September 20, 2024
কলামফিচার ২

ধর্ষণ, সম্মতি, ভিক্টিম ব্লেইমিং এবং আমাদের যা যা জানা উচিত

মেহেরুন নূর রহমান।। কয়েকদিন ধরে অনলাইন তোলপাড় এক ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কেউ এর পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। অনলাইন ট্রায়াল হচ্ছে, সবাই পুলিশ, ডিটেকটিভ, উকিল, জাজ হয়ে রায় দিয়ে দিচ্ছে। ভিক্টিম ব্লেইমিং হচ্ছে, অন্যায়ভাবে ভিক্টিম এর নাম প্রকাশ করে দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব পড়তে পড়তে মনে হলো ধর্ষণ নিয়ে আমাদের কনসেপ্ট বা ধারণা এখনো কত ধোঁয়াশে! আর এই কারণেই ইচ্ছে হলো এই বিষয়ের উপর একটা লেখা লিখি।

ধর্ষণ আসলে কী?

ধর্ষণ এক ধরণের যৌন নিপীড়ন যা সাধারণত কোন ব্যক্তির সম্মতি ব্যতীত তার সাথে যৌনমিলন বা অন্যরকম যৌন অনুপ্রবেশ এর সাথে জড়িত। ধর্ষণের ইংরেজি প্রতিশব্দ Rape (রেপ) শব্দটি ল্যাটিন শব্দ “রেপ্রে” থেকে এসেছে, যার মানে- ছিনিয়ে নেওয়া, দখল করা, জব্দ করা বা জোর করে নিয়ে যাওয়া।

সম্মতি কী?

মনে রাখা জরুরি “সম্মতির অভাব” ধর্ষণ সংজ্ঞার মূল চাবিকাঠি। সম্মতি হলো যৌন ক্রিয়াকলাপের জন্য নির্দ্বিধায় প্রদত্ত অনুমোদন। সবসময় এটা মৌখিকভাবে যে প্রকাশ করতে হবে তা নয়, হ্যাঁ সূচক আচরণ এবং ক্রিয়ার মাধ্যমেও এই অনুমোদন দেয়া সম্ভব।

একপক্ষ “না” বলার পর এবং আচরণের মাধ্যমে তার অসম্মতি এবং বাধা প্রদানের পরও যখন আরেকপক্ষ তার সাথে বল প্রয়োগের মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয় তখন সেটা যে ধর্ষণ- এ ব্যপারে আশাকরি কারো কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। সমস্যা তখন, যখন দেখা যায় একটি ধর্ষণের ঘটনায় বলা হয় যে ভিক্টিম অসম্মতি জ্ঞাপন করেনি বা বাধা দেয়নি। তাহলে কি সেই যৌন সম্পর্ককে আমরা ধর্ষণ বলতে পারি? উত্তর হলো- অবশ্যই বলতে পারি। একটা জরুরি বিষয় এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে আপত্তির অনুপস্থিতি মানে কিন্তু সম্মতি প্রকাশ নয়। অর্থাৎ একপক্ষ সরাসরি “না” বলছে না বা বাধা দিচ্ছে না মানে কিন্তু এই নয় যে সে সম্মতি প্রদান করছে।

আবার ধর্ষণের পর শারীরিক আঘাত দৃশ্যমান না হলে প্রায়শই মনে করা হয় যে এই যৌনকর্মে ভিক্টিমের সম্মতি ছিলো। জোর জবরদস্তি এবং বাধা ছাড়াও একটি  যৌনমিলনকে ধর্ষণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে সেই সময়কার পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে।

 নানা কারণে একজন ভিক্টিম ধর্ষণের সময় অসম্মতি/অনিচ্ছা/বাধা প্রদান না করতে পারে-

ভয়: যখন ধর্ষক ভিক্টিমকে শারীরিক ক্ষতির ভয় দেখিয়ে বা অস্ত্র দেখিয়ে বাধ্য করে যৌনমিলনে। আপনজনদের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়েও অপরাধী বিনা বাধায় কাউকে যৌনমিলনে বাধ্য করতে পারে। আবার অনেক সময় ঘটনার আকস্মিকতায় আতংকে এবং ভয়ে পাজলড হয়ে ভিক্টিম কথা বলতে বা বাধা না দিতে পারে।

