November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ফেমিনিস্ট হয়ে উঠুন

প্রিথুলা মারজান।। সমাজ তার সংস্কৃতি দ্বারা তার নিয়তিকে চালিত করে আর এই নিয়তি বদলায় একমাত্র নারীদের দ্বারা। রুশ সমাজে জারতন্ত্র চলছিল তার পূর্ববর্তী সংস্কৃতিতে, শত বছরের পুরনো স্বৈরাচার, নির্যাতনতন্ত্র রুশীয়দের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল।

প্রোফেট মোহাম্মদ (সাঃ) এর সময়ে নারীরা উটে আসা যাওয়া করতো, ব্যবসা করতো, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও তাদের অবদান ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে ব্যাখ্যাই আসুক না কেন, তাতে অনেক বিরোধী মতামতও উপস্থিত হবে এবং এটা মেনে নিয়ে এগোতে হবে। কিন্তু যেটা প্রোফেট এর সময়ে সম্ভব ছিল কিন্তু এখন সম্ভব হচ্ছে না, তার কারণ কি?

এজন্য বিশেষ করে আধুনিক সময়কার সৌদী রাজতন্ত্রকে দায়ী করা যায়। তারা এক্সট্রিম, ফান্ডামেন্টালিজম তথা ওয়াহাবী মতবাদ প্রচার করে অ্যান্টি-প্রোফেটিক ডিসিপ্লিন প্রতিষ্ঠা করে তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য। দেখুন, ফেমিনিজম এর ব্যাপারে আমাদের মাঝে ভুল ধারণা বসিয়ে দিছে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, যেমন- ফেমিনিজম কম্যিউনিজম এর শাখা, ফেমিনিজম কনফ্লিক্টের সৃষ্টি করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফেমিনিজম যাইহোক না কেন অন্তত কাউকে অবদমিত রাখে না, হোক সেটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের হোতা পুরুষদের বেলায়ও, তারা নিজেদের অধিকার সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যকে তথা পুরুষকেও তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করে।

এই তো সেদিন আমাদের বঙ্গীয় লিলিথ তসলিমা নাসরিনের জন্মদিন ছিল। তসলিমা এরকম করছে, ওরকম করছে, তসলিমা ছেলেদের মত দাঁড়িয়ে প্রসাব করার অধিকার চায়ছে, তসলিমা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেঁড়াজাল ছিঁড়তে বলছে, ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সমালোচনার নামে সামাজিক সংহতি ধ্বংস করছে, ধর্মীয় মূল্যবোধের অসম্মান করছে…  আরো কত কি!

আসলেই কি তসলিমার বলা কথাতে সমস্যা ছিল? না। আসলে কথাটা তসলিমা বলছে এটাই সমস্যা কারণ সে একজন নারী। নারী হয়ে শতকরা নব্বইজন সৌদরাজতন্ত্রী অ্যান্টি প্রোফেটিক ডিসিপ্লিনের বিরোধী কথা বলছে যেটা সমাজের কর্ণধারদের মানতে অসুবিধা হচ্ছে।

আপনি নারী, আপনি বাইক চালাইতে পারবেন না, বাইক চালানোর জন্য রাজদণ্ড থাকতে হবে, বাইকের মানচিত্র তৈরি করছে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভুত জারজেরা। সেই মানচিত্র অনুযায়ী নারীরা কীভাবে বাইক চালাবে? আর চালাইলে মানবে কীভাবে তারা?

