কুলসুমের মৃত্যুতে আপনাদের কি মাথা নত হয়না?
ইমতিয়াজ মাহমুদ।। মুনমুন আমাকে খবরের লিঙ্কটা পাঠানোর পর থেকে অস্বস্তিতে স্থির হয়ে বসতে পারছি না। চৌদ্দ বছরের একটা শিশু, উম্মে কুলসুম, সৌদি আরবে গিয়েছিল কাজ করে কিছু টাকা পয়সা কামানোর আশায়। গৃহকর্মীর কাজ। ওর লাশ ফিরেছে তিন চারদিন আগে। ওর দুই হাঁটু ভাঙা, পা ভাঙা, কোমর ভাঙা আর চোখে ক্ষত। ছোট্ট ফুটফুটে সুস্থ স্বাভাবিক যে বাচ্চাটা গিয়েছিল, শয়তানগুলি ওর ছোট দেহটার উপর এইসব অত্যাচার করেছে তারপর ওকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। না, রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া কথাটা প্রতীকী অর্থে না, একদম আক্ষরিক অর্থেই এই কাজটা করেছে ওরা। রাস্তায় ফেলে দেওয়ার আগে ওর চোখও নষ্ট করে দিয়েছে। যে বাড়ীতে কুলসুম কাজ করতে গিয়েছিল সেই বাড়ীর লোকটা আর তার ছেলে মিলে এইসব করেছে। আর কী কী অত্যাচার করেছে সেগুলি বললাম না, আপনারা জানেন। না চাইলেও মাথায় আমার ঘুরে ঘুরে আসছে ওর ছবিটা। ঘন মিতা ভুরুর নিচে বড় বড় দুইটা চোখ। মাথা ঘাড় সব ঢেকে একটা হিজাব পরেছে। সহজ সরল চেহারা।
এই রকম ঘটনা যে এই প্রথম ঘটেছে সেটা তো নয়। নিয়মিতই তো আমরা এই রকমের খবর দেখি। আমাদের মেয়েরা দারিদ্র থেকে মুক্তি পাবে বলে মানুষের বাড়ীতে কাজ করতে যায় সৌদি আরবে। যাওয়ার পর ওদের উপর চলে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, মারধোর আরও নানারকম অত্যাচার। কুলসুমই প্রথম নয়, এর আগে অনেক অনেক নারী একইভাবে ফিরেছে- কেউ লাশ হয়ে ফিরেছে, কেউ মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফিরেছে, কেউ শারীরিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে ফিরেছে। আমরা টেলিভিশনে সেইসব কবর দেখেছি, নির্যাতিত অসহায় সেইসব নারীদের কথাও শুনেছি। পরে একসময় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি- যে এইটা চলতেই থাকবে, যেন এইটাই স্বাভাবিক। যেন এইটাই স্বাভাবিক যে আমরা আমাদের নারীদেরকে পাঠাবো সৌদি আরবে, ওরা সেখানে ধর্ষিতা হবে, অপমানিত লাঞ্ছিত নির্যাতিত হবে আর সেইসবের বিনিময়ে আমরা কিছু বৈদেশিক মুদ্রা পাবো। কিন্তু এইটা তো একটা জাতির জন্যে এরকম স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।
আমার দেশের একজন নাগরিক যদি কোন অপরাধের শিকার হয় বিদেশে, তাইলে আমাদের কাজ কি? আমাদের সরকারের কাজ হচ্ছে দেখা যে সেই দেশের আইনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, সেখানকার পুলিশ ঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা। প্রয়োজনে আমাদের রাষ্ট্রদূত সেখানকার সরকারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করবে, তাগাদা দেবে, চাপ দেবে- অপরাধ হয়েছে, বিচার কর। আমাদের মেয়েদের সাথে যেসব আচরণ হচ্ছে, সেগুলি তো আমাদের আইনে অপরাধ বটেই, আমি নিশ্চিত যে সৌদি আরবের আইনেও এইসব অপরাধ হিসাবেই বিবেচিত হবে। সৌদি আরবে এইসব ঘটনা নিয়ে কি মামলা হয়েছে? হলে সেগুলি মামলার পরিণতি কী হয়েছে? না হলে কেন হয়নি? পুলিশ কি কোন পদক্ষেপ নিয়েছে? কী পদক্ষেপ নিয়েছে? আমাদের দূতাবাস নিশ্চয়ই এইসব ঘটনার রিপোর্ট পাঠিয়েছে দেশে, কী পাঠিয়েছে?