মানসিক আপোষ: ক্ষমতা অপব্যবহার করে, অসহায়ত্বের সুযোগ, বা ব্ল্যাকমেইলিং এর মাধ্যমে ধর্ষক যখন ভিক্টিমকে বাধ্য করে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মানসিক আপোষের ভেতর দিয়ে যৌনমিলনে।

সম্মতি দানে অক্ষম অবস্থা: ভিক্টিম যখন ঘুমন্ত, অজ্ঞান, বা নেশায় মাতাল হয়ে স্বাভাবিক বিচার/বিবেচনাবোধ লুপ্ত, সেই অবস্থায় স্থাপিত যৌন সম্পর্কের সময় ভিক্টিম কোন সিদ্ধান্ত প্রদানে অক্ষম হতে পারে।

মানসিক অপরিপক্কতা: এমন কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন যার মানসিক পরিপক্কতা কোন সিদ্ধান্ত প্রদানে সক্ষম নয় (বুদ্ধি প্রতিবন্ধি)। এদের পক্ষে “না” বলা বা বাধা প্রদান অনেক সময়ই অসম্ভব।

এছাড়া আইনত সম্মতি প্রদানের বয়সের নিচে কারো সাথে সম্মতিক্রমে যৌনমিলনকেও ধর্ষণ বলে অবিহিত করা হয় ।

সুতরাং সহজ ভাষায় ধর্ষণ হলো ভয়, শারীরিক শক্তি, জবরদস্তি, কর্তৃত্বের অপব্যবহার, অসহায়ত্বের সুযোগ ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা যৌন নিপীড়ন। আবার বৈধ সম্মতি প্রদানে অক্ষম যেমন অজ্ঞান, ঘুমন্ত, বুদ্ধি প্রতিবন্ধি বা নাবালক এমন কারো সাথে যৌনমিলন বা যৌন নিপীড়নকেও ধর্ষণ বলা হয়।

এখানে আর একটি বিষয় পরিস্কার করা দরকার সেটা হলো বৈবাহিক ধর্ষণ বা বিবাহিত সঙ্গী কর্তৃক ধর্ষণ যেটা আজো আমদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ/পুরুষের কাছে অবোধ্য। বৈবাহিক ধর্ষণ হলো সেই অসম্মতিপূর্ণ যৌনতা যেখানে একজন পার্টনার অপরপক্ষের সম্মতির অপেক্ষা না করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অনেক সময়ই বল প্রয়োগ এবং শারীরিক আঘাতও এর সাথে যুক্ত থাকে। এই ধরণের  ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধী সাধারণত স্বামী এবং ভিক্টিম স্ত্রী। এটি গৃহসহিংসতারও অংশ।

এখন এই যে ‘সম্মতি”, এটি দেশভেদে আইন, ভাষা, প্রসঙ্গ, সংস্কৃতি এবং যৌন দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। গবেষণায় দেখা গেছে যে পুরুষরা নারীর না সূচক ক্রিয়াগুলিকে তাদের অনিচ্ছা প্রকাশের চেয়ে যৌনক্রীড়া হিসাবে দেখে। বহু ক্ষেত্রে যৌনক্রিয়ার সময় পুরুষদের কাছে নারীর মৌখিকভাবে ‘না’  এর অর্থ  ‘চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া’ বা নারীর ব্রীড়া। অপরাধীরা অনেক সময় এই “না” বা না সূচক ক্রিয়াগুলিকে প্রভোকেটিভ অর্থাৎ নারী কর্তৃক পুরুষদের উত্তেজিত করার মাধ্যম  হিসাবেও ব্যাখ্যা করে।

মানুষ কেন ধর্ষণ করে?

