নুরুন নাহারের রক্ত তিরস্কার করছে বাংলাদেশকে, বিচার করুন প্রধানমন্ত্রী
সুমিত বড়ুয়া।।
১. ওরা
সপ্তাহের ছুটির দিন ঘুমাই একটু রাত করে। তাই প্রায়ই হাঁটতে যাই সিউল শহরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হান নদীর দুপাশ দিয়ে মাইলের পর লম্বা পার্কের রাস্তা ধরে। শীতের রাতে কনকনে ঠাণ্ডায় জনসমাগম কিছুটা কম হলেও গরমের দিনগুলোতে পার্কের দুই পাশেই হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। যদিও তা ১০টার পরে হালকা হতে থাকে। এই সময়টাতে বেশিরভাগ মানুষ আসে তাদের রাতের হাঁটা ও শরীরচর্চা সারতে। দক্ষিণ কোরিয়া এমন একটা সুস্বাস্থ্য পাগল-মানুষদের দেশ যে, এদের শরীরচর্চার কোন বাধা সময় নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই দেখা পাওয়া যায় সারা রাত ধরেই হাঁটছে, দৌঁড়ুচ্ছে কিংবা নানা শারীরিক কসরতে। রাত ৩টার পর হাঁটতে গিয়েও যুবতীদের দেখা পেয়েছি, তারা একলা দৌঁড়ুচ্ছে কিংবা হাঁটছে। কারো মাঝেই শ্লীলতাহানি বা আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই। একবার রাত ১১টার পর গিয়ে দেখি জনা-তিনেক কিশোরী তাদের মাঝে আত্মভোলা হয়ে খেলছে। তাদের স্কুলের শর্ট স্কার্ট আর সাদা শার্ট দেখে বোঝা যায়, এরা মিডল কিংবা সদ্য হাই স্কুলে প্রমোশন পাওয়া ছাত্রী। একটু পরপরই তারা নিজেদের মাঝ আলাপচারিতায় মশগুল হয়, আবার খিল খিল করে হেসে উঠছে। ক্যান্ডি ফ্লস হাতে সেলফি তুলছে, আবার হয়তো কোনো কৌতুকের জন্য একজন আরেকজনের পিছে তাড়া করছে। পার্কের কারো মাঝেই কোন ভ্রুকুটি নেই ওই ছাত্রীদের চঞ্চলতায়। মনে হচ্ছিল সদ্য পাখা গজানো কিছু প্রজাপতি তারা। আপন মনে খেলছে, নেই কোনো ভয় কিংবা কোনো উশৃংখল কোনো যুবকের দ্বারা উত্যক্ত হওয়ার সম্ভাবনা। তাদের পাশ কাটিয়ে আসার অনেক দূর পর্যন্ত তাদের চঞ্চলতার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। কতইবা বয়স হবে তাদের- চৌদ্দ কী পনের।
২. আমরা
ঘরের উঠোনে একটা খাটিয়ার উপর শুয়ে আছে মেয়েটি। তার ডান হাতটি খাটের বাইরে ঝুলে আছে। খাটের সাদা চাদরটি মেয়েটির ছোট্ট শরীরের রক্তে রাঙা। হাতের মেহেদির উজ্জ্বল রঙটা হালকা ফিকে হয়ে আসছে যত, ততই তার রক্তে রাঙা হচ্ছে চাদর আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে মিশে যাচ্ছে মাটিতে। আজ থেকে ৩৫ দিন আগে ওরা কত যত্ন করেই না তার হাত ওই মেহেদিতে রাঙিয়েছিল। হাতে মেহেদি, পায়ের আলতা আর ঘর ভর্তি তার আত্মীয়-স্বজন। মেয়েটির মনে হচ্ছিল সে তার বান্ধবীদের সাথে চড়ুইভাতির দিনগুলোতে ফিরে গেছে, পার্থক্য শুধু আজ তার বান্ধবীদের জায়গায় কতগুলো বয়স্ক মানুষ তাকে নিয়ে খেলায় মশগুল। বোকা বোকা চোখে সে তার বান্ধবীদের দিকে তাকাচ্ছিল আর বুঝতে পারছিল না কিছুই। বয়স্ক মানুষগুলো বলছিল আজ নাকি তার বিয়ে। এই বিয়ে স্বামী, সংসার, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোনো কিছু সম্পর্কেই তার কোন বাস্তবিক ধারনা ছিল না। তার ভাবি সম্পর্কীয় আত্মীয়রা বার বার কি যেন শারীরিক সম্পর্ক, সন্তান এইসব নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করছিল আর নিজেদের মধ্যে তাকে নিয়ে কৌতুক করে হেসে উঠছিল।