আর যেসব রিক্রুটিং এজেন্টরা নারীদেরকে সেখানে পাঠায়, ওরা কী করে? এই যে বাচ্চাটাকে পাঠিয়েছে সৌদি আরবে, ওর তো সেখানে যাওয়ার কথা না। চৌদ্দ বছরের মেয়ে সে তো আইনগতভাবে চাকরি করার জন্যে যোগ্য না। সে নিজের ইচ্ছায়ও চাকরি নিয়ে যেতে পারবে না- কেননা সেই সম্মতি দেওয়ার অধিকারও তো ওর নাই। যারা ওকে পাঠিয়েছে, ওরা নিশ্চয়ই ওর বয়স লুকিয়ে পাঠিয়েছে। এইটা তো রিক্রুটমেন্ট নয়- এটা তো নারী পাচার হয়েছে। কুলসুমকে যারা সৌদি আরবে পাঠিয়েছে ওরা নারী পাচার করেছে- অবৈধ কাজ, আইনতও অপরাধ করেছে। সেই রিক্রুটিং এজেন্টের নাম নিবন্ধন নাম্বার এইসবও দেখলাম দেওয়া আছে বাংলা ট্রিবিউনের খবরে। সেই রিক্রুটিং এজেন্টকে কি ধরা হয়েছে? ওর বিরুদ্ধে নারী পাচারের মামলা হয়েছে? ওদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে? না হয়ে থাকলে কেন হয়নি?
শোনেন, জাতি হিসাবে বড় হতে হলে আত্মমর্যাদা থাকতে হয়। যে জাতির আত্মমর্যাদা নেই সেই জাতি তো প্রকৃত অর্থে স্বাধীন জাতিই নয়। ন্যুনতম আত্মমর্যাদা যদি আমাদের থাকতো, তাইলে আমরা আজকে সৌদি আরবের টুঁটি টিপে ধরতাম। না, আক্ষরিকভাবে হয়তো নয়, কিন্তু কুটনৈতিকভাবে তো আমরা ওদেরকে ধরতেই পারি আরকি। আমাদের দূতাবাস কেন সেখানে তোলপাড় করে ফেলছে না? কেন ওদের সরকারের কাছ দাবি জানাচ্ছে না যে অপরাধীগুলির শাস্তির বিধান করতে হবে? আর আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই বা কেন সৌদি আরবের দূতদের ডেকে নিয়ে গিয়ে জানতে চাচ্ছে না যে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আমাদের সরকার থেকে তো আমি কোন স্পষ্ট বক্তব্য শুনলাম না যে এইসব অপরাধ যারা করেছে আমাদের মেয়েদের বিরুদ্ধে ওদেরকে আমরা ছাড়বো না।
কেউ কেউ বলেছে যে সৌদি আরবের শক্তি বেশি, ওদের টাকা বেশি ইত্যাদি। ওরে ভাই, ওদের শক্তি কত বেশি? ওরা কি বোমা মেরে আমাদেরকে উড়িয়ে দেবে? আরে নিজেরাই তো থাকে আমেরিকার সৈন্যদের পাহারায়। ওদের আবার কীসের শক্তি? আর নাহয় হলোই ওদের শক্তি বেশি, টাকা বেশি? তাতে কী হয়েছে? আমাদের মেয়েদের সাথে অত্যাচার হয়েছে আমরা সেটার বিচার চাইব না? আমরা যদি শক্ত করে বিচারটা চাই, ওদেরকে তো জবাব দিতে হবে, পদক্ষেপ একটা নিতে হবে, আমাদেরকে জানাতে হবে। আমরা যদি বিচারই না চাই, আমরা যদি প্রতিবাদটাই না করি, তাইলে কিভাবে কী হবে?
আর শুধু সরকারের কথা কেন বলছি। আমাদের দেশের যে কোটি কোটি বীরপুরুষ আছেন, কথায় কথায় হুঙ্কার দিয়ে উঠেন নারীকে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেবেন না, নারীরা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গেলে সেটা নাকি হারাম হয়, অফিসে গিয়ে নারীরা নাকি জ্বেনা করে, নারীরা হাঁটে বাজারে যেতে পারবে না, ঘুরে বেড়াতে পারবে না- এইসব জনাবেরা কই! সৌদি আরবেই তো এইরকম কয়েক লক্ষ বীরপুরুষ আছেন যারা নাকি যে কোন মুহূর্তে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। মাঝে মাঝেই দেখি ওরা ফেসবুকে বা নানারকম হুঙ্কার দেয়, ঈমান রক্ষার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেবে ইত্যাদি। ওরে, তোদের মেয়েকে ওরা ঘরের মধ্যে আটকে রেখে নির্যাতন করছে, ওর হাত ভেঙে দিচ্ছে, পা ভেঙে দিচ্ছে, ওর চোখ উপড়ে ফেলছে- তোর বোনের সারা গায়ে নানারকম আঘাত আর ক্ষতের চিহ্ন হে বীরপুরুষ- তোরা কী করিস! তোরা তো ঐখানেই থাকিস, আশপাশেই থাকিস।