কোন কারণগুলো একজন মানুষকে (সাধারণত পুরুষকে) ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ করে? আসলে কোনও একক কারণ দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। ধর্ষকদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যগুলি নানারকম হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় নিন্মোক্ত কারণগুলো উঠে এসেছে বার বার-

নারীর প্রতি ঘৃণা, রাগ, আক্রোশ

নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা এবং তাকে যৌনবস্তুর অধিক না ভাবা, সমাজ ও ধর্ম এক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা পালন করে

নারীর উপর আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা

ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ

শত্রুতা

মানসিক অসুস্থতা যেমন সেডিসম বা ধর্ষকাম- অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া

এছাড়া বিচার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, গোঁড়া সমাজব্যবস্থা, যৌনতাকে ট্যাবু করে রাখা এবং যৌনশিক্ষার অভাব ইত্যাদিও ধর্ষণের ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে।

ধর্ষণের প্রভাব

ধর্ষণ করা হয়েছে এমন ব্যক্তি সাধারনত ঘটনা ঘটার পর ট্রমাটাইজড বা মানসিকভাবে আতংকগ্রস্থ হয়ে পরে এবং সে পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্যে) আক্রান্ত হতে পারে। গুরুতর শারীরিক জখম, গর্ভাবস্থার ঝুঁকি, যৌন সংক্রমণের ঝুঁকি এসব ব্যাপার তো আছেই। এছাড়া ভিক্টিম, ধর্ষক এবং কোনও কোনও সংস্কৃতিতে নিজ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সহিংসতা বা হুমকির মুখোমুখি হতে পারে।

ধর্ষণের পর অনেক সময় ভুক্তভোগীরা তাদের সাথে যা ঘটেছে তা যে ধর্ষণ সেটা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। ভয়, লজ্জা, অপরাধবোধসহ কেউ কেউ বছরের পর বছর ডিনায়্যাল বা অস্বীকারের ভেতর থাকে। চেনা মানুষদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার ভিক্টিমদের মাঝে থাকে নিজের প্রতি অবিশ্বাস, গ্লানি, নিজেকে দায়ী মনে করার  প্রবণতা, পরিচিতজনকে ধর্ষণকারী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করার অনীহা ইত্যাদি। এই সকল বিপরীতমুখী আচরণের কারনে ভিক্টিমকে অনেক সময় অসাধু, মিথ্যাবাদী এসব অপবাদ পেতে হয়।

ধর্ষণ চলাকালীন কেউ বাধা দেয়, লড়াই করে, আবার কেউ এসব করার সাহস বা শক্তি হারিয়ে ফেলে অনুগত এবং সহযোগী হয়ে সাড়া দেয়। এটা তারা করে সারভাইভাল ইনস্টিংক্ট এর কারণে। পরবর্তীতে এই আচরণই ভিক্টিমকে হতাশ করে, লজ্জিত করে এবং সে ঘটনাটি লুকাতে চায়। ঘটনা প্রকাশ পেলেও ধর্ষক ভিক্টিমের এই আচরণকে পুঁজি করে এটিকে দুজনের সম্মতিক্রমে ঘটা একটি যৌন সম্পর্ক হিসেবে প্রচার করতে চায় এবং মেয়েটিও নানা লাঞ্ছনার শিকার হয়। যৌন নিপীড়ন ঘটার কয়েক বছর পর পর্যন্ত ট্রমার লক্ষণগুলি থাকতে পারে।

ভিক্টিম ব্লেইমিং

ধর্ষণের কারণ নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। এই ধারণার কারণে ভিক্টিমের পক্ষে ধর্ষণ নিয়ে কারো সাথে কথা বলা বা সাহায্য পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ভিক্টিম প্রায়শই ভাবে যে তার কারণেই সে ধর্ষিত হয়েছে। অন্যরা তাকেই দোষ দেবে বা তাকে বিশ্বাস করবে না। সে পুরো ঘটনার জন্য ভয়ানক গ্লানি বোধ করে এবং নিজেকে দোষ দিতে থাকে। শুধু তাই নয়, এই ধারণাগুলি পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সমাজ কীভাবে ভিক্টিমের সাথে আচরণ করবে তাকেও প্রভাবিত করে এবং ভিক্টিম ব্লেইমিং করতে সাহায্য করে। নিচে এই ধরনের কিছু ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হলো, সাথে এসব ধারণার বিপরীতে প্রকৃত সত্যটি কী তা তুলে ধরা হল-

