November 24, 2024
কলামফিচার ২

শক্তিরূপেন সংস্থিতা: নারীশক্তি বন্দনার মনভোলানো সান্ত্বনা

শাশ্বতী বিপ্লব।। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতো দাঁড়িয়ে “মাতৃতান্ত্রিক শক্তির বন্দনার” গল্পটা শুনতে ভালোই লাগে। যদিও বন্দনা জিনিসটাই গোলমেলে। বন্দনা ঘোর তৈরি করে, সত্যি দেখতে বাঁধা দেয়। যখনই আপনি কোন একটি শক্তির বন্দনা মেনে নিবেন, তখনই আপনি আরেকটি শক্তিকে অগ্রাহ্য করলেন। দুইটা পক্ষ তৈরি করলেন এবং একটি পক্ষকে আরেকটি পক্ষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিলেন। দুই পক্ষের বন্দনার ভারসাম্য রক্ষা করাও কঠিন। সবচেয়ে ভালো হতো যদি পিতৃ বা মাতৃতন্ত্র নিরপেক্ষ বন্দনা করা যেতো অথবা কোনরকম বন্দনারই প্রয়োজন না পড়তো।

বলছিলাম, দুর্গাপূজায় মাতৃতান্ত্রিক শক্তির বন্দনা ও নারী শক্তির প্রকাশ দেখতে পাওয়ার কথা। চারদিকে ধর্মগুলো যখন পুরুষ বন্দনায় মত্ত, পুরুষের ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করতে নিবেদিত এবং পুরুষকে প্রধান ধরে আইন-কানুন, বিধি-বিধান দ্বারা নির্মিত, তখন নারীরূপী দেবীর বন্দনা ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহে। নারীর রূপ-গুণ নয় বরং নারীর দুর্গতিনাশিনী যে শক্তির প্রকাশ ঘটে দেবী দুর্গার মাঝে, সেই শক্তির আরাধনা স্বাভাবিক কারণেই মনে জায়গা করে নেয়। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিপরীতে মাতৃতান্ত্রিক বন্দনাকে তাই অনেকে আপন এবং বৈপ্লবিক মনে করেন। শুধু সেই শক্তির বৈশিষ্ট্য ও উৎস খুঁজতে গেলেই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় আমার।

প্রথমত: নারীর এতো রূপ থাকতে ঘুরেফিরে সেই মাতৃ রূপকেই কেন বেছে নেয় ভক্তকূল? কার ইচ্ছায়? দেবী যদি মা না হয়, তবে কী সমস্যা?

দ্বিতীয়ত: মা দুর্গার শক্তির উৎস কী? সেটা কি তার স্বতন্ত্র শক্তি? মহিষাসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে, দুর্গা কি কূপিত হয়েছিলেন? তার নারীশক্তি (!) বা ক্ষমতা নিয়ে অসুর বধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন?
সেই শক্তি কি তিনি নিজের সিদ্ধান্তে ধারণ করেছিলেন?

তৃতীয়ত: দেবী দুর্গার খণ্ডকালীন চরিত্রের জন্য তাকে পূজা করা হয়। সার্বিকভাবে, দেবী দুর্গা নারীর কোন রূপ বা ভূমিকার প্রতিনিধিত্ব করেন? অসুর বধের আগে পরে দেবী দুর্গার ভূমিকা কী? শিবের স্ত্রী হওয়া ব্যতিরেকে দেবী দুর্গার নিজের পরিচয় কী?

আসুন, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

প্রথমত: দেবী দুর্গার অসুরদলনী রূপকে কেন মা ডাকা হয়, সেটা পুরাণের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় না। কারণ, ব্রহ্মা মহিষাসুরকে বর দিয়েছিলেন যে, একমাত্র নারীরূপী দেবীর পক্ষেই তাকে বধ করা সম্ভব হবে, কোন পুরুষ দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না। কাজেই ব্রহ্মার সেই ইচ্ছা বা বরের বাস্তবায়ন করতেই মা দুর্গার আবির্ভাব। দেবতারা নিজেরা বধ করতে পারলে, দুর্গাকে আর প্রয়োজন হতো না। কিন্তু শিব বা অন্য দেবতারা যদি পিতা হিসাবে পূজিত না হন, তবে দেবতাদের সম্মিলিত তেজে তৈরি দুর্গা বা শিবের স্ত্রী হিসাবে দুর্গা কেন মাতা হিসাবে পূজিত হবেন?