এমনকি দেশেও। এই যে আজকে কুলসুমের লাশ এসেছে, এর আগে কত নারীর লাশ এসেছে সেখান থেকে, কত নারী জিন্দা লাশ হয়ে ফিরেছেন- আমাদের দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলি এরা সেইভাবে প্রতিবাদ করে না। সকলে মিলে চাপ সৃষ্টি করলে তো সরকার একটা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতো, হয়তো সৌদি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতো। কয়েকজনের বিচার হলে কয়েকজনের শাস্তি হলে তাইলে নারীর উপর এই অত্যাচারটা কিছুটা হলেও কমতো। এইখানে আমরাও কিছু বলি না, সরকার কিছু বলে না, দূতাবাসের লোকজনও চুপচাপ লাশটা নিয়ে দেশে আনিয়ে দেয় আর কয় টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে সেইটা নিয়ে আলাপ আলোচনা ইত্যাদি করে। তাইলে ওইসব নিপীড়কদের মনে আমরা কী সংকেত দিচ্ছি? আমরা তো সংকেত দিচ্ছি যে ইটস ওকে টু রেইপ আ বাংলাদেশি গার্ল অর টু টর্চার হার- ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলেই হবে।
আমাদের সরকার, আমাদের রিক্রুটিং এজেন্টগুলি, আমাদের ডিপ্লোমেটরা, আমাদের রাজনীতিবিদ- আপনাদের শরম লাগে না? কুলসুমের মৃত্যুতে আপনাদের মাথা নত হয়না? একটা শিশু যার স্কুলে থাকার কথা, পড়াশুনা করার কথা, খেলাধুলা করার কথা- কয়টা পয়সার বিনিময়ে তাকে আপনারা পাঠিয়েছেন ঐসব বর্বর আরবগুলির ঘরে। আপনারা জানতেন না ওর সাথে কী হতে পারে? জেনেশুনেই তো পাঠিয়েছেন? কোন প্রতিকারের ব্যাবস্থা করেননি। আপনার সকলে মিলে আমাদের এই মেয়েটাকে বিক্রি করেছেন- আপনাদের লজ্জা হয় না? আরে, জঙ্গলে সবচেয়ে শক্তিশালী পশুটাও যদি আক্রমণ করে, শক্তিহীন ছোট পাখিটাও তো ঠেকাতে চেষ্টা করে, আর কিছু না পারুক অবিরাম চিৎকার তো করতে পারে। আমাদের মেয়েদের উপর ক্রমাগত এই অত্যাচারটা হচ্ছে, সরকার আপনি আমাদের মা আপনি আমাদের বাপ, আপনি কী করেন?
রাগের কথা দুঃখের কথা কষ্টের কথা না হয় একপাশে রাখলাম। শুদ্ধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচারেও যদি বিবেচনা করেন, তাইলে এইগুলিকে কিসের চিহ্ন বলবেন আপনারা? আমাদের রাষ্ট্রের ব্যর্থতার চিহ্ন নয়? অত্যাচার হতে পারে সেই সম্ভাবনা জেনেও একটা মেয়ে কেন এইসব দেশে যায় কাজ করতে? আপনি কি জানেন যে ইতালিতে সেখানকার শ্বেতাঙ্গ ছেলেদের একটা মজার খেলা হচ্ছে বাংলা ব্যাশিং। খেলাটা আর কিছু না, রাস্তাঘাটে বাঙালি দেখলে কোন কারণ ছাড়াই ওকে মারধোর করা। মাঝে মাঝেই আপনি দেখবেন যে চার পাঁচজন কম বয়সী ইতালীয় ছেলে মিলে একটা বাঙালিকে পিটাচ্ছে আর হাসছে। কী ব্যাপার? কী হয়েছে? না এমনিই মজা করছি। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লোকেরা এটা সহ্য করে, পুলিশের কাছে যায়না- এইসব সহ্য করেই ওখানে থেকে যায়। এইসবগুলি কীসের লক্ষণ? এইসবের মান কী?
এইসবের মানে খুবই সরল। আমরা আমাদের তরুণদের জন্যে কিসসু করতে পারিনি। প্রথমত, ওদের জন্য কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারিনি, ওদের জন্যে কোন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, ওদেরকে সেইভাবে শিক্ষিত বা দক্ষ করতে পারিনি যে ওরা নিজেদের জন্যে কাজ তৈরি করবে বা বিদেশে গেলেও অন্তত দক্ষ শ্রমিক হিসাবে যাবে, আর তৃতীয়ত, ওদেরকে চেতনাগতভাবেও হীনমন্য স্বার্থপর ভিখিরির মতে করে ফেলেছি। এইগুলি হচ্ছে রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা। এদেশের মানুষ এইটা হয় উপলব্ধি করে না, অথবা করলেও ভুলে থাকতে চায়। মাঝে মাঝে এইরকম একটা দুইটা কুলসুম এসে আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র হিসাবে আমরা এতোই ব্যর্থ যে আমাদের একটা কিশোরী বাচ্চাকে আমরা রক্ষা তো করতেই পারলাম না, ওর জন্যে বিচার চাইতে পারলাম না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]