সদ্য ১৪ বছরে পড়া শিশুটির মাথায় ধরছিল না এর কিছুই। তার শরীরে একজন পরিণত নারীর কোনো চিহ্নই সম্পূর্ণরূপে আসেনি তখনো। নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্যগুলোও খুব একটা স্পষ্টও ছিল না তার কাছে। শারীরিক সম্পর্ক বলে যে জিনিসটা বর্তমান, তার ব্যাপারে ধারনাও অনেকটা শূন্যের কোটায়। ইঁচড়ে পাকা বান্ধবীদের কেউ কেউ বলে শুক্রাণু নাকি বাতাসে উড়ে কিংবা কোন পুরুষকে চুমো খেলেই নাকি মেয়েরা সন্তান সম্ভাব্য হয়ে যায়। সংসার, স্বামী সন্তান সকল বিষয়ে অজ্ঞতা নিয়েও মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় আর নিজেকে আবিষ্কার করে তথাকথিত ফুল সজ্জার রাতে তার থেকে ২১ বছরের বড় স্বামী নামক পিশাচের ঘরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিশাচটি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ছোট্ট অপরিণত শরীরের উপর। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় তার পোশাক, তার ছোট্ট শরীর নিমিষেই ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সেই স্বামী নামক পাষণ্ড হায়েনার দাঁত আর নখরের আঘাতে। আর বিছানা ভিজে যায় শিশুটির নিম্নাঙ্গের রক্তে। নিথর হয়ে পড়ে শিশুটি। এই কি তবে বিয়ে! এই কি তবে শারীরিক সম্পর্ক? শিশুটির মাথায় আসছিল না কিছুই, আসবেই বা কীভাবে, সে তো শরীরের ব্যাথায় মূর্ছাই গিয়েছিল কবে। এভাবে ৩৪ দিন সেই পিশাচ আর নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে লড়ে আজ মুক্তি পেয়েছে শিশুটি। মেয়েটির মুখে মুক্তির হাসি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই ৩৪ দিনের নরকের থেকে মুক্তি পেয়ে শিশুটি আজ তৃপ্ত। আবার মনে হচ্ছে তার মুখে কঠিন অভিযোগ। মনে হচ্ছে কঠিন সুরে সে তিরস্কার করছে বাংলাদেশ আর বাঙালি সমাজকে। এই ব্যর্থ সমাজ, এই ব্যর্থ জাতি শিশুটিকে বাঁচতে না দিলেও বাংলার মাটি তাকে ঠিকই আপন করে বুকে আগলে নিচ্ছে।
উপরের ঘটনাটি কোনো কল্প কাহিনী নয়। এমন কি কোনো দুর্ঘটনাও নয়। বাংলাদেশের সমাজে অহরহ ঘটে যাওয়া একটি উদাহরণ মাত্র। টাঙ্গাইলের শিশু নুরুন নাহারের মত নরকের মধ্য দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশের এমন আরও লাখো নুরুন নাহারকে। নুরুন নাহারের মৃত্যুর কারণ উপর্যপুরি ধর্ষণ ও রক্তক্ষরণ। এই এক ঘটনা থেকে প্রতিফলিত হয় ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, সামাজিক অবক্ষয়, আইন-বিচার ব্যবস্থার অসঙ্গতি। এই মৃত্যুর জন্য দায়ী তার স্বামী, তার লোভী পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি, কাজি, বিয়ে পড়ানো হুজুর, গ্রামের কবিরাজ সহ সংশ্লিষ্ট সবাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী— রত্না, স্বপ্না, শান্তার মত এই নির্যাতিত, বাল্যবিবাহের নৃশংসতার শিকার শিশু নুরুন নাহারও আপনার কন্যা। নুরুন নাহারের বয়সী এই শিশুদের মাঝে থাকে একই ধরনের দুরন্তপনা, থাকে মেধার স্ফুরণ, থাকে নিজ জীবন, দেশ, সমাজ গড়ার স্বপ্ন। বাল্য বিবাহের বেড়াজালে আটকে আব্দুর রশিদের বিকৃত লালসার শিকার হয়ে তারা অকালে হারিয়ে যায়। এই ক্ষতি নুরুন নাহারের নয়, এই ক্ষতি আমাদের, আমাদের সমাজের, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের। আপনার কাছে দাবি রইল এই নুরুন নাহারদের ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করবেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]