September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সাইবার ক্রাইম এবং একটি অভিজ্ঞতা

সাদিয়া মেহজাবিন।। অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা দুটোই অপরাধ। কিন্তু আমরা কয়জন তা পালন করি আমার জানা নেই। প্রথমত আমি ভেবেছিলাম নিজের এমন সমস্যার কথা উল্লেখ করে অন্যের সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই না। তবে ভেবে দেখলাম ব্যক্তির সমস্যা যখন পুরো সমাজেরও সমস্যা তখন তা নিয়ে চুপ করে থাকা অপরাধ। আমরা যতক্ষণ নিজেদের সাথে এমন সমস্যা ঘটছে না ততক্ষণ অব্দি যেহেতু মুখ খুলছি না সেহেতু আমার সাথে ঘটে যাওয়া এমন একটি ঘটনার জের ধরে কিছু বিষয় সবাইকে জানানো আমার দায়িত্ব।

১লা সেপ্টেম্বর, ২০২০, মঙ্গলবার। সারারাত ঘুমাইনি, ভোর ৪ টায় ঘুমিয়েছিলাম।  ১২টায় উঠে যাই।  স্বাভাবিকভাবে মোবাইলে হাত দিয়ে আমার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। স্বভাবে অস্থিরতার কারণেই আমি এমন। মোবাইলে দুটো মেসেজ আসে। একটি ১০.৫০ মিনিটে যা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দেয় ভেরিফিকেশন নাম্বার আর দ্বিতীয় মেসেজ দেখে আমি অবাক। ১০.৫২ মিনিটে একটি অচেনা নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে আসা সেই ভেরিফিকেশন কোড সম্বলিত একটি মেসেজে লেখা আসে “******* (আমার মোবাইলের গোপন কোড) দিস ইস টেকেন ফর ইউ, বেস্ট অব লাক”। মানে বোঝাই যাচ্ছে কেউ হ্যাক করেছে ফেসবুক এবং আমার পরিচিত বলেই নাম্বারে আমাকে হুমকিস্বরূপ মেসেজ দিয়েছে। আমি দ্রুত সকলের পরামর্শে ৯৯৯ নাম্বারে কল দিয়ে বিষয়টি জানাই। তারা বলে পাশের থানায় গিয়ে যোগাযোগ করুন। আমি খেয়াল করলাম এই অচেনা নাম্বার থেকে এর আগেও কিছু বিরামচিহ্ন সম্বলিত মেসেজ আসে এবং যা আমি খেয়াল করিনি, যেহেতু অনেক আগে থেকেই আমাকে অনেক নাম্বার থেকে বিরক্ত করতো আমি পাত্তা না দিয়ে ব্লক করে দিতাম। ব্যস্ততার কারণে এই নাম্বার ব্লক করা হয়নি। সব মেসেজের স্ক্রিনশট এবং প্রমাণ সব কিছু নিয়ে পাশের থানায় গিয়েছিলা। এর ভিতরেই আমি ফেসবুকে ঢুকে দেখি অথেনটিকেশনের জন্যে এখনো ফেসবুকে ঢুকে কিছু করতে পারেনি, আমি সমস্ত সিকিউরিটি নিশ্চিত করে দিলাম। মূলত আমার নাম্বার সিক্রোনাইস করার প্রয়াস তারা করেছে।

