স্ব-স্টেরিওটাইপিং: নারী যখন নিজেই পুরুষতন্ত্রকে সমর্থণ দেয়
সুচরিতা মাজির লেখা Self-Stereotyping: When Women Justify Being Oppressed By A Patriarchal System শিরোনামের এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় Feminism in India তে। সুচরিতা কানপুরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে একজন পিএইচডি গবেষক। সুচরিতার এই প্রবন্ধটি ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন রুবিনা আক্তার। রুবিনা আক্তার বর্তমানে কক্সবাজারে UN Refugee Agency’তে Sexual and Gender based Violence Unit এ কর্মরত আছেন।
স্ব-স্টেরিওটাইপিং: পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারী নিজেই যখন তার অবস্থাকে সমর্থন দেয়– জেন্ডার মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ।
মোনা বলল, “বলে রাখছি আমি কিন্তু নারীবাদী-ঘরনার না”। আমরা এই মোনাদের সবাই চিনি; তাই না? অন্য আরেক দিনের কথা, সকালে কফি খেতে খেতে কর্পোরেট পেশার একজন নারী কর্মকর্তা বলল, “জানি পুরুষেরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়; আমার মতে সেটা ঠিকই আছে। দিন শেষে ঘর তো পুরুষেরাই চালায়”। হ্যাঁ, আমারও ঠিকআপনার মত “মাফ করবেন, কী বলছেন আপনি?” ধরণের চেহারা হয়েছিল। নারী স্ব-স্টেরিওটাইপিং বা নিজেকে নিজে গৎবাঁধা ধারনার শিকলে বেঁধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে যেমন সমর্থন দিচ্ছে, সেই সমাজব্যবস্থাও কোনঠাসা আর নির্যাতন চালিয়েই যাচ্ছে নারীসহ সমাজের অন্য আরো অংশের উপর।
“নারী স্ব-স্টেরিওটাইপিং বা নিজেকে নিজে গৎবাঁধা ধারনার শিকলে বেঁধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে যেমন সমর্থন দিচ্ছে, সেই সমাজব্যবস্থাও কোনঠাসা করে নির্যাতন চালিয়েই যাচ্ছে নারীসহ সমাজের অন্য আরো অংশের উপর”
আমরা বেশির ভাগই যখন জেন্ডার-ভিত্তিক অসম এই বিভাজনের ভুক্তভোগী তবুও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কেন এই বিভাজন এখনো রয়েই গেছে? পুরুষতন্ত্রের হাতে মার খাওয়া প্রত্যেকেই কেন এখনো একসাথে লড়ছে না একটি জেন্ডার সমতার পৃথিবীর জন্য? দিন শেষে আমরা কি তাহলে এই জেন্ডারের অসম বিভাজনকে সমর্থন ও লালন করছি নিজেদের মধ্যে? নাকি আমরা নিজেরাই এই কাঠামোর একটি অস্ত্রে পরিনত হয়েছি ?
