September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

আমি পুরুষ এবং একজন নারীবাদী, কারণ…

মাহমুদুল হাসান উৎস।। নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ চলছে। চতুর্থ ধাপে থাকার পরও নারীবাদ কেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, নারীর অধিকার কেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? এই সময়টাতে নারীবাদ হবার কথা ছিলো অনেক বেশি ডেভেলপড এবং তার গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথা ছিল অসীম। কিন্তু আমরা দেখছি, সামাজিকভাবে পুরোপুরি বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছে।

এক সময় পর্দা না করার জন্যে ধর্ষণের কথা বলা হলেও দেখা গিয়েছে বোরকা হিজাব পরা নারীরাও রেপ হয়েছে। এই তালিকা থেকে বাদ যায় না শিশুও। একটা শিশু কী রকম পর্দা করবে? নারী শিশুর কথা থাকুক, ছেলে শিশুর কথা বলি। লেবাসধারীরা সমকাম’কে হারাম ট্যাগ দিলেও শিশুকাম এ তাদের অসুবিধা হয় না। যদিও, সমকাম বা শিশুকাম সম্পূর্ণ আলাদা দুটো বিষয়। শুধুমাত্র সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটি’তে মিল থাকার কারণে এই উদাহরণ টেনে আনছি। একটা শিশু কনসেন্ট বা সম্মতি দেবার মতো ম্যাচিউরড হয় না। তারপর একটা শিশু ধর্ষণের পরও যারা পর্দা পর্দা বলে চিল্লায়, তারাও ভয়াবহ নারীবিদ্বেষী, পটেনশিয়াল রেপিস্ট। এই পটেনশিয়াল রেপিস্ট’রা আমাদের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। এদের মাথা ভর্তি শুধু বিকৃত যৌনাচার। এরা নারীকে মানুষ ভাবতে পারে না। এদের জীবন ব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থা নারীকে প্রতিনিয়ত অবজেক্টিফাই করে।

আপনার মেয়েকে ঘর থেকে বেরুতে নিষেধ না করে, আপনার ছেলেকে মানুষ হবার শিক্ষা দিন। শিক্ষা দিন ভালোবাসার। ভালোবাসলে নারীর থেকে অনেক কিছু পাওয়া যায়। নারীবাদী হতে না পারেন, নারীবিদ্বেষী হচ্ছেন কেন? আমি একজন পুরুষ, এবং একজন নারীবাদী। আমার মা আছে, বোন আছে। তাদের অধিকার নিশ্চিতকরণ, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রেও আমার দায়িত্ব আছে। আমার মা-বোন যদি রাস্তায় একা হাঁটতে না পারে, ব্যবসা, রাজনীতি, চাকুরি করতে না পারে তাহলে সমাজের উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসে তার দায় আমার উপরও বর্তায়। এজন্য নারীবাদী হওয়া আমার, আপনার কর্তব্য। আমাকে কেউ বলে কয়ে নারীবাদ শেখায় নাই। আমিই নিজেই যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু পড়াশোনা করেছি। নারীবিদ্বেষীদের একটা কমন ডায়লগ হলো নারীবাদী ছেলেরা নারীবাদী হয় মেয়েদের সাথে শোবার জন্যে, সেক্সুয়াল রিলেশন করতে। কেন ভাই? আপনি তো অনারীবাদী বা নারীবিদ্বেষী। আপনি কি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকেন? মাথার মধ্যে বিকৃত যৌনাচার নিয়ে মানুষ হওয়া যায় না।

নারীবাদ শুরু হয়েছিল নারীদের ভোটের অধিকার, সম্পত্তিতে সমানাধিকার নিশ্চিতকরণে। এরপর, নারী পুরুষ সমানাধিকার, মতামতের সমান গুরুত্ব নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। যখন নারীবাদের ফোর্থ ওয়েভ শুরু হলো তখন থেকেই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো সাইবার বুলিং। অনলাইন নিউজ পোর্টাল কিংবা সেলিব্রেটিদের কমেন্ট বক্স চেক করলেই এসব ভয়াবহ নারীবিদ্বেষী, সভ্যতাবিদ্বেষী অসভ্য লোকেদের মানসিকতা সম্পর্কে জ্ঞাত হবেন। এরা প্রকাশ্যে আক্রমণ করছে নারীদের, শিশুদের, সভ্য মানুষদের। এখন নতুন করে নারীবাদকে আক্রমণ করার নতুন হাতিয়ার হয়েছে বেগম রোকেয়া। রোকেয়ার ঘোমটা দেয়া, মাথায় কাপড় দেয়া ছবি দেখে মনে করে, রোকেয়া পরম ধার্মিক এবং পর্দানশীল ছিলেন। যারা রোকেয়াকে ধার্মিক এবং সহী নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তারা আদতে এক একটা বোকা এবং মূর্খ। এরা না পড়েছে রোকেয়া’কে, না পড়েছে তসলিমা’কে। আমাদের এই বঙ্গদেশের সাথে নারীবাদের পরিচয় করিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া, আর নারীবাদের অ্যাপ্লিকেশন শিখিয়েছেন তসলিমা। রোকেয়া নিশ্চিত করেছিলেন নারীশিক্ষা, তসলিমা সচেতন করেছেন সম অধিকার আদায়।

ইদানীংকালে মুসলিম নারীবাদ নামে একটা নতুন টার্ম নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। মুসলিম নারীবাদীরা চাচ্ছেন যেভাবেই হোক ধর্মকে নারীর প্রতি সহনশীল করে তুলতে। বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর বা কৌতুক বলে মনে হতে পারে। কারণ ধর্মে নারীবাদ বা নারীর অধিকার কী করে যায়? বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা হিসেবে তাফসীর’কে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। অনেক মুসলিম নারীবাদী চাচ্ছেন এইসব তাফসীরকে বাতিল করে দিতে। তাফসীর থেকে মিসোজিনিস্টিক বর্ণনা বাদ দিয়ে ধর্মকে নারীর জন্য অধিকতর সহনশীল করে তোলা। মিসোজিনিস্টিক বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু তাফসীর নয় বরং মূল গ্রন্থে যেসব কথাবার্তা বা নিয়মকানুন নারীর প্রতি দৃষ্টিকটু সেগুলো তৎকালীন সময় দিয়ে বিবেচনা করা হবে। এবং পুরো ধর্মীয় সমাজব্যবস্থা নারীর জন্য অধিকতর সহনশীল এবং গ্রহনযোগ্য করা হবে। মুসলিম নারীবাদীদের এই চেষ্টা কতোটা কার্যকর হবে সেটা সময় বলবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মৌলবাদ। সেখানে ধর্মকে রিফর্মেশন করাটা অনেক কঠিন কাজ। এর আগেও হিন্দু ধর্ম রিফর্মেশন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি। এখন দেখতে হবে মুসলিম নারীবাদীরা কতোটা এগোতে পারে।

নারীবাদের লক্ষ্য নারী পুরুষ সমতা। নারীকে পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা নারীবাদের কাজ না। মানবতাবাদ একাই সামাজিক সাম্য আনতে পারেনি। নারীকে নিজেদেরই ভোটাধিকার, সম্পত্তিতে সমান অধিকার ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। এখনও বৃহত্তরভাবে সকল প্রকার আগ্রাসন রোধ করে নারী পুরুষ সমতা আনতে নারীবাদের বিকল্প নেই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]