তার ইচ্ছা হচ্ছে না এবং সে আর এগুতে চায় না। বিশ্বাস করেন আমি কি যে অপমানিত হব! আমার আত্মসন্মানে প্রচণ্ড ঘা লাগবে। আনিচ্ছুক সে পুরুষটিকে আমার আর ছুঁতেই ইচ্ছা করবে না, জোর করা তো দূরে থাক। আমি হয়তো এরপর ওই পুরুষটির সাথে কোন সম্পর্কই রাখবো না।
আমার মনে হয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন যে কোন মানুষই এটা করবে। একমাত্র আত্মসন্মানহীন বিবেকবর্জিত কুৎসিত জীবরাই অন্যের উপর জোর খাঁটিয়ে তাদের পৌরুষ জাহির করতে চায়। এতে তারা নিজেরা যে নিজেদেরকে মানুষ হিসেবে কত নিচুতে নামিয়ে আনছে এই বোধটুকুও কাজ করে না।
নারী পুরুষ সকলেরই আত্মসম্মান এবং আত্মমর্যাদাবোধ থাকা উচিত। আপনি একজন পুরুষ, আপনার যৌন কাতরতা আছে বলেই যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। আত্মসংযম বলে একটা জিনিস আছে, চাইলেই আপনি সেটা ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছাশক্তিটাই যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি যেটা সেটা হলো আপনি আপনার এই ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে সংযত করতে চান কি চান না।
তাই প্রার্থনা আত্মসন্মান, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন পুরুষের সংখ্যা বাড়ুক, পুরুষেরা নিজেদের মর্যাদা নিজেরা রক্ষা করুক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]