ধারণা ১-  “কেউ যদি মাতাল বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হয় তবে সেটি তার নিজস্ব দোষের কারণে ঘটেছে। সবার, বিশেষত নারীদের উচিত নিজেকে সুরক্ষিত রাখা”। সাম্প্রতিক এক ধর্ষণের ঘটনায় আমরা দেখতে পাই গাঁজা খেয়ে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ধর্ষিত হয়েছে বলে দাবি করা এক নারীকে কেন সে গাঁজা খেল এই বলে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে, যেন গাঁজা খেয়ে মাতাল হওয়া কোন নারীকে ধর্ষণ করা জায়েজ।

– কারো ক্ষতি না করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ মদ পান বা গাঁজা টানার অধিকার রাখে। এটি তার নিজস্ব অধিকার। এর ভাল মন্দ বিবেচনার দায়ও তার। কেউ খুব মাতাল, নেশগ্রস্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার মত অবস্থায় না থাকলে, তার এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে যৌনমিলন মানে ধর্ষণ এবং এটি অতি অবশ্যই ধর্ষকের দোষ।

ধারণা ২-  “মেয়েরা/নারীরা প্রায়শই ধর্ষণের বিষয়ে মিথ্যা বলে কারণ তারা অনেক সময়ই কারও সাথে যৌন সম্পর্কের পর অনুশোচনায় ভোগে। আবারা তারা মনোযোগ পাবার জন্যও এটা করে থাকে।”

– মিডিয়াতে প্রচারিত নানা গল্প এই ধারণাটি দিতে পারে যে নারীরা প্রায়শই যৌন সহিংসতা সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে। কিন্তু আসলে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগের পারসেন্টেজ খুবই কম। ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার বেশিরভাগ ঘটনাই রিপোর্ট করা হয় না।

ধারণা ৩- “যদি কেউ চিৎকার না করে বা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা না করে তবে তা ধর্ষণ নয়।”

– কথাটি সত্য নয়। উপরে বলেছি, এমন অনেক কারণ রয়েছে যার জন্য ভিক্টিম অনেক সময়ই চিৎকার বা লড়াই করতে পারে না। অনেক সময় আতংকে ভয়ে ভিক্টিম কথা বলতে বা বাঁধা দিতে পারেনা। অনেক সময় ধর্ষণ চলাকালীন সময় বেঁচে থাকার প্রাকৃতিক তাগিদে ভিক্টিম সহযোগী হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া আগেই বলেছি, ক্ষমতা অপব্যবহার করে, অসহায়ত্বের সুযোগ, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক আপসের ভেতর দিয়েও ধর্ষণ হয়। মনে রাখা দরকার – যৌনমিলনের জন্য নিরপেক্ষ সম্মতি দরকার নচেৎ তা ধর্ষণ।

ধারণা ৩- “আপনার যদি কারও সাথে সম্পর্ক থাকে বা আপনি যদি বিবাহিত থাকেন তবে আপনার সঙ্গীর সাথে সেক্স করার সময় ইচ্ছা অনিচ্ছা কোন বিষয় নয়। সঙ্গী চাইলে আপনার উপর জোর করতে পারে এবং এটি দোষের নয়।”

– প্রত্যেকেই তার সঙ্গীর সাথে যে কোন সময় যে কোন ধরণের যৌন ক্রিয়াকলাপে ‘না’ বলার অধিকার রাখে। স্বামী হোক বা প্রেমিক হোক, সম্মতি ছাড়া যে কোন কারো সাথে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণের আওতায় পরে। যৌনতায় দুজনের স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

