মিছিলের সেলফি ও ‘আব্বাগো’ আর্তচিৎকারের ভিডিও- কে বেশি শক্তিশালী?
উম্মে সালমা।। তাহাররুশ- শব্দটি পরিচিত মনে হচ্ছে? এর আভিধানিক অর্থ অত্যাচার। আর এই অত্যাচারের শিকার ছিল মিশরের নারীরা, কেবল নারীরাই। প্রকাশ্য দিবালোকে, মুখর জনারণ্যে হেঁটে চলা কোনো নারীর উপর অকস্মাৎ শুরু হলো অমানবিক যৌন অত্যাচার। অর্ধশতাধিক হিংস্র পুরুষ ঘিরে ধরলো তাকে। কেউ কাপড় ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে, কেউ টেনে নামিয়ে দিচ্ছে, শরীরের নানা যায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কারোর হাত। তাকে উদ্ধার করতে করতে সময় গেল প্রায় আধ ঘণ্টা, যতখানি অপমান-মানসিক যাতনা পাবার, ততক্ষণে হয়ে গেছে। মিশরের এমন অসংখ্য ঘটনার মতো হুবুহু আরো একটি ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে, পহেলা বৈশাখের লাখো মানুষের ভিড়ে। এমন বলা-না বলা-গোপন-প্রকাশ্য হাজারো ঘটনা রয়েছে এই এখানেই, আমারই দেশে।
গত ৪ অক্টোবর ২০২০ সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওচিত্রে একজন নারীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে মধ্যযুগীয় কায়দায় তার উপর নৃশংস বর্বরতা চালানো হচ্ছে। তার আগে বা পরে কি হয়েছিল তা আমার কল্পনার অতীত। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যায় ঘটনাটি ঘটেছে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে, সামাজিক মাধ্যমে আলোচনায় আসার ৩২ দিন আগে । গত দুই সেপ্টেম্বর রাতে একদল দূর্বৃত্ত ঘরে ঢুকে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন গণধর্ষণ করে এবং মোবাইল ফোনে সেই নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তারা। নির্যাতনের পর সেই নারী ও তার পরিবারকে নানা ধরণের হুমকি ও ভয় দেখিয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
এই ৩২ দিনে পাড়া প্রতিবেশী, কেউ এ নিয়ে একবিন্দু কথা বলেননি, কথা তোলেননি।
গত একমাস ধরে নিপীড়করা ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলে তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। এই অনৈতিক প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলে মুহূর্তের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
এগুলো সংবাদমাধ্যমের কথা। একজন নারী হিসেবে আমার প্রশ্ন একজন নারীর সাথে এহেন আচরনের মোটিফ কী? একজন নারীকে এভাবে নিপীড়ন করা, তার ভিডিও ধারণ করা, সেটা প্রকাশ করে দেবে বলে হুমকি দেয়া, শেষমেষ প্রকাশ করে দেয়া- এইসবের আল্টিমেট উদ্দেশ্য কী? ঠিক কী বিষয়টি নিপীড়কদের এমন কাজে ট্রিগার করে? পুলিশী তৎপরতায় সেই নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং চারজনকে আটকও করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্ণোগ্রাফি আইনে দুটি মামলা করা হলেও মামলার এজাহারে প্রধান অভিযুক্তের নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং ঘটনার বর্ণনা এগিয়েছে ‘ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থতা’র সূত্র ধরে।
বলিউডের একটি সিনেমা দেখেছিলাম, আর্টিকেল ফিফটিন। তিন টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলার প্রেক্ষিতে দলিত সম্প্রদায়ের দুজন কিশোরীকে ধর্ষন করে গাছে তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। লাশগুলো গুম করে ফেলা যেত, কেউ হয়তো কোনোদিন খোঁজই পেত না। কিন্তু লাশগুলো গাছে ঝুলিয়ে রেখে দলিত সম্প্রদায়ের বাকি মানুষদের এই মেসেজটি দেয়া হয়েছে যেন এদের মতোন আর কেউ কখনো প্রতিবাদের আওয়াজ না তোলে।
গতকাল ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা এই ভিডিওকে আমি একই উদ্দেশ্যে স্থির বলে মনে করি। জাতপাত বিভক্ত ভারতে এই জাতিগত বিভাজন স্মরণ করিয়ে দিতে যেমন আর্টিকেল ফিফটিনে দুটো লাশ ঝুলেছিল, মিশরে নারীদের যেমন বিকৃত কামলিপ্সার শিকার হতে হয়েছিল যেন সকল নারী ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতে ভয় পায়, তেমনি এই ভিডিও আমাদের দুটো বিষয়ে স্পষ্ট মেসেজ দেয়।
প্রথমত নারীর যৌনাঙ্গে আঘাত করে তাকে মাটিতে মিশিয়ে দেখা সম্ভব, এই মধ্যযুগীয় মানসিকতা, দ্বিতীয়ত, ভিডিওতে নিপীড়কের স্পষ্ট চেহারা থাকলেও মানুষ কেবল সেই নিপীড়কদের বারবার ‘আব্বাগো’ বলে মুক্তি চাওয়া সেই নারীকেই দেখবেন এবং বাকিরা কারোর ছত্রছায়ায় হোক যে কোনোভাবেই হোক পার পেয়ে যাবেন। আর এই পার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয় ৩২ দিনের নীরবতা এবং মামলার এজাহারে মূল অপরাধীর নামের অনুপস্থিতি দেখেই। ইতোমধ্যে হাইকোর্টে রুল জারি হয়েছে। প্রশাসন তৎপর হয়েছেন। চারজন ধরা পড়েছেন, বাকিরাও হয়ত ধরা পড়বে অচিরেই।
কিন্তু ঠিক কতটি ঘটনা এমন আলোচনায় আসবে? যা আসবেনা তা কি অন্তরালেই থেকে যাবে? পরিসংখ্যান বলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে সাজা মাত্র তিন শতাংশ। অন্য একটি পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন, এতো গেলো সংবাদমাধ্যমে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে, যারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেননি, যারা এই ৩২ দিনের মতো বছরের পর বছর নীরব থেকেছেন, তাদের হিসেব কই? ধর্ষকের বিচার চেয়ে আসছি, কিন্তু এই বিকৃত কামাসক্তি, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, ভিক্টিমের ব্লেইমিং এর প্রবণতা দূর করতে যার যার অবস্থানে থেকে কাজ করছি তো?
আমরা ধর্ষণকে সংখ্যা বানিয়ে ফেলেছি। একটা ধর্ষণ একটা পরিবার, অনেক অনেক স্বপ্নের ভাঙচুর। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার এই ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ, আজ উত্তাল ছিল সমগ্র নোয়াখালী। মানবন্ধন, মিছিল, সমাবেশে অনেককেই দেখেছি নিজেদের সেলফি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা আপলোড করতে। আমি একে নেতিবাচক হিসেবে দেখছিনা।
কিন্তু আমি আছি- হাজার মানুষের এই জানান দেয়ার সাথে সেই ‘আব্বাগো’ আর্তচিৎকারের ভিডিওর টক্করে, ছবির পেছনের মানুষগুলো কার চেয়ে কে বেশি শক্তিশালী অবস্থানে আছেন প্রকৃত অর্থে, এই মুহূর্তে, নারীর সাথে হয়ে আসা এই বর্বর এবং ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সেই প্রশ্ন রাখলাম।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]