কয়েকদিন আগের বাইক চালিয়ে বিয়ে করতে যাওয়া মেয়েটার সমালোচনা করছে যারা তারা মনে করছে তারা হয়তো চ্যালচ্যালায়া স্বর্গে চলে যাবে, মেয়েটাকে নরকে পাঠিয়ে দিলো তারা, আসলে নরকে মেয়েটাকে তারা পাঠায়নি বরঞ্চ মেয়েটাই বিয়ে নামক ট্যাবুতে ধরা দিয়ে এমনিতেই নরকে চলে যাচ্ছে।

চকরিয়ায় গরু চুরির মত জঘন্য অপবাদ দিয়ে মা মেয়েকে নির্যাতন করা, বাবুলের রাজদণ্ড উচিয়ে যৌন হয়রানি,সবকিছুই হচ্ছে আমাদের মত সমাজের অন্যান্য অংশের দ্বারা। আবার আসবে কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল স্যুডো ফেমিনিস্টরা। তারা নারীদের কথা মুখে বলবে কিন্তু নিজেদের বেলায় পুরাই ফান্ডামেন্টাল প্যাট্রিয়ার্কাল স্যোলমেট হয়ে উঠবে ঐসব অপরাধীদের। তারা নারীদের বলবে তোমার কষ্টের কী দরকার? আমরা তো আছিই।

নারীরাও এইসব কথায় ভুলে যায়, সব অতীত অত্যাচার, নিপীড়নের ইতিহাস। রাতে বৃষ্টিতে গোসলের ব্যাপারে এক বান্ধবী বলছিল বৃষ্টিতে গোসল তো দূরের কথা এমনিই বাইরে গোসল করতে পারি না। আর যদি একবার বৃষ্টিতে গোসল করতে দেয়ই তাহলে তারা ভাবে অধিকার পেয়ে যাচ্ছে বোধ হয়! অধিকার পায় না, বরঞ্চ দেওয়া হয় যাতে নারীরা এই ফ্যাসিনেশন নিয়ে থাকে যে এই সমাজ নারী কল্যানকামী সমাজ। নারীর অধিকারের জন্য সবাই সচেষ্ট।

নারীরা যাতে অন্য আর কোনো বিষয়ে মাথা না ঘামাতে পারে, তাহলে পিতৃতান্ত্রিকদের গড়া স্বপ্নের অবাধ স্যুডো ফেমিনিস্টিক ফেল্যাসি ধ্বসে  যাবে। এই ভয়ে তারা ফেমিনিস্ট হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, নারীর যদি কোনো বন্ধু, তাদের অধিকারের বিষয়ে সরব থেকে থাকে তাহলে সে হলো নারী নিজেই। এই যে যারা তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলে, তারা তাদের নিজস্ব ব্লেন্ডের তৈরি ফর্মুলায় নারীবাদ প্রচার করে যা আখেরে সেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই ডেভেলপড ভার্সনের স্বার্থে কাজ করে।

ফেমিনিজম খারাপ হোক ভালো হোক সেই প্রশ্ন বাদ দিয়ে নারী আপনি ফেমিনিস্ট হয়ে উঠুন। নিজের অধিকারের ব্যাপারে নহন্যতে ন নীতি অনুসরন করুন। মন যা চাইবে তাই করুন। সমাজ-নামাজ, রীতিনীতির গল্প তো অনেক শুনলেন, আরো শুনলেন স্যুডো ফেমিনিস্টদের কথা, এখন একটু নিজের কথা শুনুন।

আমাদের বেঙ্গল সংস্কৃতিও তার নিয়তির দিকে মোড় নিতে বাধ্য এখন। তার বছরকে বছর নারী নির্যাতনের রেকর্ড নিজস্ব পুরনো ভেঙ্গে গুড়িয়ে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। এর জন্য বিদ্যমান ধ্যান ধারনাকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর নারী অধিকারের জন্য সেই ডিসিপ্লিন হবে ফেমিনিজম।

ফেমিনিজম একটা আন্দোলন যা আপনার সহস্র বছরের পুরানা আইডেন্টি ক্রাইসিসের সমাধান দিয়ে নিজেকে এ পৃথিবীর স্পিন এর সহযোগী বলে স্বীকার করতে বাধ্য করবে। ফেমিনিস্ট হয়ে উঠুন। তাহলে আর কেউ সাহস পাবে না আপনার বাইক চালানো নিয়ে কথা বলতে, পারবে না আপনার রাত-বিরাতে ঘোরা নিয়ে কথা বলতে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]