ধারণা ৪- “ ধর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় নারীদের রাতে একা বাইরে যাওয়া উচিত না। নারীরা রাতে বাইরে গিয়ে ধর্ষণকে উৎসাহিত করে।”

– পরিসংখ্যান বলে, ১০টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ১টি ঘটনাই মাত্র ‘অপরিচিত’ কারো দ্বারা সংঘটিত হয়। বাকিগুলি ঘটে চেনা গণ্ডীতে চেনা মানুষ দ্বারা- যেমন বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী বা পরিবারের সদস্য দ্বারা বাড়িতে, কর্মস্থলে এবং অন্যান্য জায়গায় যেখানে তারা আগে নিরাপদ বোধ করতো। যে কোন কারণে যে কেউ রাতে বাইরে যেতে পারে। আইনকানুন ব্যবস্থার উন্নতি না করে, ধর্ষকদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা না করে নারীদের গৃহবন্দি করে রাখলে কোন লাভ নেই।

ধারণা ৫- “নারীর খোলামেলা পোশাক ধর্ষণ করাকে উস্কে দেয়।”

– কে কী ধরণের পোশাক পরবে সেটা তার নিজস্ব ইচ্ছা। পোশাকের সাথে যৌনতা সম্পর্কযুক্ত নয়। খোলামেলা পোশাক ব্যাপারটাও ভীষণ আপেক্ষিক। পা থকে মাথা কাপড়ে ঢাকা নারীরাও ধর্ষণের শিকার হন। কোনো নারী কী পরে আছে, তা বিবেচ্য নয়- যদি সে যৌনতার বিষয়ে সম্মতি না দেয় তবে তা ধর্ষণ। ধর্ষণের জন্য কেবল ধর্ষকের মানসিকতাই দায়ী, নারীর পোশাক নয়।

ধারণা ৬- “একবার কোনও পুরুষ যৌন উত্তেজনায় তাড়িত হলে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না; তাকে সেক্স করতে হয়।”

– শারীরিকভাবে পুরুষও যৌনমিলনের তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ঠিক যেমন পারে নারী। এখানে পুরুষটির ইচ্ছা শক্তি জরুরি। যৌন তৃপ্তির জন্য কাউকে ধর্ষণ করার দরকার হয় না। ধর্ষণ একটি হিংসাত্মক কাজ যা অপরপক্ষের উপর ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য এবং ঘৃণা প্রকাশের জন্য করা হয়। এর কোন অজুহাত নেই।

ধারণা ৭- “যৌনতার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নারীরা মিশ্র সংকেত দেয়। তারা মাইন্ড গেম খেলে এবং তাদের ‘হ্যাঁ’ অনেক সময়ই ‘না’ হিসেবে প্রকাশ পায়”।

– যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে কোন পক্ষের ‘না’ বলার এবং যে কোনও মুহুর্তে মন পরিবর্তন করার আইনগত অধিকার রয়েছে। অপর পক্ষ যদি না থামে বা জোর জবরদস্তি করে তবে সেটা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ।  নারীর “না” মানে “হ্যা” এই রোমান্টিসিজম বা চালাকি থেকে সকল পুরুষদের বের হয়ে আসা উচিত। সঙ্গীর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে বুঝতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে।

ধারণা ৮ – “পুরুষরা ধর্ষণের শিকার হয় না।”

– পুরুষরাও ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ধর্ষণের সঙ্কট নারী ও বালিকার উপর বেশি থাকলেও আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে পুরুষ এবং ছেলেদের উপরও যৌন সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রভাব কম বিধ্বংসী নয়।

প্রার্থনা আমরা সবাই যেন ধর্ষণের সংজ্ঞা সঠিকভাবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি ধর্ষণের পর একজন ভুক্তভোগী কী পরিমান মানসিক যন্ত্রণা এবং ট্রমার ভেতর দিয়ে যায়। ভিক্টিম ব্লেইমিং, ভিক্টিম শেইমিং বন্ধ হোক। মানুষ হিসেবে আমরা আর একটু বেশি সদয়, সহানুভূতিশীল এবং বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন হই।