দ্বিতীয়ত: দেবী দুর্গার দুর্গতিনাশিনী, সংহারিনী শক্তি দেবীর নিজের নয়। মার্কেণ্ডয় পুরাণ মতে, মহিষাসুরকে পরাস্ত করতে না পেরে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। তখন বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতারা নিজ নিজ তেজ ত্যাগ করে সৃষ্টি করেন মাতৃরূপী মা দুর্গাকে। অনলের তেজে সৃষ্টি হয় ত্রিনয়ন, ইন্দ্রর তেজে কটিদেশ, শিবের তেজে মুখমণ্ডল, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে জোড়া বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন। বরুণ সৃষ্টি করলেন জঙ্ঘা ও উরু। পা সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মা, ইত্যাদি।

শুধু তেজ নয়, তাদের অস্ত্রও দুর্গাকে দিয়েছিলেন দেবতারা। যেমন, শিব দিয়েছিলেন তার ত্রিশূল, ইন্দ্র দিয়েছিলেন ইরাবত, ঘণ্টা আর বজ্র, হিমালয় দিয়েছিলেন সিংহ, বিষ্ণু দিয়েছিলেন চক্র, পবনদেব ধনু, যম দিয়েছিলেন কালদণ্ড ইত্যাদি। এভাবেই দেবীকে সাজিয়ে তুলেছিলেন অসুর বধে। এখানে দুর্গার নিজের শক্তি বা ইচ্ছার যেমন কোন জায়গা নাই, তেমনি নাই কোন কাল্পনিক নারী শক্তির (!) প্রকাশ। মহিষাসুরকে বধের পর শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গা শিবের পায়ে প্রবেশ করেন।

তৃতীয়ত: দেবতাদের শক্তি ধার করে অসুর বধের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়টুকু দেবী দুর্গা দেবতাদের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে আটকে পড়া একজন পতিব্রতা স্ত্রী ও মা। শিবের স্ত্রীর বাইরে তার নিজের কোন পরিচয় বা শক্তিরূপেন ভূমিকা দেখা যায় না।

দেবী প্রথম জন্মে সতী নামে পরিচিত ছিলেন। দুর্গা তার দ্বিতীয় জন্মের পরিচয়। প্রথম জন্মে তিনি ছিলেন দক্ষের কন্যা এবং মহাদেবের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পর, দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন, যেখানে তিনি মহাদেবের নিন্দা করেন। সতী সেই পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ (!) করেন।

এরপর তিনি হিমালয়ের ঔরসে মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। হিমালয় পর্বতের কন্যা বলে দুর্গাকে পার্বতী নামে ডাকা হয়। এরপর তিনি আবার মহাদেবকেই স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য তপস্যা শুরু করেন এবং মহাদেব তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে আবার তাকে বিয়ে করেন। এবং ক্রমে দুই পুত্র কার্তিক আর গণেশকে নিয়ে সংসারধর্ম পালন করতে থাকেন।

পুরুষ দেবতার ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, পুরুষ দেবতাদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে যে অসুর বধ তাতে নারী শক্তি কোথায়? পতির নিন্দা মানতে না পেরে নিজেকে মেরে ফেলাতেই বা নারী শক্তি কোথায়? তপস্যা করে পুরনো স্বামীকে আবার বিয়ে করাতেই বা নারীশক্তি কোথায়? এবং, সবশেষে, যে নারী শক্তির খোঁজ আমরা করছি, সেই নারী শক্তিটাই বা কী?

ধর্মীয় ক্ষমতা কাঠামোতে সমান অংশীদার হওয়ার কথা যদি বোঝানো হয়ে থাকে, তবে দেবতাদের ক্ষমতা কাঠামোতে দেবীর স্বতন্ত্র কোন অংশীদারিত্ব বা স্বাধীন ইচ্ছা কোনটারই খোঁজ পাওয়া যায় না।

সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]