সমাজের আউটগ্রুপ সদস্য যেমন ‘উঁচুশ্রেনী’র মানুষের গৎবাঁধা চিন্তা ও তাদের দ্বারা সীমাহীন বৈষম্য বহুলালোচিত। তবে, এই গৎবাঁধা চিন্তার শিকার ও কোনঠাসা হয়ে থাকা ইনগ্রুপ যেমন ‘নিচু শ্রেণি’র সদস্যদের মধ্যে সম্ভাব্য স্ব-স্টেরিওটাইপিং এবং নিজেকে ছোট হিসেবে নিজের মধ্যে লালন করার প্রবণতার উপরও জোর দেয়া জরুরি। এই স্ব-স্টেরেওটাপিং ও নিজেকে ছোট হিসেবে মেনে নেয়ার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই এই বৈষম্যমূলক শ্রেণিবিভাজনকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।
যেমন, লিঙ্গের সাথে সম্পর্কিত পরিচিত একটি চিরাচরিত ধারণা আছে যে নারীরা পুরুষের মত বুদ্ধিদীপ্ত নয়, যা কিনা ধীরে একজন নারীর বিশ্বাসে পরিনত হতে পারে যে সে আসলেই পুরুষের চেয়ে কম বোঝে বা কম মেধার অধিকারী। পরবর্তীতে এই ধারণা রূপান্তরিত হয় নারীর স্বরূপ নির্ধারনে যে কর্মক্ষেত্রে নারীরা স্পষ্টবাদী না, তারা না বুঝে কথা বলে, কিংবা আন্তঃব্যক্তিক [interpersonal] যোগাযোগের ক্ষেত্রে নারীরা আত্মবিশ্বাসী না ইত্যাদি। এরকম নারীদের আমি চিনি যার নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিন্তু চালানোতে আত্মবিশ্বাসী না কিংবা লজ্জার কারনে খুব দরকার না হলে গাড়ি চালায় না। এমনকি এরকম অনেক নারী আছে যারা গাড়ি চালানোর বিষয়টি বিবেচনাই করে না কারণ হাজার বার তারা শুনেছে যে “নারীরা ড্রাইভিং পারবে না” । ফলশ্রুতিতে এই বার্তাটি বিশ্বাসে পরিনত হয়ে গেছে। এই মেনে নেয়া আমাদের জীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে; STEM ( বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত) জ্ঞানের এই শাখাগুলোকে পেশা হিসেবে নেয়া থেকে থেকে শুরু করে নেতৃত্বে দেয়া পর্যন্ত।
মনোবিজ্ঞানী, আর জে ব্রাউন এবং জে সি টার্নার (1981) একাডেমিক বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষন করে স্ব-স্টেরিওটাইপিংয়ের দিকে। স্ব-স্টেরিওটাইপিং হলো বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা কোন ব্যক্তির গোষ্ঠি বা নিজেকে বর্ণনা করার প্রবণতা ।
“নারীদের মধ্যে স্ব-স্টেরিওটাইপিং প্রবণতা কি বেশি তাহলে? নারীদের পিছিয়ে থাকা সামাজিক অবস্থান এই নেতিবাচক গৎবাধা ধারনাগুলোকে লালন করার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও সাধারনত এই প্রবণতাকে মানসিকভাবে লালন প্রক্রিয়াটি নারীদের মধ্যে দীর্ঘ হওয়ার কারনে তা নারীর স্বীয়-সংজ্ঞায় পরিণত হয়েছে”।
নারীদের মধ্যে কি স্ব-স্টেরিওটাইপিং প্রবণতা বেশি তাহলে? হ্যাঁ। নারীদের পিছিয়ে থাকা সামাজিক অবস্থান এই নেতিবাচক গৎবাঁধা ধারনাগুলোকে লালন করার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও সাধারনত এই প্রবণতাকে মানসিকভাবে লালন প্রক্রিয়াটি নারীদের মধ্যে দীর্ঘ হওয়ার কারনে তা নারীর স্বীয়-সংজ্ঞায় পরিণত হয়েছে। এটি ব্যাখ্যা করে নারীরা কেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই [পুরুষের] অধীনে থাকাকে সমর্থন এবং মহিমান্বিত করে- কেন গণিতে সেরা স্কোর করা মেয়েরাও অনেক সময় সংখ্যা এবং বিজ্ঞান ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়; কেনই বা যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা নিজেদেরকে নিয়ে সংশয়ে থাকে। স্ব-স্টেরিওটাইপিং আসলে নিজের কাছে আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অবচেতন মনেই এটি আমাদেরকে আয়নার সামনে দাড় করায় আর এমন দোষ খুঁজতে তাড়িত করে, যে দোষ আসলে আমাদের ছিলই না