এরপর থানায় গেলাম। এক মহিলা আপা ছিলেন, দেখে খুশি হলাম আপাকে সহজে বোঝানো যাবে। সেই আপা সমস্ত ঘটনা শুনে আমাকে বললেন তুমি সব কথা আবেদন আকারে লিখে প্রিন্ট করে প্রমাণসহ আসো। যদিও থানাতেই লেখার ব্যবস্থা থাকে তাও আশেপাশে দোকান না পেয়ে অনেক ঝামেলা করে সব নিয়ে আসলাম। কিন্তু আমি এত অবাক হব ভাবিনি। কেননা থানায় থাকা কর্মকর্তা আমাকে অবাক করার মত কিছু কাজ করেন। সব কিছু নিয়ে এসে তারপর  তিনি জিজ্ঞেস করা শুরু করলেন, তুমি একলা কেন আসছো, তোমার মা বাপ নাই? কীসে পড়? এত ছোট মেয়ে ফেসবুক চালানোর কী দরকার? নাম্বার বদলায় ফেলো। আমি বিনয়ের সুরে বললাম, আমার বোন আসছে সাথে, সে মাস্টার্স শেষ করে এখন কলেজে গণিত পড়ায়, বিবাহিত। আম্মা অসুস্থ, আব্বা নাই, ৬ বোন ২ ভাই। এত সব শুনেও উনি আমাকে এক বাক্যে বাসায় চলে যেতে বললেন। আমি বুঝিয়ে বললাম দেখুন আমার প্রাইভেসি নিয়ে ভয়ে আছি, আমার ব্যক্তিগত ছবি এবং লেখাসহ বিভিন্ন কিছু আছে, তবে কিছু না থাকলেও আমার প্রাপ্য আমি এই সাইবার সুবিধা পাব। আপনি সাধারণ জিডি নেন। তিনি জোর করেই আমাদেরকে বের করে দিতে চাইলেন।

পরে আমরা বাসায় এসে ৯৯৯ নাম্বারে কল দিলে আমাদের বলে, ওসিকে বলেন। পরে আরো দুই দাদাসহ আমরা সেখানে প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছি, তবে আমার বোন, দাদার পরিচিত ছিল বলেই সহজে কাজ সেরে জিডি করে বাসায় এসেছি। এত সব কিছুর পরে অবাক লাগে মহিলা তাও বলছেন আমার এত নিরাপত্তার কী দরকার! আমি রেগে চুপ থেকে চলে আসি।

সাইবার ক্রাইম যেহেতু এটা স্পষ্ট আর এর আগেও হয়েছে, ভিক্টিম হিসেবে আমার প্রাপ্য আমাকে দেওয়া উচিত। অবশ্যই আমাদের জানতে হবে সাইবার ক্রাইম কী। আমরা অজ্ঞ থাকলে আমাদের সমস্যা থেকে আমাদেরকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। আমার কাছে সহজ হিসাব আমার ঘরে দরজা দিয়ে কেউ বিনা অনুমতিতে ঢুকতে চাইলে বা  জোর করে ঢুকলে তা অপরাধ। আমাদের অবশ্যই প্রতিবাদ করা উচিত। প্রথমে ভেবেছিলাম আমি এই প্রতিবাদ করব না পরে ভাবলাম আমার মত অনেকেই চুপ থেকে সহ্য করে, পরে বড় সমস্যা হলে তা সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যান। যেহেতু সাইবার ক্রাইম অপরাধ এবং এর জন্যে দণ্ডবিধি আছে তাই আমাদেরকে সচেতন, সাহসী হতে হবে। সাইবার ক্রাইম অপরাধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ ( ২০১৩ সংশোধিত)‘র ধারা অনুযায়ী কম্পিউটার, সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন, ভাইরাস ছড়ানো, ইমেইল পাঠানো (প্রবেশ,অনধিকার চর্চা) ইত্যাদির জন্যে বাংলাদেশে ১৪ বছর কারাদণ্ড, সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে অন্যের যেকোনো ডিজিটাল মাধ্যমে অনধিকার চর্চা, অনুমতি ছাড়া প্রবেশ ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সমস্ত বিষয়ে যদি মহিলার সেই আচরণকে দায়ী করেন তাহলে অবশ্যই তাদের এই আচরণ কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি দ্বিতীবার গিয়েছি কারণ আমার পরিচিতি মহল সে সাহস আমার ভিতর জুগিয়েছে, কিন্তু অন্য অনেকেই ফিরে এসে এসব ঝামেলায় যেতে চাইবে না। খারাপ লাগে যখন একজন মহিলা কর্মকর্তাই বলে, ‘ভালো মানুষ থানায় আসে না।’ আমি অপরাধী নই, ভিক্টিম ব্লেইমিং খুব বাজে বিষয়। প্রমাণ ছাড়া ভিক্টিম ব্লেইমিং উচিত নয়। আমরা সচেতন হলেই অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি তারা পাবে, এসব বিষয়ে বিন্দুর জল সিন্ধু না হয়ে আমরাই শান্তিতে থাকতে পারব।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]