কখনো । এটি মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে; এ রকমভাবেই, নারীদের পেশাগত অগ্রগতি ও সামগ্রিক জীবনে যেভাবে দরকষাকষি তা ঠিক করে দেয়। এছাড়াও, স্টেরিওটাইপিংয়ের মূল প্রক্রিয়াটি হ’ল এর বিস্তারযোগ্যতা, সুতরাং, যখন আমরা স্ব-স্টেরিওটাইপিং করি, তখন আমরা গৎবাধা ধারনা আর এর সাথে সম্পর্কিত সকল উদ্বেগগুলোকে ছড়িয়ে দেই। এটি পরবর্তীতে আরও বেশি নারীদের পঙ্গু করে তোলে আর বিদ্যমান গৎবাধা ধারনাগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। তখন চিরাচরিত বিশ্বাসের বাইরে কিছু করতে গেলে প্রতিবারই অতিরিক্ত লড়াই প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু কেন নারী (অথবা অন্য যেকোন কোনঠাসা-অবস্থার মানুষেরা তাদের সাথে সম্পর্কিত) নেতিবাচক ধ্যান-ধারনাকে নিজের মধ্যে লালন করে? খুব সহজভাবে বলা যেতে, এটি একটি প্রক্রিয়া যা টিকেই থাকে বিদ্যমান অবস্থা বা কাঠামোকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে। প্রথম যে প্রণোদনাটি আসে তা হয়তো ন্যায্য-পৃথিবীর [just world hypothesis] অনুমান থেকে, যেখানে মানুষ বিশ্বাস করে তারা যে ব্যবস্থায় আছে যা মূলত ন্যায়সিদ্ধ ও সঠিক; অর্থ্যাৎ যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফলাফল পাবে। এই বিশ্বাস মানুষকে তার নিজের অবস্থানে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে এই কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রন করে। সুতরাং, যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে পৃথিবী ন্যায্যই, তবে আপনি একে আরও ভাল’র দিকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে নিজের ঘুম এবং মজা করে খাওয়াটা খোয়াতে চাইবেন না; অথবা তা করতে না পারার কারনে নিজেকে দোষী মনে করবেন না ।
এছাড়াও, সামাজিক শ্রেনীবিন্যাশের নিচের দিকে থাকা সদস্যরা এক ধরনের মনস্ততাত্বিক সংঘর্ষে পড়ে যায়,তাদের গ্রুপের অবস্থা উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা এবং বিদ্যমান সামাজিক শৃঙ্খলা মেনে চলার প্রয়োজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই অবিচ্ছিন্ন অসঙ্গতি মোকাবেলা করার জন্য, একজন ব্যক্তি সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এবং প্রায়শই এটি সমর্থন করে। অবিচ্ছিন্ন উত্তেজনা সহকারে বেঁচে থাকা কোনও আনন্দদায়ক অনুভূতি নয় যদিও স্থিতিশীল ব্যবস্থা পরিবর্তন করাও সহজ নয়, অতএব, তারা সহজ উপায় হিসাবে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে অভ্যন্তরীণ করে তাদের নিম্ন অবস্থানে বিশ্বাস স্থাপন করে।
সুতরাং, এই বিষয়টি এর চেয়ে বেশি জোর দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না যে অন্যরা যখন জেন্ডার-সম্পর্কিত গৎবাঁধাধারনা গুলোকে অনুমোদন দেয় এবং সেগুলোর ভিত্তিতে আমাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে, তখন আমরা স্ব-স্টেরিওটাইপিং না করে বরং এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আমাদেরকে সচেতন হতে হবে যেন গৎবাঁধা বিশ্বাস আর ধারনাকে নিজের মধ্যে লালন না করে তুলি অথবা আরো বেশি সমর্থন না দেই। চেষ্টা করতে পারি যেন নিজেদেরকে চিরাচরিত রুপে কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দলে বেঁধে না ফেলি, কারন আদতে গ্রুপ বৈশিষ্ট্য বলে কিছু নেই [পরিবর্তনশীল] ।
সুচরিতা মাজি’র মূল লেখাটির লিঙ্ক: https://feminisminindia.com/2020/08/13/self-stereotyping-women-bad-drivers-internalised-misogyny/